এখন ছয়ফুর রহমানের মতো মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায় না, চারপাশ গিজগিজ করে ফুটেজ পাওয়ার নেশায় চা বানাতে বসে যাওয়া কিংবা বাসের হেল্পার বনে যাওয়া নেতায়।

ঢাকা শহরে বলুন, বা দেশের যে কোন প্রান্তে, রাজনৈতিক জনসভাগুলোতে মানুষ ভাড়া করে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজটা বেশ পুরনো। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরে সামরিক সরকারের আমল থেকেই শুরু হয়েছে এই কাণ্ডকারখানা। এখনও চলছে সেটা, হয়তো ভবিষ্যতেও চলবে। বঙ্গবন্ধুর পরে এমন রাজনৈতিক নেতা তো আমরা পাইনি, যার রক্ত গরম করা ভাষণ শুনতে লোকে ভীড় জমাবে মাঠে ময়দানে। কিন্ত এই দেশে এমন একজন মানুষ ছিলেন, যার ভাষণ শুনতে লোকে তাকে টাকা দিয়ে ভাড়া করে আনতো! এলাকার মানুষ নিজ খরচায় যার হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিল, উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তাকে বিজয়ী করে এনেছিল!

অদ্ভুত এই মানুষটির নাম ছয়ফুর রহমান। তবে তার এলাকা সিলেটের মানুষ তাকে ছক্কা ছয়ফুর নামেই চেনেন। একদম সাদামাটা সাধারণ মানুষ ছিলেন ছয়ফুর রহমান। বাড়ি ছিল সিলেটের সালুটিকর নামের একটা গ্রামমতো জায়গায়। পেশায় ছিলেন বাবুর্চী, তাও যে জগদ্বিখ্যাত বাবুর্চি ছিলেন তাও নয়, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়- এমন ছিল সংসারের হালচাল। জমানো টাকা দিয়ে কয়েকটা রিক্সা কিনেছিলেন, সেগুলো ভাড়ায় দিতেন, সেখান থেকেও অল্পকিছু টাকা আসতো।

তবে এই সাধারণ মানুষটার ভেতরেও কিছু অসাধারণত্ব লুকিয়ে ছিল। দারুণ বক্তৃতা দিতে পারতেন তিনি, একদম খাস সিলেটি ভাষায় জমিয়ে ভাষণ দিতেন, সেই ভাষণ অগ্রাহ্য করে হেঁটে চলে যাবে, এমন মানুষ ছিল না তখন। হয়তো চালের দাম চার আনা বেড়েছে, বাসভাড়া এক পয়সা বেশি নিয়েছে কন্ডাক্টর, সঙ্গে সঙ্গেই ছয়ফুর রহমান একটা হ্যান্ডমাইক নিয়ে সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে দাঁড়িয়ে এই 'দুঃশাসন আর নৈরাজ্যের' বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়া শুরু করে দিয়েছেন! রোদ-ঝড়-বৃষ্টি কোনকিছুই ঠেকাতে পারতো না তাকে!

ছয়ফুর রহমান প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে। সিলেট তো বটেই, দেশের মানুষও তার নাম শুনে অবাক হয়েছিল তখন, এই পাগলটা আবার কে- এরকমটা ভেবে। তবে তাতে ছয়ফুর রহমানের কোন বিকার ছিল না। আটজন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর মধ্যে অষ্টম হয়েছিলেন তিনি। এলাকার লোকে সেটা নিয়ে মজা করলে তিনি জবাব দিতেন- "আমি হইলাম এই দেশের আট নম্বর পেরসিডেন্ট(প্রেসিডেন্ট)। আমার আগের সাতজন মইরা গেলে আমিই তো পেরসিডেন্ট হমু!"

নির্বাচন করার শখ ছিল তার। অনেকে অবশ্য পাগলামীও বলেন এটাকে। উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচন বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সব জায়গাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ছয়ফুর রহমান। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে যাবার পরে আবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পদেও নির্বাচন করেছেন, এসব নিয়ে কোন বাছবিচার ছিল না তার কাছে। ছড়া বানিয়ে বক্তৃতা দিতেন, লোকে শুনে হেসে গড়িয়ে পড়তো। মজার সব কথা তো বলতেনই, মজার কাণ্ডকীর্তিও করতেন ছয়ফুর রহমান। ভাষণ শেষ করে একটা কাপড় বিছিয়ে দিতেন মাটিতে, বলতেন- "এতক্ষণ আপনাগো কথা হুনাইলাম, এখন আমার মাইকের খরচ দেন।"

আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, মাইকের খরচের টাকাটা প্রতিদিনই উঠে যেত, বরং বেশিই উঠতো। লোকজন তাকে খালি হাতে ফেরায়নি কোনদিন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে ছয়ফুর রহমান একটা বইও লিখেছিলেন, নাম ছিল- 'বাবুর্চী যখন রাষ্ট্রপতি হতে চায়'। এই নির্বাচনের আগে নিয়ম অনুযায়ী সব প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকেই দুজন করে নিরাপত্তাকর্মী দেয়া হয়েছিল সঙ্গে। ছয়ফুর রহমান সঙ্গে গার্ড রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, বলেছিলেন- "দুইটা হাতি পোষার সামর্থ্য আমার নাই!" তবুও নির্বাচনের আগে কয়েকটা দিন এই দুইজন পুলিশ সবসময় তার সঙ্গে সঙ্গে থাকতো। ছয়ফুর রহমান রিক্সা চড়ে কোথাও যাচ্ছেন, পুলিশ দুজনকেই দেখা যেতো তার দুইপাশে বসে আছেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি, নিজের এই পরিচয়টা খুব গর্বের সাথেই দিতেন। সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতিও ছিলেন তিনি।

১৯৯০ সালে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হলেন ছয়ফুর রহমান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হেভিওয়েট প্রার্থীরা তাকে গোনাতেই ধরেননি। তখন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দেশ উত্তাল, সময় খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। ছয়ফুর রহমানের অদ্ভুত ভাষণ মনে ধরলো সিলেটের মানুষের। তার পথসভাগুলোতে ভিড় বাড়তে থাকলো ধীরে ধীরে। এরই মধ্যে একদিন এরকম একটা পথসভা থেকে ভাষণ দিয়ে ফেরার পথে তার ওপরে হামলা চালালো প্রতিপক্ষের গুণ্ডারা। পরদিন সবাই জানলো, ছয়ফুর রহমানকে মারধর করা হয়েছে। খবরটা শুনে ভীষন বিরক্ত হলো সিলেটের জনগণ। একটা মানুষ কারো সাতে নেই পাঁচে নেই, তাকে এভাবে মারার মানে টা কি?

হুট করেই জনসমর্থনের পাল্লাটা ছয়ফুরের দিকে ভারী হয়ে গেল। এলাকার লোকজন নিজেরাই চাঁদা তুলে চালাতে লাগলেন ছয়ফুরের প্রচারণা। পোস্টার লাগানো হলো, দেয়ালে দেয়ালে চিকা মারা হলো 'ডাব মার্কায়' ভোট চেয়ে। পাড়ায় পাড়ায় গঠিত হলো নির্বাচনী প্রচারণার ক্লাব। ছয়ফুর জানেনও না এত কিছু। তাকে বক্তৃতা দেয়ার জন্যে ডাকতে এলে তিনি উল্টো টাকা দাবী করে বসলেন, বললেন- "আমি যে তোমরারে কথা শুনামু, আমার ঘর চলবো ক্যামনে?" লোকজন তাকে টাকা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে যেতে লাগলো পাড়ায় পাড়ায়! বাংলাদেশে এমন অদ্ভুত দৃশ্য কবে কে দেখেছে? একজন প্রার্থীকে ভোটারেরা পকেটের টাকা খরচ করে বক্তৃতা দেয়ার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে! জেলার মুক্তিযোদ্ধা হাইকমান্ড তাদের কার্যালয়টাকে ছয়ফুর রহমানের অস্থায়ী নির্বাচনী কেন্দ্র বানিয়েছিল, সেখান থেকেই সবকিছু তদারকি করা হতো।

ভোট হলো, ফল বেরুলো, আওয়ামীলীগ আর জাতীয় পার্টির হেভিওয়েট সব প্রার্থীদের হারিয়ে নির্বাচনে জিতে চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন ছয়ফুর রহমান! নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বিশ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলেন তিনি। এলাকায় শুরু হলো বিজয় মিছিল। শূন্য থেকে শিখরে ওঠার অদ্ভুত একটা গল্প লেখা হলো। লোকজন তাকে ডাকা শুরু করলো ছক্কা ছয়ফুর নামে। রাজনীতির মাঠে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছক্কাই তো হাঁকিয়েছিলেন তিনি! ছয়ফুরের ভাষায়- "নব্বইয়ের উপজেলা নির্বাচনে তো আমি ওভার বাউন্ডারি মারছিলাম। সিলেটের সব জনপ্রিয় প্রার্থীরে হারাইয়া আমি হিট। ইতা দেখিয়া কোন পাবলিকে আমার নামের লগে ছক্কা লাগাই দিছইন। তয় এতে আমি খুশি।"

পাঁচ বছর মেয়াদ থাকলেও, মাত্র একুশ মাস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন ছয়ফুর রহমান। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে উপজেলা পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করলে শেষ হয় সিলেট সদর উপজেলায় তার শাসনামল। যে কয়দিন ক্ষমতায় ছিলেন, ছয়ফুর রহমান চেষ্টা করেছেন মানুষের জন্যে কাজ করার, নির্বাচনী ওয়াদাগুলো পূরণ করার। হুট করেই কোন প্রাইমারী স্কুল পরিদর্শনে চলে যেতেন, শিক্ষক বা কর্মচারী কাউকে অনুপস্থিত দেখলেই শোকজ করে দিতেন। নিজে শিক্ষিত ছিলেন না, স্কুল কলেজের দোরগোড়ায় পা পড়েনি, তবুই তিনি শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতেন। ইউনিয়ন পরিষদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের তোপের মুখে পড়েছিলেন।

নিজের একটা রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিলেন ছয়ফুর রহমান, তবে সেই দলের সদস্য শুধু তিনিই ছিলেন, আর কাউকে নেয়া হতো না দলে। তার ভাষায়, দলের সমর্থক থাকতে পারবে, কিন্ত সদস্য হওয়ার দরকার নাই। একের বেশি দুইজন হলেই দল ভাঙার সম্ভাবনা থাকে। এজন্যে তিনি নিজের স্ত্রী বা পরিবারের কাউকেও নিজের দলের সদস্য করেননি! আওয়ামীলীগ বা বিএনপিতে যোগ না দিয়ে নতুন দল কেন করলেন, এই প্রশ্নের জবাবে ছয়ফুর বলেছিলেন- "সব দলই দুর্নীতির আখড়া। আমার দল অনেক বালা। চরিত্র নষ্ট করিয়া লাভ নাই। আমি অন্য দলে যোগ দিতাম কেনে? সুযোগ পাইলে আমি হাসিনা খালেদারে আমার দলে যোগ দেয়ার লাগি কইমু।"

চেয়ারম্যান পদ হারানোর পরে আরও কয়েকবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন ছয়ফুর রহমান। কিন্ত তখন নির্বাচন হয়ে গিয়েছে টাকার খেলা, সেখানে ছয়ফুর রহমানের মতো কপর্দকশূন্য মানুষেরা ছিলেন অসহায়। তার তো ভোট কেনার টাকা ছিল না, রাজনৈতিক ক্যাডার পোষার ক্ষমতা ছিল না। একটা সময়ে সেতুর টোল প্লাজায় চাকরী করেছেন, নৌকার মাঝিও হয়েছেন সংসার চালানোর জন্যে। শেষ বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন মানুষটা। অসুস্থ থাকার সময় এক সাংবাদিক খবর পেয়ে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, খোঁজ নিয়েছিলেন কেমন আছেন তিনি। ছয়ফুর রহমান আক্ষেপ করে বলেছিলেন- "খাইয়া না খাইয়া কুনোরকমে চলে। এই জাতি একটা অকৃতজ্ঞ জাতি। আমার মতো বিখ্যাত মানুষ অসুখে ভোগে আর এই জাতি কুনো খবর লয় না। ইটা জাতির দুর্ভাগ্য।" 

ছক্কা ছয়ফুর হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে। যারা তাকে দেখেছেন, তার কাণ্ডকীর্তির সাক্ষী হয়েছেন, তার গমগমে গলার জোরালো ভাষণ শুনেছেন, তারাও অনেকে এখন আর নেই। ছক্কা ছয়ফুরের মতো মানুষেরা আমাদের আশেপাশে নেই এখন আর, বরং সরকারী কয়লা বাতাসে উড়িয়ে দেয়ার মতো মানুষে ভরে গেছে চারপাশটা। এখন ছয়ফুর রহমানের মতো মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায় না, চারপাশ গিজগিজ করে ফুটেজ পাওয়ার নেশায় চা বানাতে বসে যাওয়া কিংবা বাসের হেল্পার বনে যাওয়া নেতায়। ছয়ফুর রহমান হয়তো অনেক দূর থেকে বসে দেখছেন, তাদের হাতে স্বাধীন হওয়া দেশটার এই বেহাল অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই আফসোস হয় তার। বেঁচে থাকলে তো একটা হ্যান্ডমাইক নিয়ে তিনি ঠিকই কোর্টপয়েন্টে এসে দাঁড়াতেন, গমগমে গলায় 'ভাইসব, ভাইসব!' বলে শুরু করতেন জ্বালাময়ী ভাষণ। আর আমরা হয়তো পাগলের প্রলাপ ভেবে এড়িয়ে যেতাম তাকে... 

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- আরিফ জেবতিক, আবুল কালাম আজাদ, সাপ্তাহিক ২০০০।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা