নিঃশব্দে দান করতে ভালোবাসেন তিনি, এমন সর্তক গোপনীয়তার সাথে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা দান করেন যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। তার লক্ষ্য হচ্ছে তিনি এভাবেই দান করতে করতে নিঃস্ব এবং দেউলিয়া হয়ে মারা যাবেন একদিন!

নিঃশব্দে দান করতে ভালোবাসেন তিনি, এমন সর্তক গোপনীয়তার সাথে হাজার হাজার কোটি টাকা দান করেন যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। তার লক্ষ্য হচ্ছে তিনি এভাবেই দান করতে করতে নিঃস্ব এবং দেউলিয়া হয়ে মারা যাবেন একদিন! লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই মহান দানবীরের নাম চাক ফিনি। তিনি পৃথিবীর অন্যতম সেরা ধনী, একজন আইরিশ আমেরিকান বিলিওনিয়ার বিজনেসম্যান। 

অথচ ১৯৯৭ সালের আগে কেউই জানতেই পারেননি এই অসামান্য দাতার কথা। কারণ চাক ফিনি এতটাই প্রচারবিমুখ যে, কোনও প্রচার তো দূরের কথা, তিনি তার দানের কোনও প্রমাণও রাখতেন না। কিন্তু ১৯৯৭ সালে এক ব্যবসা সংক্রান্ত মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত বেরিয়ে পড়ে চাক ফিনির অবাক দানের ইতিহাস। বেরিয়ে পড়ে যে তার ফাউন্ডেশন আটলান্টিক ফিলানথ্রপিজের মাধ্যমে তিনি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দান করে চলেছেন গোপনে, নিঃশব্দে।

তার জন্ম আমেরিকার নিউ জার্সিতে ১৯৩১ সালের ২৩শে এপ্রিল। তার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন নর্দান আয়ারল্যান্ড থেকে। তার উত্থান হয়েছিল মূলত কোরিয়ান যুদ্ধের ভূমধ্যসাগরে মার্কিন নৌ-সেনাদের কাছে ডিউটি-ফ্রি মদ বিক্রি করে। তার এই কনসেপ্টই পরর্বর্তীতে ডিউটি-ফ্রি শপিংকে জনপ্রিয় করে এবং এটি বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি। তিনি ছিলেন ডিউটি-ফ্রি শপার গ্রুপের কো-ফাউন্ডার। 

১৯৮২ সালে ফিনি ‘দ্য আটলান্টিক ফিলানথ্রপিজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে ডিউটি-ফ্রি শপার গ্রুপে থাকা তার ৩৮.৭৫% শেয়ার, অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার গোপনে ট্রান্সফার করে দেন আটলান্টিক ফিলানথ্রপিজে, এমনকি তার ডিউটি-ফ্রির পার্টনাররাও জানতেন না যে ডিউটি-ফ্রি শপে তার আর কোনও মালিকানা নেই। তারপর থেকেই এই আটলান্টিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে চাক ফিনি দান করতে শুরু করেন। পূর্বপুরুষের জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে বেনামে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার দান করেছেন চাক ফিনি। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং নাম না জানতে পারা আরও অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার দান করেছেন তিনি। 

চাক ফ্রিনিকে ডাকা হয় "দানশীলতার জেমস বন্ড' নামে!

তাকে বলা হয় দানশীলতার জেমন্স বন্ড। অর্থাৎ ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট জেমস বন্ডের মতই তিনি গোপনে লোকচক্ষুর অন্তরালে হাজার হাজার কোটি ডলার দান করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। গত ৩০ বছর ধরে তার ডিউটি ফ্রি শপ সাম্রাজ্য থেকে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য এবং অনুদান পৃথিবীর অসংখ্য রাষ্ট্র এবং সংস্থার কাছে পৌঁছাবার লক্ষ্যে কাজ চলছে। তার ফাউন্ডেশন আটলান্টিক ফিলান্থ্রফিজ যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, বারমুডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলোতে গরীব ও দুস্থ জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান, বার্ধক্য এবং সামাজিক অধিকার ইত্যাদি খাতে প্রায় ইতিমধ্যে ৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। আর বাকি ১ বিলিয়ন ডলারও এ বছরের মধ্যেই ব্যয় করার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। তার মত এমন ধনী আর কেউ এভাবে উদারহস্তে এত দান এবং এত খরচ করেননি।

যখন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিমুহুর্তেই প্রচুর মুনাফা আরো বিলিয়নিয়ার তৈরির অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তখন মানুষের কল্যাণে চুপচাপ দু'হাতে টাকা খরচ করে ফিনি যেন মরতে চাইছেন দেউলিয়া হয়ে। কেন তিনি এভাবে ডিউটি ফ্রি শপের মালিকানা আটলান্টিক ফিলান্থ্রপিস্টে ট্রান্সফার করলেন জানতে চাওয়া হলো, তখন ফিনি বলেছিলেন,

"আমার মনে হয়েছে, কারো যদি নিজের মালিকানায় প্রচুর সম্পদ থাকে, তাহলে সে সবসময় সেই সম্পদ রক্ষায় তটস্থ থাকবে, দুশ্চিন্তায় ভুগবে। অথচ সেই সম্পদ কারো কোন উপকারে আসবে না। তাই আমি এমন একটা ব্যবস্থার কথা ভেবেছি, যাতে আমিও শান্তিতে থাকতে পারি আর মানুষও উপকৃত হয়। আমার মনে হয় আমি তখনই সবচেয়ে সুখী হই, যখন আমার কোন কাজে মানুষ উপকার পায়, আর প্রচণ্ড অশান্তিতে থাকি যদি আমার কাজে মানুষের উপকার না হয়।"

ফিনি সবসময় বড় বড় সমস্যাগুলোতে বড় অংকের অর্থ সাহায্য হিসেবে দিয়েছেন। যেমন নর্দান আয়ারল্যান্ডে অব্যাহত সহিংসতা বন্ধ করে অবস্থা স্থিতিশীল করা, ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আধুনিকায়ন, অথবা নিউইয়র্কের অবহেলিত রুজভেল্ট আইল্যান্ডে প্রায় সাড়ে তিনশো মিলিয়ন ডলারের অনুদান দিয়ে সেটাকে টেকনোলজি হাব হিসেবে তৈরি করা কিংবা সারা বিশ্বে ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করা ইত্যাদি নানা বড় বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ভবিষ্যৎ সমস্যা সমাধানে সম্পদের লিগ্যাসী ফান্ডে বাৎসরিক ছোট ছোট অনুদানে নামকাওয়াস্তে সাহায্য দেবার অপেক্ষা করেননি। 

বিল গেটসের সঙ্গে চাক ফ্রিনি

তিনি তার যাবতীয় সম্পদ আজকে এখনই বর্তমান সমস্যা সমাধানে খুরচ করতে চেয়েছেন সবসময়; এবং সেটা একেবারেই নীরবে! কখনও খ্যাতির মোহ চাননি, চাননি দানবীর হিসেবে প্রশংসা কিংবা লাইমলাইটের আলো। বরং তার ফাউন্ডেশনকে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিলেন বারমুডায়, যেন আমেরিকার ফিলানথ্রপি ফাউন্ডেশনের তালিকায় তার আটলান্টিক ফাউন্ডেশনের নাম না আসে। কারণ তার লক্ষ্য শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণ। আর সে কারণেই তার অর্জিত অজস্র সম্পদ পৃথিবীর এত বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি দান করেছেন- তার একটা লিস্ট দেখিয়ে এক সাংবাদিক বলেছিলেন, আপনি কি এই লিস্টখানা দেখেছেন, এ পর্যন্ত আপনি কত বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছেন? জবাবে মিঃ ফিনি হেসে বলেছিলেন-

যারা দান করে তারা লিস্ট তৈরি করে না, আর যারা লিস্ট তৈরি করে তারা দান করে না।

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী চাক ফিনির কোনও পার্সোনাল গাড়ি নেই, কোন ঝাঁ-চকচকে বাড়ি নেই। চলেন ট্যাক্সি আর কোচে, থাকেন সানফ্রান্সিসকোর একটা সস্তা দরের ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে, আর খান সাধারণ বার্গার। জীবনে আজ পর্যন্ত ৯ বিলিয়ন ডলার দান করা চাক ফিনির সঞ্চয় মাত্র ২ মিলিয়ন ডলার। ৮৯ বছরের ফিনে জীবনযাত্রার মানও খুবই সাধারণ। সান ফ্রান্সিসকোর একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রীয়ের সঙ্গে থাকেন তিনি। নিজের গাড়িও নেই তাঁর। এক জোড়া জুতোতেই বছর কেটে যায় তাঁর। ‘সম্পদ দায়িত্ব আনে’- এই চিন্তা থেকেই নিজের সম্পত্তি দান করে সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

সস্তা মোহ আর খ্যাতির লোভে সর্বত্র যখন লোকদেখানো দাতার সংখ্যা বেড়ে গেছে, সবাই যখন ১০ টাকা দান করেও ক্রেডিট নিতে ব্যস্ত, তখন চাক ফিনির মতো এমন প্রচারবিমুখ দানবীরেরা আমাদের অসামান্য অনুপ্রেরণা, অনুকরণের পাত্র। আমরা কি সস্তা খ্যাতি আর ক্রেডিট নেওয়ার ধান্দা থেকে বেরিয়ে এসে কখনো কি চাক ফিনির মতো এমন নির্লোভ দানবীর হতে পারব?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা