চাক দে ইন্ডিয়া’ তখনও প্রাসঙ্গিক ছিল, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ এখনো প্রাসঙ্গিক। তেরো বছরে বদলেছে অনেক কিছুই, কিন্তু বদলাতে হবে আরও। পাথব্রেকিং সিনেমা হিসেবে, গ্রাউন্ডব্রেকিং স্পোর্টস মুভি হিসেবে আর লৈঙ্গিক অসমতাকে লিটারেলি হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে দেশছাড়া করার চেষ্টার কারণে ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ সিনেমাপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে থাকবে সবসময়...
চাক দে ইন্ডিয়া কি ছিল? স্রেফ একটা অফ বিটের কমার্শিয়ালি হিট স্পোর্টস মুভি? না...চাক দে একটা রেভেলেশন ছিল বলিউডের মূল ধারার সিনেমার ক্ষেত্রে। প্রেডিক্টেবল স্টোরি আর আনপ্রেডিক্টেবল স্ক্রিনপ্লের এক দুর্দান্ত কম্বিনেশন ছিল। একচোখা পুরুষবাদী স্পোর্টস আর সিনেমার ক্ষেত্রে নারিবাদী ধারার চপেটাঘাত ছিল। সদা প্রাসঙ্গিক রিলিজিয়াস ইনটলারেন্সের এক মূর্ত প্রতীক ছিল।
ইয়াশ রাজের মতো জায়ান্ট প্রোডাকশন পরপর দুটো ফ্লপ দিয়ে সেসময় বেশ বিপাকে আছে। এর মাঝে স্পোর্টস মুভির স্ক্রিপ্ট নিয়ে এসেছে নতুন পরিচালক-লেখক যুগল শিমিত আমিন আর জয়দীপ সাহানি। রাইটার জয়দীপ সাহানির মাথায় পত্রিকা পড়তে পড়তে ইন্ডিয়ান নারী হকি টিমের ছোট্ট একটা নিউজ দেখে মাথায় গল্প আসে এই মুভির। সে গল্পই শিমিতের সাথে শেয়ার করেন এবং তারা ইয়াশ রাজকে এপ্রোচ করেন প্রোডিউস করার জন্য।
ইয়াশ রাজ প্রথমে নিশ্চিত ছিল না এই মুভির ব্যাপারে, কারণ কম্পারেটিভলি নতুন নির্দেশক শিমিত আমিন ‘হকি’ নিয়ে মুভি বানাতে চাচ্ছেন। যেখানে ভারতের প্রধান খেলা ক্রিকেট নিয়েই কোন সুপার হিট মুভি ছিল না সেখানে হকি নিয়ে মুভি বানালে কে দেখবে? তার ওপর বড় গ্যাম্বল ছিল যে ছেলেদের হকি না বরং মেয়েদের হকি নিয়ে সিনেমার মূল গল্প। আর ১৬ টা মেয়ের সেই গল্পের সাথে এক সমালোচিত কোচের চরিত্রে শাহ্রুখ খানের অভিনয়। দর্শক যে পজিটিভলি নেবে না তা মোটামুটি সবাই মেনে নিয়েছিল শুরুতেই।
এই সিনেমা মুক্তির প্রথম দিন শিমিত আমিন আর রাইটার জয়দীপ সাহানি দেশের বাইরে ছিলেন, সেখান থেকেই জয়দীপ ফোন লাগান ইয়াশ চোপড়াকে মুভির খবর নেয়ার জন্য। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও সেসময় চাক দে ইন্ডিয়া মাত্র ৪০০ স্ক্রিনে মুক্তি পেয়েছিল। ইয়াশ চোপড়াও বাস্তবতা বলে দেন জয়দীপকে- হলে কেউ আসেনি জয়। তবে তোমরা যে ফিল্ম বানিয়েছ তার অংশ হতে পেরে ইয়াশ রাজ গর্বিত। এটুকুই যথেষ্ট ছিল শিমিত আমিন, জয়দীপদের জন্য। যথেষ্ট ছিল ভারতের দর্শকদের জন্যও। তাই ক্রিটিক ও মানুষের দুর্দান্ত পজিটিভ ওয়ার্ড অফ মাউথে পরবর্তীতে তুমুল সাড়া ফেলে দেয় চাক দে ইন্ডিয়া।
চাক দে একইসাথে স্পোর্টস নিয়ে উপমহাদেশীয় রাজনীতির নোংরা রূপকে যেমন সামনে তুলে এনেছে তেমনি দেশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে খেলার মাঝে সকল ধরণের জেন্ডার ডেস্ক্রিমিনেশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। ২০০৮ সালে যখন ভারতের হকি ফেডারেশন খোলানলচে বদলে ফেলা হল তখন ইন্ডিয়ান হকি দলের কোচ আসলাম শের খান বলেছিলেন যে তিনি হকি দলে এখন "চাক দে" ইফেক্ট চান। এই মুভির 'চাক দে ইন্ডিয়া' গান স্পোর্টসের ক্ষেত্রে থার্ড ন্যাশনাল এন্থেমের মর্যাদা পায় এখন মোটামুটি, জনগণ মন আর বন্দে মাতরমের পরে। ইন্ডিয়ান ক্রিকেটেও ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ গান আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। ২০০৭ এর টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০১১ এর ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের পর এই গান ছিল ইন্ডিয়ান ক্রিকেট দলের প্রধান সঙ্গী।
চাক দে ইন্ডিয়ার সেই বিখ্যাত স্পিচ- ৭০ মিনিট, মূলত জয়দীপও শাহ্রুখকে ব্রিফ করতে পারেন নি। স্পোর্টস মুভি স্পিচ ছাড়া জমে না, তাই জয়দীপ লিখেও ফেলেছিলেন একটা। কিন্তু এই স্পিচের পুরো দমটাই যে নির্ভর করবে বক্তার ওপরে, তাই সেই বক্তার ওপরেই বলার ভঙ্গির দায়ভার ছেড়ে দেন লেখক ও পরিচালক। মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল সিনেমার তুফান উঠিয়ে আসা শাহ্রুখ যে অভিনয়েও ‘কিং খান’ সেটিই দেখিয়ে দেন যেন সেই সিনে। সেই স্পিচ সিনে সুপারস্টার‘শাহ্রুখ খান’ এর ক্যারিজমাও থাকে, আবার ক্যারেক্টার‘কবির খান’ এর অতৃপ্ত তৃষ্ণাটাও জাগে। প্রতিটা মেয়ের মাঝে যেন কবির খান নিজেকে প্রতিস্থাপিত করেন। মাঠে যারা খেলেছিল সবার বুকেই সেই অতৃপ্তি জাগিয়ে দিতে পেরেছিলেন শাহ্রুখ সেই সিনটা দিয়ে।
অনেকে ভাবতে পারে যে শেষে নারী দলের ট্রফি জয়টাই মূল জয় ছিল, কিন্তু প্রতিটা মেয়ে আসলে জিতে গিয়েছিল ড্রেসিংরুমে বসে, সেই স্পিচের পরেই। মনের ভেতরে চলা দ্বন্দ্বকে তুচ্ছ করার সাহস পেয়েছিল তারা সেখান থেকেই, তাদের এত বছর ধরে করে আসা স্ট্রাগল থেকে। জীবনের যুদ্ধে জেতার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল কবির খান ও প্রতিটি মেয়ে সেখানেই, এরপর ফাইনাল ম্যাচে জেতাটা তাই ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ই ছিল বলা চলে।
‘চাক দে ইন্ডিয়া’ তখনও প্রাসঙ্গিক ছিল, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ এখনো প্রাসঙ্গিক। তেরো বছরে বদলেছে অনেক কিছুই, কিন্তু বদলাতে হবে আরও। পাথব্রেকিং সিনেমা হিসেবে, গ্রাউন্ডব্রেকিং স্পোর্টস মুভি হিসেবে আর লৈঙ্গিক অসমতাকে লিটারেলি হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে দেশছাড়া করার চেষ্টার কারণে ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে থাকবে সিনেমাপ্রেমী মানুষের মনে সবসময়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন