আচ্ছা, চকলেটের প্যাকেটের গায়ে কেন বানরের ছবি দেয়া? অদ্ভুত না?
কিউট দুটো বানরের মুখ, দেখলেই মায়া লাগে! যাক, সে গল্প পরে বলছি। আজ চকলেট ডে! ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে প্রতি বছর চকলেটের বিক্রি সারা বিশ্ব জুড়ে গড়ে ৬০০-৭০০% বাড়ে। আমরা দেশী চকলেট লাভাররা চকলেট নিয়ে ভেতরের অনেক গল্পই জানি না, আজ সে রকম কিছু গল্প বলবো।
২০০৭ সালে ক্যাডবেরি ইউকে একটা OVC (Online Video Commercial) বানায়, যেখানে দেখা যায়, ফিল কলিন্সের একটা গানের সাথে সাথে একটা গরিলা ড্রাম বাজাচ্ছে। দেড় মিনিটের এই বিজ্ঞাপনের প্রথম ১ মিনিট তাকে শুধু ড্রাম বাজানোর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়।
এই অ্যাডটিকে বানানোই হয় ভাইরাল হবার জন্য এবং ক্যাডবেরির লোগোর ব্যাপারে গণসচেতনতা বাড়াতে। যথারীতি এটি ভাইরাল হয়, সারাবিশ্ব থেকে এটিকে প্রায় ৫ কোটি বার দেখা হয় ওমনিচ্যানেল থেকে। মজার ব্যাপার হলো- খুব সাদামাটা এই অ্যাডটি জিতে নেয় প্রায় ডজনখানেক নামিদামী এওয়ার্ড! বিশেষ করে, ড্রাম বাজানোর অংশটুকু পৃথিবীর প্রতিটি সংগীতপ্রেমীরা দারুণভাবে উপভোগ করবেন, এই গ্যারান্টি দিচ্ছি।
চকলেট নিয়ে ভাইরাল বিজ্ঞাপনের কথা তো জানলেন, এবার শুনুন একটা ব্রিলিয়ান্ট ক্যাম্পেইনের গল্প! আমাদের ইউনিতে পড়ানো একটা কেস স্টাডি মনে পড়লো প্রসঙ্গক্রমে। আমেরিকার কিছু পরিবেশবাদী একবার সিদ্ধান্ত নিলো- তারা স্কুল কলেজের কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের কাছে গিয়ে ক্যাম্পেইন করবে। বিষয়টা কিন্তু এত ইজি না। কারণ, বেশীরভাগ ইয়াং ছেলেমেয়েই পরিবেশ, গ্রীন হাউস ইফেক্ট - এসব নিয়ে থোড়াই কেয়ার করে, এইসব নিয়ে তারা খুব একটা মাথা ঘামায় না, উল্টা হাসাহাসি করে।
সুতরাং, তাদের কাছে একটা গ্রহণযোগ্য, সিরিয়াস লেভেলের ক্যাম্পেইন আইডিয়া বের করা একটা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ ছিল। শেষে তারা অভিনব একটা ক্যাম্পেইন স্লোগান প্ল্যাকার্ডে লিখে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গেল। স্লোগানটা হলো- Trees are the only source in the world for chocolate. If you want to eat chocolate, save the trees. অর্থাৎ, গাছপালা হলো পৃথিবীতে চকলেটের একমাত্র উৎস। যদি চকলেট খেতে চাও, গাছ বাচাঁও।
অভিনব এই আইডিয়ায় অভিনব সাড়া পড়লো। মজার ব্যাপার হলো, এই ক্যাম্পেইন চালাতে গিয়ে তারা জানতে পারলো যে, অনেকেই জানেই না যে, চকলেট ’কাকাও’ গাছের কোকোয়া প্রসেস করে বানানো হয়, তারা এতদিন জানতো- চকলেট বুঝি ফ্যাক্টরিতে কৃত্রিমভাবে তৈরী হয়।
চকলেটকে ঘিরে বিজ্ঞাপন হলো, ক্যাম্পেইন হলো, এবার শুনুন একটা ইমোশনাল মানবিক উদ্যোগের গল্প! শুরুতে যে গল্পটা পরে বলবো বলেছিলাম, এটা সেই গল্প।
ইকুয়েডরে এক প্রকার বানরের জাত রয়েছে, তাদেরকে বলা হয় স্পাইডার মাংকি। এটি প্রায় বিলুপ্ত একটা প্রজাতি। স্থানীয়রা বন-জংগল সাফ করে কাকাও বিনের চাষ করে, এটাই তাদের প্রাথমিক পেশা। তো এই কারণে, স্পাইডার বানরকূল ভয়াবহ আবাসন সংকটে পড়ে। তার উপর কিছু ইকুয়েডরবাসী আবার বানর শিকার করে খায়ও! যার ফলে কয়েক বছরের ভেতর এই প্রজাতির বানরের সংখ্যা নেমে আসে মাত্র আড়াইশো'তে! তাই এটিকে পৃথিবীর সবচাইতে বেশী বিলুপ্ত হবার ঝুঁকিতে থাকা স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা হলো।
তো বানরগুলো পুরোপুরি বিলুপ্ত হবার আগেই একটা অভিনব উদ্যোগ নিলেন ইংল্যান্ডের একজন ইকোলজিষ্ট। তিনি গিয়ে কোকোয়া চাষীদের বললেন, ”গাছ কাটা বন্ধ কর। বিনিময়ে তোমরা এখন যে টাকা পাচ্ছ কোকোয়া বিক্রি করে, তার চাইতে ৪ গুন বেশী দামে আমি এগুলা কিনে নিবো!”
চাষীরা ভাবলো, কোন রকম বাড়তি পরিশ্রম বা খরচ না করেই শস্যের চারগুন বেশী মূল্য পেলে কে আর কষ্ট করে গাছ কাটতে যাবে? তারা প্রস্তাবে সানন্দে রাজী হলো। তাছাড়া, তারা এতদিন ন্যায্য মূল্যও পেতো না। এই প্রস্তাবে সাড়া দিলে সেটিও পাবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিবে।
কিন্তু ইকোলজিষ্ট সাহেব তো আর নিজের পকেট থেকে চারগুন দাম দিতে পারবেন না। সুতরাং, সে ইউরোপে গিয়ে বেশ কিছু ইকো-ফ্রেন্ডলি ক্রেতা খুঁজে বের করলেন, ক্রেতারা জানলো যে, তারা যদি একটু বেশী দাম দিয়ে তার থেকে চকলেট কেনে, তাহলে বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা স্পাইডার মাংকিসহ অন্যান্য বনজ পশু-পাখিগুলো প্রাণে বেঁচে যায়। তো তারাও সানন্দে রাজী হলো। তবে এ কাজে সবচেয়ে বেশী এগিয়ে আসে French fair-trade chocolatier Bouga Cacao.
২০১৬ সালে ইকোলজিষ্ট সাহেবের কনসারভেশন থেকে ৫ টন কোকোয়া উৎপাদিত হয়, যা আগে চাষিরা প্রতি কেজি মাত্র ১ ডলারে বিক্রি করতো। কিন্তু ”বউগা কাকাও” তাদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ৩.৭০ ডলারে (প্রায় ৪ গুন) কিনে নেয়, এবং পরবতী ৩ বছর তারা একই দামে কিনে নিবে বলে চুক্তি করে। এভাবেই বেচেঁ যায় স্পাইডার মাংকি, আর কৃষকরাও ন্যায্য মূল্যের চাইতে একটু বেশীই পেলো শস্যের দাম!
শুধু তাই না, ইকোলজিষ্ট সাহেব ও তার টিম তার খামারে উৎপাদিত কোকোয়ার গুনগত মানও বেশ গবেষণা করে কয়েকগুন বাড়ালেন। যাতে করে, বেশী দামে বিক্রি করাটা আরো বেশী করে জাস্টিফাই করা যায়।
যে এলাকার কথা বলছি, সেটি ইকুয়েডরের ”এল চকো” এলাকা (এই এলাকার নামানুসারেই চকলেট নামটা আসে খুব সম্ভবত!), সেই এলাকার একটা অংশ হচ্ছে - ওয়াশু। সেই চকলেটের নামকরণ করা হয়– ওয়াশু চকলেট, যার প্রায় ৭৫% dark organic chocolate. এর প্রতিটার দাম তিন ডলার। ৩.৭০ ডলার দিয়ে কেনা এক কেজি কোকোয়া থেকে এই রকম শতাধিক চকলেট বার বানানো হয়, এবার বুঝুন কতটা লাভজনক এই ব্যবসা!
পোষ্টের সাথে এই চকলেটের প্যাকেজিংয়ের একটা ছবি দিলাম। সেই ছবিটি দেখলেই যে কেউ এই গল্পটাকে রিলেট করতে পারবেন প্যাকেজিংয়ের সাথে!
এবার চকলেটের কিছু ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট বলি। পৃথিবীতে জনপ্রিয়তার দিক থেকে চকলেটের নাম্বার ওয়ান ব্র্যান্ড হচ্ছে MARS। কিন্তু Cadbury's Dairy Milk বানানো হয় সবচাইতে বেশী, ৩৫ কোটি বার প্রতি বছর! চকলেট বানাতে কোকোয়ার পরিমান প্রায় চকলেটের সমানুপাতিক। মানে, ১ কেজি চকলেট বানাতে প্রায় ৯০০ গ্রাম কোকোয়া দরকার হয়। এই কারণেই চকলেট এত এক্সপেনসিভ।
আর সাদা বা দুধ চকলেট আদতে চকলেটের কোনো জাতের মধ্যে পড়ে না। কারণ এটাই জগতে একমাত্র চকলেট, যেটাতে ’কোকোয়া চকলেট’ ব্যবহার করা হয় না। কোকোয়া বাটার ব্যবহার করা হয়।
সবচাইতে উইয়ার্ড ফ্যাক্ট হলো, প্রতিটি চকলেটে গড়ে কমপক্ষে ৮টি পোকামাকড়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে। (ঠিক এই কারণেই অনেকের চকলেট-এ্যালার্জি হয়। মানে চকলেট খাবার পর গা ফুলে যায়, চুলকায়, গোটা গোটা র্যাশ পড়ে যায়।) কিন্তু আমেরিকার ফুড এসোসিয়েশন এটাকে গ্রহণযোগ্য বলে সনদ দিয়েছে। এবং তারা ঘোষনা দিয়েছে- প্রতি ১০০ গ্রাম চকলেটে সর্বোচ্চ ৬০ টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণযোগ্য। এর চাইতে বেশী হলে তারা উক্ত চকলেটকে সার্টিফাই করবে না! বাই দ্য ওয়ে, তেলাপোকা আর চকলেট- ইংরেজিতে দুটোই C দিয়ে শুরু হয় আর লিখতে সমান সংখ্যক অক্ষর দরকার।
সবশেষে ছোট্ট একটা ধাঁধাঁ দেই, চকলেটে কেন পোকা-মাকড়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে?
রেফারেন্স-
১। Save The Monkeys, Save The Trees, Sell The Chocolate
২। Chocolate Allergies Actually Due to Cockroach Parts in Food, Experts Say