চ্যাডউইক বোসম্যান: হার না মানা লড়াকু এক সুপারহিরোর গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে শরীরে। অথচ পর্দার সামনে তিনি দেখাচ্ছেন একের পর এক কারিকুরি। মেথড এ্যাক্টিং থেকে কর্মাশিয়াল ধুন্ধুমার এ্যাকশন, করেছেন সবই। পর্দার এই 'ব্ল্যাক প্যান্থার', বাস্তবেও কম ছিলেন না, ছিলেন হার না মানা, লড়াকু এক যোদ্ধা!
আফ্রিকার ওয়াকান্দা নামের একটি দেশের রাজপুত্র টি চালা। বাবা খুন হওয়ার পর তার ওপর দায়িত্ব পড়ে রাজ্যের শান্তি রক্ষার। নেহিসি কোটসের লেখা ও ব্রায়ান স্টেলফ্রিজের ডিজাইনের পোশাকে 'ব্ল্যাক প্যানথার' চরিত্রে পর্দায় আসেন সুঠামদেহী, কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণ, চ্যাডউইক অ্যারন বোসম্যান। এটা শুধুমাত্র এক সাধারণ সিনেমা হয়ে থেকে যায় না মোটেও। কৃষ্ণাঙ্গ কোনো সুপারহিরোকে উপজীব্য করে এর আগে কি কোনো সিনেমা নির্মিত হয়েছিলো? উত্তর আমিই দিয়ে দিচ্ছি। হয়নি। সে হিসেবে, 'ব্ল্যাক প্যান্থার' এবং প্রধান চরিত্রে চ্যাডউইক বোসম্যান হয়ে যান এক ইতিহাসেরই সাক্ষী।
মার্ভেল স্টুডিওর যাত্রা শুরু কিন্তু সেই ২০০৮ সালে। তখন 'আয়রনম্যান' সিনেমাটি মুক্তি পেলো। মার্ভেল স্টুডিও'র যাত্রাও শুরু হলো তখনই। এরপর মার্ভেল কমিকসের সুপারহিরোদের নিয়ে গুনে গুনে ১৭ টি সিনেমা করলেও এককভাবে কোনো সিনেমাতে আমরা পেলাম না টি চালা'কে। ব্রাত্য রইলো 'ব্ল্যাক প্যান্থার।' সে খরা কাটে ২০১৮ সালে। মুক্তি পায় ব্ল্যাক প্যান্থার। গড়ে ইতিহাস। প্রথমবারের মত কোনো ব্ল্যাক সুপারহিরো আসেন সিনেমার পর্দায়।
'ব্ল্যাক প্যান্থার' অথবা চ্যাডউইক বোসম্যান আর নেই। প্রয়াত হয়েছেন গতকালই। জীবনের গল্পে আমরা কেউই সুপারহিরো নই। সবাই-ই গড়পড়তা সাধারণ মানুষ। তাই মৃত্যু এসে হুটহাট আমাদের টেনে নিয়ে যেতে পারে। তবুও আলাদা করে চ্যাডউইক বোসম্যান কে নিয়ে কথা বলার জায়গা থেকেই যায়। কোলন ক্যান্সারে তিনি আক্রান্ত ছিলেন ২০১৬ সাল থেকেই। এরমধ্যেও তিনি অভিনয় করেছেন বেশ কিছু সিনেমায়। কেমোথেরাপি, ট্রীটমেন্ট চলছে। তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পর্দায়ও! কেউ আঁচও করতে পারছে না, কী ভীষণ জগদ্দল বোঝা নিয়ে কাটাচ্ছেন তিনি তার জীবন! অভিনেতারা এভাবেই হয়তো নিজের যাপিত দুঃখ-কষ্টকে আটকে রাখেন ব্যক্তিগত পকেটে। উপরে যা দেখি আমরা, তা নিরেট সত্যি নয়। কিন্তু মিথ্যেটাও ধরতে পারিনা আমরা।
বোসম্যানের জন্ম সাউথ ক্যারোনিলার এ্যান্ডারসনে। টেক্সটাইল ব্যবসার সাথে যুক্ত বাবা ও নার্স মায়ের সন্তান বোসম্যান পড়াশোনা শুরু করেন টি এল হান্না হাই স্কুলে। স্কুলে থাকতেই তিনি একটি নাটক লিখে ফেলেন, 'ক্রসরোডস' নামে। নিজের প্রিয় বন্ধু গুলিতে নিহত হওয়ার পর এই নাটক লেখেন তিনি। এবং নাটকটি স্কুলে মঞ্চস্থও হয়।
তখন থেকেই তার ইচ্ছে ছিলো, সিনেমার পরিচালক হবেন। সিনেমা বানাবেন। অবশ্য ছোটবয়সে অনেকেই অনেক কিছু ভাবেন। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে সেগুলো মাথা থেকে ছুটেও যায়। কিন্তু বোসম্যানের ক্ষেত্রে সেটি আমরা লক্ষ্য করিনা। যতই বড় হতে থাকেন, সেই ইচ্ছে তার মধ্যে আরো দৃঢ় হতে থাকে। ভর্তি হন হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে পরিচালনার ওপর ডিগ্রি নিয়ে বের হন। অক্সফোর্ডে 'ব্রিটিশ আমেরিকান ড্রামা একাডেমি'র বিশেষ কোর্সেও অংশগ্রহণ করেন। নিউইয়র্কের 'ডিজিটাল ফিল্ম একাডেমী' থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। সিনেমা বানানোর ভূত তো আগে থেকেই ছিলো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিষয়টা আরো পাকাপোক্ত হয়।
বোসম্যান বোস্টনে থাকা শুরু করেন এরপর। ড্রামা ইন্সট্রাক্টর হিসেবেও কাজ করেন বেশ কিছুদিন। এরপরই ভাবলেন, এভাবে হচ্ছেনা। তাকে ভালো পরিচালক হতে হলে আগে ভালো অভিনেতা হতে হবে। তিনি অভিনয় করার জন্যে এরপর পাড়ি জমালেন লস এ্যাঞ্জেলসে। সেটা ২০০৮ সালের ঘটনা।
যদিও ২০০৩ সালের দিকে টিভি সিরিজেও অভিনয় করেছিলেন বোসম্যান। টিভি জগতের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন অনেকদিনই। তবে চ্যালেঞ্জিং অভিনয় ওরকম আসছিলোনা। বেসবল লিজেন্ড জ্যাকি রবিনসনকে তিনি যখন '42' সিনেমায় পর্দায় নিয়ে আসলেন, সেটা হয়ে গেলো অসাধারণ কিছু। বেসবল নিয়ে মগ্ন থাকা এক মানুষ, সেসাথে চারপাশে থেকে ভেসে আসা বর্ণবাদের বিষ... সবকিছুকে ট্যাকল করে বেঁচে থাকা, এগিয়ে যাওয়া, সবকিছুকেই দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুললেন চ্যাডউইক বোসম্যান। মজার ব্যাপার হলো, এরপরেই অভিনয় করলেন আরেকটি বায়োপিকে। ব্ল্যাক মিউজিক আইকন জেমস ব্রাউনের চরিত্রে। যেই চরিত্রটি পুরোপুরি জ্যাকি রবিনসনের বিপরীত। চ্যালেঞ্জ টা নিয়েই নিলেন চ্যাডউইক বোসম্যান। এই সিনেমাটা করার জন্যে সারাক্ষণই পাগলের মত গান শুনতেন আর নাচানাচি করতেন। এভাবেই একসময়ে ঢুকে যান 'জেমস ব্রাউন' চরিত্রের মধ্যে। অনেকেই বোসম্যানকে বলতেন, বায়োপিক না করার জন্যে। মারদাঙ্গা সিনেমা করার জন্যে। বোসম্যান বলতেন-
এখনো অনেক কৃষ্ণাঙ্গ কিংবদন্তির গল্প মানুষ জানেনা। আমার কাজের মধ্য দিয়েও যদি দুয়েকজন জানতে পারে। ক্ষতি কী!
এরপর ক্যাপ্টেন আমেরিকা, এ্যাভেঞ্জারসঃ ইনফিনিটি ওয়্যার এন্ডগেম, ব্ল্যাক প্যান্থার এগুলো নিয়ে তো সবারই জানা। এছাড়াও অভিনয় করেছেন- দ্য এক্সপ্রেস, ড্রাফ্ট ডে, ম্যাসেজ ফ্রম দ্য কিং, গেট অন আপ, হেল্প এর মতন সিনেমাতে। লিংকন হাইটস, পার্সোনস আননোন এর মত টিভি সিরিজেও ছিলেন। পুরস্কারও পেয়েছেন অগুনতি। স্ক্রিন এ্যাক্টরস গিল্ড এ্যাওয়ার্ড, এমটিভি মুভি এ্যাওয়ার্ড, বিইটি এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
এই মানুষটি অভিনয় নিয়ে মাতামাতি করতেন নিয়মিত। মেথড এ্যাক্টিং করেছেন জ্যাকি রবিনসন আর জেমস ব্রাউন চরিত্র দুটিতে। এমনও হয়েছে, সিনেমা শেষ, কিন্তু তিনি চরিত্র থেকে আর বেরোতে পারছেন না। অনেক কষ্টে বেরোতে হয়েছে। সেই মানুষটিই আবার কমার্শিয়াল সিনেমার সুপার হিউম্যান। অভিনয় নিয়ে আবেগ এবং যত্ন না থাকলে এতদিকে মোটেও যাওয়া যায় না। তাছাড়া বর্ণবৈষম্যের এ প্রতিকূল সময়ে তিনি চাইতেন, কালো মানুষদের গল্পগুলো আসুক। মানুষ জানুক তাদের নিয়ে। ভেতরে ক্যান্সার দানা বেঁধেছে, মাঝেমধ্যেই ছোবল দিচ্ছে, অথচ ক্যামেরার সামনে তিনি হেলদোলও দেখাচ্ছেন না। থামিয়ে রাখছেন মৃত্যুদূতকে। অভিনয়কে ভালো না বাসলে এগুলো হয় না কখনোই।
বেঁচে থাকলে হয়তো চ্যাডউইক বোসম্যান অথবা 'ব্ল্যাক প্যান্থার' আরো সিনেমা করতেন। পর্দার সামনের দর্শককে মুগ্ধ করতেন হয়তো আরো কোনো অভিনয় দিয়ে। হয়তো আরো কোনো কৃষ্ণাঙ্গ কিংবদন্তির গল্প তিনি বলতেন। বয়স তো হয়েছিলো মাত্র তেতাল্লিশই। কিন্তু আগেই তো বললাম, বিধাতা মাঝেমধ্যেই বুঝিয়ে দেন, তিনিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। আমরা সবাই-ই সাধারন মানুষ। তারই সুত্র ধরে চলে যেতে হলো এই মানুষটিকেও। তবে যাওয়ার আগেও ক্যান্সারের সাথে টানা চার বছর ধরে যে লড়াই তিনি করে গেলেন, সে জন্যে কুর্নিশ। সেটি প্রেরণা যোগাবে আরো অসংখ্য মানুষকেও।
বিদায়, ব্ল্যাক প্যান্থার। ওপারে আরো অনেক এ্যাডভেঞ্চার হোক। এটাই কামনা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন