চার্লি হেব্দো: অন্যকে কষ্ট দেয়াটাই যাদের মুখ্য উদ্দেশ্য
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যখন আপনি যুক্তি-তর্ক-তথ্য কিংবা উপাত্তের ধার-কাছ দিয়ে না গিয়ে নবী, যীশু বা মেরির নগ্ন ছবি আঁকবেন কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে মজা লুটতে চাইবেন, ধরে নিতে হবে আপনি আসলে যুক্তি নিয়ে মোটেও চিন্তিত না। আপনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অন্যকে কষ্ট দেয়া। অন্যকে আপনার হতাশায় বিদ্ধ করা...
বহু কষ্টে ফ্রেঞ্চ স্যাটায়ার ম্যাগাজিন চার্লি হেব্দো'র এই বিতর্কিত সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করেছি। আজ সকালেই সবগুলো অর্ডার করা সংখ্যাগুলো হাতে পেলাম। আপনারা ছবিতেই নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন সংখ্যাগুলো কী নিয়ে। ছবিতে কিংবা অন্যের মুখে আমরা যা শুনি, বাস্তব বোধকরি অনেকটাই ব্যতিক্রম যখন আপনি সেই বিতর্কিত কিংবা আলোচিত কোনো বিষয়ের সামনে বাস্তবে এসে দাঁড়াবেন।
ঠান্ডা মাথায় সংখ্যাগুলো একটা একটা করে চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। যেহেতু ফ্রেঞ্চ ভাষা বুঝি না, ফলে কী লিখেছে জানি না, কিন্তু জাস্ট চোখ বুলিয়েছি। চেষ্টা করব গুগোল করে যতদূর পারা যায় ঘটনা বুঝতে।
এই ম্যাগাজিনগুলো হাতের কাছে পেয়ে এবং চোখ বুলিয়ে যে ভাবনাটি একেবারে শুরুতেই সামনে এসেছে, সেটি হচ্ছে- এই ম্যাগাজিনের পেছনে যারাই রয়েছেন এবং যারাই কাজ করেন কিংবা যারাই প্রকাশ করেন এরা এক একজন রীতিমত স্যাডিস্ট। অন্যকে কষ্ট দিয়ে, অন্যকে দুঃখ দিয়ে যারা এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পান।
আমার দেয়া ছবিটির উপরের সারিতে থাকা মধ্যম ম্যাগাজিনটা ইসলামের শেষ নবী মোহাম্মদকে নিয়ে। বাম দিকেরটা টার্কিশ রাষ্ট্রপতি এরদোগানকে নিয়ে, ডান দিকেরটা খৃষ্টানদের ধর্মগুরু জেসাস/যীশু কিংবা মুসলিমদের নবী ঈসাকে নিয়ে। দ্বিতীয় সারির প্রথম ছবি ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনকে নিয়ে, মধ্যমটি আবারো মুসলমানদের নিয়ে এবং শেষের ভয়াবহ নোংরা ম্যাগাজিনটি আবারো জেসাস কিংবা নবী ঈসাকে নিয়ে।
জানি না, আমার স্যাটায়ারের টেস্ট খুব সম্ভবত আলাদা, ফলে এদের এই স্যাটায়ার আমার রীতিমত মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয় সারির শেষ ম্যাগাজিনটা দেখুন। ঈসা মায়ের যোনীদ্বার দিয়ে বের হচ্ছে, এই কার্টুন এঁকেছে। এই প্রচ্ছদটা দেখেই আমার ঘৃণায় গা গুলিয়ে গেছে, হাসি পাওয়া তো দূরের কথা এদের এইসব স্যাটায়ারের আইডিয়া দেখে মনে হচ্ছিলো, প্রত্যেকেই খুব সম্ভবত মানসিক রোগী।
যদি ধর্ম নিয়ে রসিকতা করবার সমস্ত আয়োজনও থেকে থাকে এবং ধরা যাক এটা বৈধও, তথাপিও মায়ের যোনীদ্বার দিয়ে সন্তান পৃথিবীতে প্রবেশ করছে, এটিকে নোংরা আকারে কার্টুন দিয়ে এঁকে ঠিক কোন রসিকতাটা উদ্ধার হলো, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারিনি।
উপরের সারির সর্বডানে যেসাসের মাথায় একটা পুরুষাঙ্গ বেঁধে দিয়ে এবং ক্রুশ বিদ্ধ যীশু সেটি সরিয়ে পৃথিবী দেখছেন, এটিতেও ঠিক কি রসিকতা হোলো তাও মাথার উপর দিয়ে গেছে। হতে পারে এটি অন্যের জন্য বড় হাসির কিংবা হো হো করে গলা ফাটাবার কন্টেন্ট। কিন্তু আমার কাছে, এদেরকে স্রেফ মানসিক রোগী ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।
একজন আইনজীবি হিসেবেই কিনা জানি না, আমি যে কোনো ঘটনার পেছনে ব্যক্তির ইন্টেনশন খুঁজি। বুঝবার চেষ্টা করি ঘটনার পেছনে মোটিভ কী। একেবারে সুনির্দিষ্ট করে ঘটনায় ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছের প্যাটার্নটা বুঝতে পারলে পুরো ঘটনা বুঝতেই সুবিধা হয়।
আমার কাছে এই পত্রিকার প্রচ্ছদ, ভেতরের আরো কার্টুন, এসব দেখে এইসব আঁকিয়েদের কিংবা ম্যাগাজিন প্রকাশকদের একটা ইন্টেনশন-ই স্পস্ট হয়ে উঠেছে, আর সেটি হলো, 'অন্যকে কষ্ট দেয়া'।
একজন ব্যক্তি যখন বই-পত্র-নথি-উপাত্ত নিয়ে নবী মোহাম্মদের সমালোচনা করবেন কিংবা যীশুর সমালোচনা করবেন, শুরুতেই ধরে নেয়া যায় সেই ব্যক্তি মূলত একটা যৌক্তিক বিতর্কে আগ্রহী। তাঁর জানার কিংবা জানাবার আগ্রহ স্পস্ট। এসব ক্ষেত্রে ইন্টেনশনটাই এমন যে, এতে করে নবী বা যীশু বিতর্কিত হলে খুব গায়ে লাগে না। মনে হয় তর্ক করা যেতেই পারে, বিতর্ক হতেই পারে। এবং সেটি হওয়া-ই উচিৎ।
কিন্তু যখন আপনি এইসব যুক্তি-তর্ক-তথ্য কিংবা উপাত্তের ধার-কাছ দিয়ে না গিয়ে নবীর একটা ন্যাংটা ছবি আঁকবেন, যীশুর মা কিংবা যীশুর একটা ন্যাংটা ছবি আঁকবেন কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে আপনি কেবল মজা লুটতে চাইবেন, ধরে নিতে হবে আপনি আসলে যুক্তি-টুক্তি এসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত না। আপনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অন্যকে কষ্ট দেয়া। অন্যকে আপনার হতাশায় বিদ্ধ করা। আপনার না পাওয়া, আপনার চরম অসফল জীবন, আপনার পরম ব্যর্থতাকে আপনি অন্যের কাছে ছড়িয়ে দিতে চান।
চার্লি হেব্দোকে আমার একটা প্রথম সারির স্যাডিস্ট ম্যাগাজিন মনে হয়েছে। যারা অন্যকে হাসাতে নয়, অন্যকে কষ্ট দিতে চায়। দুঃখ দিতে চায়। অন্যের কান্না দেখে হাসতে চায়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন