
দূরত্ব যতই হোক, মাত্র ৫টাকা ভাড়ার বিনিময়ে বাসগুলোতে চড়ে নিরাপদে বাসে যাতায়াত করবে শিক্ষার্থীরা। কিন্ত চালু হবার মাত্র তিন দিনের মাথায় লোকাল বাসে পরিণত হয়েছে সেগুলো, বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব তো আর বদলানোর নয়।
প্রত্যেক বাবা-মায়ের ইচ্ছা থাকে সন্তানকে আকাঙ্ক্ষিত বিদ্যালয়ে ভর্তি করার। তাদের এই ইচ্ছা পূরণ করতে প্রতিদিন অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয় হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে, যেখানে অধিকাংশই যাতায়াত করে পাবলিক বাসে। আর বাসে যাতায়াত করতে গিয়ে যে হেনস্থার শিকার হয় তারা, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারেন যারা প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করেন। সময়মতো পৌছানোর তাড়ায় চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয় অজস্র শিক্ষার্থী, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও অসংখ্য। এছাড়া মেয়ে শিক্ষার্থী যারা আছে, বাসে যৌন হয়রানির আশংকায় তটস্থ তো থাকেই। সেই উদেশ্যেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিআরটিসির উদ্যোগে শহরে নামানো হয়েছিল দশটি বাস, দূরত্ব যতই হোক, মাত্র ৫টাকা ভাড়ার বিনিময়ে সেগুলোতে চড়ে নিরাপদে বাসে যাতায়াত করবে শিক্ষার্থীরা। কিন্ত চালু হবার মাত্র তিন দিনের মাথায় লোকাল বাসে পরিণত হয়েছে সেগুলো, বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব তো আর বদলানোর নয়।
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় চট্রগ্রামের শিক্ষার্থীরা ৯টি দাবি উত্থাপন করেছিল, যার মধ্যে ১টি ছিল স্কুলবাস চালু করার। তখন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বিআরটিসি বাস বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দেন। গত বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য ১০টি দ্বিতল বাস বরাদ্দ ঠিকই করে বিআরটিসি, তবে পরিচালন ব্যয়সহ নানা জটিলতার কারণে সার্ভিস চালু করতে পারছিল না সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু 'জিপিএইচ ইস্পাত' তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বাস সার্ভিসের পৃষ্ঠপোষকতায়, ফলস্বরূপ গত রবিবার, ২৬ জানুয়ারি থেকে চালু হয় বাস সার্ভিসটি। ধারণা করা হচ্ছে- প্রতি মাসে এইসব বাস থেকে ৪ লাখ টাকা আয় হতে পারে, যেখানে ব্যয় হবে প্রায় ৯ লাখ টাকা। ব্যয়ের ঘাটতি পুরণ করতে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের সাথে চুক্তি হয়েছে, প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দেবে প্রতিষ্ঠানটি৷

বাসগুলো চলাচলের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে স্কুলের সময়সূচির সাথে মিল রেখে, মর্নিং ও ডে শিফটের জন্য রয়েছে আলাদা বাস সার্ভিস। নগরীর প্রধান দুটি রুটে স্কুল ও মাদ্রাসার দশম শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলাচল করবে বাসগুলো, যেখানে নিচতলায় বসবে মেয়ে শিক্ষার্থী আর উপরের তলায় ছেলে শিক্ষার্থী। বাস চালনায় ড্রাইভার ছাড়াও শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য প্রতিটি বাসে থাকবে একজন মহিলা ও একজন পুরুষ হেলপার। আর ভাড়া প্রদানের জন্য বাসের প্রথমে এবং শেষে থাকবে দুটি 'সততা বাক্স', যেখানে শিক্ষার্থীরা ভাড়ার টাকা জমা রাখবে।
নিঃসন্দেহে দারুণ উদ্যোগ এটি, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন এখানে দৃষ্টান্তমূলক একটি উদাহরণ স্থাপন করলেন। তিনি দেখালেন, আমাদের সমাজের ক্ষমতাসীন যারা আছেন, তারা চাইলে অনেক কিছুই সম্ভব। সদিচ্ছা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করলে প্রধানমন্ত্রী যে ফিরিয়ে দেন না কাউকে, এটিরও একটি চমৎকার উদাহরণ হয়ে থাকবে এই ঘটনাটি।
যেখানে বিদ্যালয়ে পৌছুতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হত, যাতায়াত খরচও অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ছিল, সেখানে স্বল্প খরচে এত ভাল সার্ভিস অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনে। আবার যেসকল চাকরীজীবি বাবা-মা সন্তানকে বিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করতে পারতেন না, তারাও এখন নিশ্চিন্তে থাকবেন।
কিন্তু পচে যাওয়া সমাজে ভাল কোনো পরিবর্তন কি এত সহজে আসে? চালু হওয়ার পর দুইদিন নিয়ম মেনে ঠিকভাবেই চলছিল বাসগুলো। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরাও অনেক স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু এই সার্ভিস চালু হওয়ার তৃতীয় দিনই, অর্থাৎ ২৮ তারিখেই ঘুনে ধরা সমাজের প্রতিফলন দেখা গেল, শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ করা বাসগুলোতে নিয়মের তোয়াক্কা না করে সাধারণ যাত্রীদের তোলা শুরু করেছে ড্রাইভার-হেলপাররা। সরকার থেকে নির্ধারিত বেতন পাওয়ার পরেও লোভের বশবর্তী হয়ে হয়ে তারা এই দুর্নীতিতে লিপ্ত হচ্ছে।

এত চমৎকার একটি উদ্যোগ নষ্ট সমাজ ব্যবস্থার কাছে এভাবে হেরে যাবে, তা মোটেও কাম্য নয়৷ অসাধু ড্রাইভার-হেল্পারদের শাস্তির ব্যবস্থা করে বাস সার্ভিসটি যাতে পুনরায় চালু হয়, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষর দ্রুত নজর দেওয়া উচিত।
শুধু চট্রগ্রাম নয়, প্রত্যেক জেলায় জেলায় শিক্ষার্থীদের জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা নিরাপদে যাতায়াত করবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এবং তাদের নীতিগত চর্চাও বজায় থাকবে 'সততা বাক্স' ব্যবহারের মাধ্যমে। এর চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে?