ধূমপান খারাপ মানে সেটা নারী-পুরুষ সবার জন্যেই খারাপ। কিন্ত টার্গেট করে একজন নারীকে আক্রমণ করার মানে একটাই- নারীর হাতে সিগারেটটা মেনে নিতে পারছে না আপনার ঈর্ষান্বিত মন। কে জানে, টাকা আর ইচ্ছের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এদেশে সিগারেট কেনার জন্য হয়তো পুরুষাঙ্গেরও প্রয়োজন হবে...

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক, ধূমপান ক্যান্সারের কারন- সিগারেটের প্যাকেটের ওপরেই লেখা থাকে লাইনগুলো। কখনও 'সিগারেট শুধু নারীদের জন্য ক্ষতিকারক' কিংবা 'নারীরা ধূমপান করলে ক্যান্সার হয়' টাইপের কিছু লেখা থাকতে দেখিনি। তবে আসছে দিনগুলোতে সিগারেটের প্যাকেটে 'শুধু পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য' টাইপের কিছু লেখা থাকলেও অবাক হবো না। 

সিগারেট খাওয়াটা ভালো কিছু নয়। স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়, পরিবেশের জন্যেও ভালো নয়। তবুও সিগারেট বা তামাকজাত পণ্যে বাজারটা এদেশে যথেষ্ট বড়। প্রায় প্রতি বছরই বাজেটে সিগারেটের দাম বৃদ্ধি করা হয়, তবুও ক্রেতার পরিমাণ কমছে না, বরং বাড়ছে। এর কারন কি- সেদিকে না গিয়ে আপনাদের বরং প্রশ্ন করি- সিগারেট কিনতে কি লাগে? সিগারেট খাওয়ার জন্যেই বা কি লাগে? ইচ্ছা আর টাকা- এই দুটোই তো? উত্তর হচ্ছে- না। সিগারেট কেনার জন্য, ধূমপান করার জন্য সবচেয়ে জরুরী যে জিনিসটা, সেটা হচ্ছে পুরুষাঙ্গ। এই জিনিস যদি আপনার না থাকে, তাহলে সিগারেট হাতে নেয়ার অধিকার আপনার নেই। 

ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও নিশ্চয়ই আপনারা দেখেছেন। বন্ধুর সঙ্গে বসে রাস্তার পাশে ধূমপান করছিলেন এক তরুণী। সেই দৃশ্য দেখে টিপিক্যাল ঈর্ষাপরায়ণ এক ভেতো বাঙালীর আঁতে ঘা লেগে গেছে। মেয়ে হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে, এটা কি মেনে নেয়া যায়? ঘুষ-দুর্নীতি-অপরাজনীতি মেনে নেয়া যায়, ধর্মান্ধতা-অশিক্ষা-গণপিটুনি থেকে শুরু করে যাবতীয় কুকর্ম সহ্য করা যাবে, কিন্ত শাড়ি পরে একজন তরুণী রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে, এই বেলেল্লাপনা কীভাবে মেনে নেয়া সম্ভব? 

সেই সমাজ সংস্কারক লোকটি তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গেলেন সমাজকে পাপাচার এবং ধ্বংস হবার হাত থেকে রক্ষা করতে। তার সঙ্গে জুটে গেল তারই সমমনস্ক একটা দল। এরাই তো বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ,  একপাল শুওর যেভাবে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে কাদায় লুটোপুটি খায়, একদল হায়েনা যেভাবে শিকারের ওপর ঝাঁপায়, ঠিক সেভাবেই এরা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্বি তরুণী ও তার বন্ধুর ওপর। নীতিজ্ঞানের বহর বইয়ে দিতে গেছে, মেয়ে হয়ে সিগারেট খাওয়া কেন উচিত নয়- দিয়েছে সেই অমূল্য বাণীও। এরা কেউ প্রকাশ্যে ধূমপানের বিরোধিতা করেনি, করেছেন 'একজন নারীর প্রকাশ্যে ধূমপানের' বিরোধিতা। প্রকাশ্যে ধূমপানটা তাদের চোখে সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে কাজটা করেছেন একজন নারী, সেটাই তারা মেনে নিতে পারেনি। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের চোখে নিকোটিন জিনিসটাই ক্ষতিকর। সেটা একজন পুরুষের জন্য যতটা ক্ষতিকর, একজন নারীর জন্যেও তা। কিন্ত রাজশাহীর সেই সমাজ সংস্কারক লোকগুলোর কথা হচ্ছে, পুরুষেরা চাইলেই সিগারেট খেতে পারে, কিন্ত নারীরা কেন সিগারেট খাবে? এই অধিকার তো তাদের নেই। নারী কি করতে পারবে আর কি করতে পারবে না, নারীর কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়, নারীর কেমন পোশাক পরা উচিত আর কেমনটা পরা উচিত নয়, কিভাবে একজন নারীর কথা বলা বা চলাফেরা করা উচিত আর কীভাবে নয়- এই নিয়ে সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নারী যতটা না ভেবেছে, পুরুষ জাতি এই বিষয়ে এরচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করেছে, আজও করছে। নইলে কি আর রাস্তার পাশে বসে সিগারেটে সুখটান দেয়া তরুণীকে দেখে পুরুষের মেজাজ সপ্তমে চড়ে? 

সমাজ সংস্কারমূলক কার্যক্রম চলছে

প্রকাশ্যে ধূমপান ব্যাপারটা জঘন্য, কোন সন্দেহ নেই। ধূমপান ব্যাপারটাই খারাপ। আপনি নিজের টাকায় বিষ কিনে খান, কোন সমস্যা নেই। কিন্ত আশেপাশের মানুষকে বিরক্ত করার কোন অধিকারও তো আপনার নেই। ডিসক্লেইমারটা দিয়ে রাখলাম, যদি কারো মনে হয় এই লেখাটায় কোথাও প্রকাশ্যে ধূমপান বা ধূমপানকে সমর্থন করা হচ্ছে- এজন্য। এই লেখা কোনোকিছুর সমর্থনে নয়, বরং শুধু নারী হবার কারনে কেন একজন ধূমপায়ীকে হেনস্থার শিকার হতে হবে- সেই প্রশ্নটা তোলার জন্য। 

আমি নির্দ্বিধায় মেনে নিতে রাজী যে প্রকাশ্যে ধূমপান করে সেই তরুণী অপরাধ করেছেন। এবং প্রচলিত আইনে এর শাস্তিও হওয়া উচিত। কিন্ত তাকে যেভাবে বাধা দেয়া হয়েছে, যেভাবে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে, যে ভাষায় সেই তরুণীকে হুমকি দেয়া হয়েছে, সেটা নারী নির্যাতন। মানুষের চেহারা নিয়ে সেখানে দাঁড়ানো একটা হায়েনা সেই তরুণীকে বলেছে- 'এখন রাস্তায় সিগারেট খাচ্ছেন, পরে ধর্ষণ করলে তো বলবেন ছেলেদের দোষ!' এই অমানুষটাকে তার জন্মদাত্রী মা এই শিক্ষাটা দিতে পারেনি যে, একজন নারী রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করলেই তাকে ধর্ষণ করার লাইসেন্স পাওয়া যায় না। 

আমি কখনও দেখিনি এভাবে দশ-বারোজন মিলে একজন পুরুষ ধূমপায়ীকে ঘিরে ধরেছে, তাকে সিগারেট ফেলে দিতে বাধ্য করেছে, কিংবা তার গায়ের ওপর উঠে পড়তে চাইছে। আমি।কখনও দেখিনি একজন পুরুষ ধূমপায়ীকে বলা হচ্ছে- আপনাকে দেখে তো এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাবে! সেই তরুণীকে কিন্ত বলা হয়েছে, তাকে দেখে নাকি এলাকার মেয়েরা 'খারাপ' হয়ে যাবে! এদেশের পুরুষের চোখে যে নারী ধূমপান করেন, তিনি খারাপ। তবে পুরুষ ধূমপান করলে কোন সমস্যা নেই, যেহেতু জন্মসূত্রে তার একটি পুংদণ্ড আছে, এবং সিগারেটের আকারও যেহেতু দণ্ডাকৃতির, তাই সিগারেট খাওয়ার জন্য তাকে কোন স্পেশাল পারমিট নেয়া লাগে না। 

মোটাদাগে বেশিরভাগ বাঙালি পুরুষের চিন্তাভাবনার পাটার্নটা খুব অদ্ভুত। নিজেরা চাইলে লুঙ্গিতে কোঁচা মেরে খালি গায়ে বাইরে চলে যেতে পারবে, তাতে দেশ বা সমাজের কোন ক্ষতি হবে না; কিন্ত রাস্তায় টিশার্ট পরিহিত একটা মেয়েকে দেখলে তাদের ধারনা হয় এই মেয়েটার কারনে পুরো দেশ বুঝি উচ্ছন্নে গেল! তারা অবলীলায় ধর্ষণের কারন হিসেবে নারীর পোশাককে দায়ী করে, অথচ ধর্ষণের পেছনে ধর্ষকের বিকৃত মানসিকতা আর আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবটাই যে মূল কারন- এটা তারা কোনোভাবেই স্বীকার করবে না। একজন নারীকে প্যাটার্নের বাইরে চলতে দেখলে তারা স্থির থাকতে পারে না, এজন্যেই ধূমপানরত নারীকে দেখে তার দলবেঁধে হামলে পারে, কিন্ত ধূমপায়ী পুরুষের ক্ষেত্রে তাদের বিন্দুমাত্র বিকার আছে বলে মনে হয় না, তারা নিজেরাও তো এই বদভ্যাস থেকে মুক্ত নয়। 

আবারও বলছি, ধূমপান খারাপ, প্রকাশ্যে ধূমপান আরও খারাপ। কিন্ত যেটা খারাপ, সেটা তো সবার জন্যেই খারাপ হওয়ার কথা, তাই না? এখানে নারী-পুরুষের তো কোন ভেদাভেদ থাকার কথা নয়। অথচ রাজশাহীর ওই ধূমপায়ী ব্যক্তিটি নারী না হলে তাকে এই অবস্থার মুখোমুখি পড়তে হতো না, তাকে প্রকাশ্যে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে, হেনস্থার ভিডিওধারণ করে সেটা আবার ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ার দুঃসাহসও কেউ করতো না। অনেকেই এটাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ভাবতে পারেন, কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, পুরো ব্যাপারটাতে পুরুষ নামধারী কিছু কাপুরুষের ঈর্ষা আর ঘৃণা মিশে আছে। প্রকাশ্যে ধূমপানের প্রতিবাদ নয়, একজন নারীকে হেনস্থা করাটাই এই লোকগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, অন্য কিছু নয়। 

এই ঘটনায় ভিক্টিম তরুণীটির সাহস আমাক্ব মুগ্ধ করেছে, যেভাবে তিনি প্রতিবাদ করছিলেন, সেটা দেখে মনে হয়েছে, সংখ্যায় ভারী না হলে এই হায়েনাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না এই তরুণীর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার। তিনি থানায় অভিযোগ করেছেন বলে শুনেছি, চাইবো এই হেনস্থার বিচার হোক, তাকে হুমকি দেয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা প্রত্যেকটা বীরপুঙ্গবকে শাস্তির মুখোমুখি করা হোক। ঘরের খেয়ে সমাজ উদ্ধার করার নামে অন্যকে হেনস্থা এবং অপমানের শখ যাতে এদের চিরতরে মিটে যায়। সমাজটাকে এদের হাতে ছেড়ে দিলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হবে, অশান্ত এবং অনিরাপদ হবে চারপাশ- এটা যেন আমরা ভুলে না যাই...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা