মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন ও আমাদের হিংস্র মানসিকতা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
চুরি করলে সেটার বিচারের জন্য আইন-আদালত আছে, গ্রেপ্তারের জন্য থানা-পুলিশ আছে। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে দুজন নারীর ওপর এমন বর্বর নির্যাতন চালানোর অধিকার ইউপি চেয়ারম্যানকে কে দিয়েছে?
ফেসবুকের নিউজফিডে ছবিগুলো এতক্ষণে অনেকেই দেখে ফেলেছেন, জেনেছেন ঘটনাটাও। কক্সবাজারে গরু চুরির অপবাদ দিয়ে দুই নারীকে বেঁধে তাদের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে, কয়েক দফায় পেটানোর পরে তাদের তুলে দেয়া হয়েছে পুলিশের হাতে। গুরুতর আহত অবস্থায় সেই দুই নারীকে পুলিশি প্রহরায় ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। সম্পর্কে তারা দুজন মা-মেয়ে। পুরো ঘটনায় সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার যেটা, সেটা হচ্ছে, এই দুই নারীকে পেটানো হয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতা মিরানুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে, তার নির্দেশেই মা-মেয়েকে কয়েক দফায় নির্যাতনের পর পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে!
ঘটনাটা ঘটেছে গত শুক্রবার দুপুরে, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মা-মেয়েকে বেঁধে রাস্তা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার ছবি প্রকাশিত হয়েছে আজ। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং এলাকায় ঘটেছে নির্মম এই ঘটনাটা। দুপুরে জুমার নামাজের পরে গরু চোর আখ্যা দিয়ে তাদের আটক করা হয়, তারা নাকি ভাড়া করা সিএনজির পেছনে গরু নিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল! আটকের পরে সেখানেই একদফা মারধর করা হয় তাদের, এরপর চেয়ারম্যানের নির্দেশে বেঁধে নিয়ে আসা হয় তার কার্যালয়ে। সেখানে আরেক দফা বেধড়ক পেটানো হয় দুজনকে, জনসম্মুখেই।
চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম নিজেই দুজনকে মারধর করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা। দুই দফা মারধরের পর মা-মেয়ের অবস্থা আআশংকাজনক হয়ে পড়লে চেয়ারম্যানের নির্দেশে পুলিশে খবর দেয়া হয়, চকরিয়া থামা থেকে পুলিশ এসে মা-মেয়েকে উদ্ধার করে, আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাদের। এখনও তারা হাসপাতালেই ভর্তি আছেন, তাদের শারীরিক অবস্থা আশংকামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
একজন জনপ্রতিনিধি, তিনি জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন নাকি হননি সেটা জানার আগ্রহ আমাদের নেই- সেই লোক কি করে দুজন মহিলাকে নিজের কার্যালয়ে বেঁধে পেটাতে পারেন? ধরে নিলাম এই মা-মেয়ে গরু চুরি করার চেষ্টা করেছিল, কিংবা আগেও চুরি করেছিল, সেটার বিচারের জন্য আইন-আদালত আছে, গ্রেপ্তারের জন্য থানা-পুলিশ আছে। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে দুজন নারীর ওপর এমন বর্বর নির্যাতন চালানোর অধিকার চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলামকে কে দিয়েছে?
নির্যাতিতা দুই নারীর বিরুদ্ধে গরু চুরির দায়ে মামলা হয়েছে, তাদেরকে পুলিশের হাতেও তুলে দেয়া হয়েছে- আইন তাদের বিচার করবে, তারা দোষী হলে শাস্তি পাবেন। কিন্ত তদন্ত বা দোষী প্রমাণের আগেই তাদের ওপর যে নির্যাতনটা চালানো হলো, যে অত্যাচারের শিকার তারা হলেন, সেটার বিচার কে করবে? রাষ্ট্র কি এই নির্মম ঘটনার সাথে জড়িত থাকা অমানুষগুলোকে খুঁজে বের করবে? সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কি নিরপেক্ষ তদন্ত করে চেয়ারম্যান মিরানুলের অপরাধ খুঁজে পেলে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বহিস্কার করবে? এমন হিংস্র মানসিকতার একজন লোক কি করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি হন, জনপ্রতিনিধিও হয়ে যান, সেটা কি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে দলটা?
মধ্যযুগে ইউরোপে নারীদের 'ডাইনী' আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হতো। ফরাসী বীর তরুণী জোয়ান অব আর্ক সহ অনেকেই এই হিংসার বলি হয়েছেন। জোয়ানের কথাটা শুধু উদাহরণের জন্যেই টেনে আনলাম। ইউরোপ সভ্য হয়ে গেছে, অসভ্য রয়ে গেছি আমরা। আজও কোথাও চোর ধরা পড়লে আমরা গণপিটুনি দেই, ডাকাত ধরতে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলি, কারণ আইনের শাসন আর বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নেই, সবাই তাই ইনস্ট্যান্ট বিচারক সেজে যে কাউকে অপরাধীকে সাব্যস্ত করে বিচার করে ফেলতে চায়! এই সাইকোলজিটা দিনকে দিন আমাদের পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ আমরা হেঁটে চলেছি অন্ধকারের দিকে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে যখন সারাদেশ উত্তাল, ক্রসফায়ারের নামে হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবী উঠছে সর্বত্র, তখন চকরিয়ার এই নির্যাতনের ঘটনাটা বুঝিয়ে দিলো, পুলিশ, র্যাব বা ইউনিফর্মড কোন বাহিনীই শুধু নয়, ক্ষমতা পেলে আমরা জনগনও পিশাচ হয়ে উঠতে সময় নেই না একদমই। নিজেদের আক্রোশ নিরীহ মানুষের ওপর ঝাড়তে দ্বিধা করি না একটুও। এত এত পিশাচের ভীড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ক্রসফায়ারের দিকে আঙুল তোলাটাও মাঝেমধ্যে হিপোক্রেসি বলে মনে হয়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন