হার্ট অ্যাটাক থেকে কোমায় চলে যাওয়া চৌকস এই অফিসারকে গত সাত বছর ধরে পরম যত্নে আগলে রেখেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে চলে এলো তার চাকরী জীবনের শেষ দিন। তাকে সম্মান জানানোর জন্যে সেদিন নেয়া হলো ভিন্ন এক পদক্ষেপ...

বেশ কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা খবর খুব ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজন কর্নেল, যিনি কোমায় আছেন গত সাত বছর ধরে, তাকে পদোন্নতি দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর ইতিহাসেই এই ঘটনা ঘটেছে প্রথমবার, যেখানে শারিরীক অসুস্থতার পরেও একজন মানুষকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সংবাদটি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। সামাজিক মাধ্যমে আমরা সারাদিনই তো কত গুজবই না ছড়াই! পরে জানলাম, ঘটনাটি সত্যি। এবং মনও ভালো হয়ে গেলো এই সংবাদে।

সিলেটে জন্ম নেওয়া লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা ছিলেন চৌকস একজন সেনাবাহিনী অফিসার। ১৯৮৯ সালে সাঁজোয়া বাহিনীতে কমিশন পাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি  সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছিলেন শিক্ষা পরিচালকের পদে। তিনি সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট ১২ ল্যান্সারস কমান্ডার, আর্মার স্কুল এবং ইনফ্যান্ট্রি স্কুলেরও প্রশিক্ষক ছিলেন। ইরাক-কুয়েত এবং সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও যোগ দিয়েছেন। অসামান্য অবদানের জন্য দুইবার পেয়েছিলেন 'পিস মেডেল।'

কর্নেল দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা

এই মানুষটি কর্মক্ষেত্রে এতসব ব্যস্ততার পাশাপাশিও বই লিখতেন। তার আপন বড় দাদা কিংবদন্তি হাছন রাজাকে নিয়ে বই লিখেছেন। লিখেছেন সেনাবাহিনীর ইতিহাস নিয়েও।

গত ২০১৩ সালের মার্চ মাসে, যখন তিনি শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন, হার্ট এ্যাটাক হয় তার। এরপরেই 'হাইপোস্কিক স্কিমিক ইনজুরি টু ব্রেইন ইফেক্টস' এ আক্রান্ত হয়ে চলে যান কোমায়। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে তার দেহের নীচের অংশ সজাগ থাকলেও মস্তিষ্ক ও মস্তিষ্কের কোষগুলো ছিলো নির্জীব ও কর্মক্ষমতাহীন। তাকে সুস্থ করার জন্যে অনেক চেষ্টা করা হয়েছিলো। বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, অসুস্থ হওয়ার পুরো সময়েই রাখা হয়েছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। কোনো লাভ হয়নি। তিনি সুস্থ হন নি।

এ বছরের বারোই অক্টোবর ছিলো তার চাকরী মেয়াদের শেষদিন। সেনাবাহিনী, এই লড়াকু যোদ্ধাকে সম্মান জানানোর জন্যে নিলেন এক ভিন্ন উদ্যোগ। চাকরীর শেষদিনেই তাকে 'কর্নেল' র‍্যাংকে উন্নীত করা হয়। তার  পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে হাসপাতালেই সম্পন্ন হয় পুরো প্রক্রিয়া। সিএমএইচ এর ৩১৪ নাম্বার রুমে তার ঝুলিয়ে রাখা ইউনিফর্মে পড়ানো হয় 'কর্নেল ব্যাজ'।

হাসপাতালে রাখা তার ইউনিফর্মে পড়ানো হয় 'কর্নেল' ব্যাজ

সাধারনত কোনো একজন মানুষ  তার পেশা-ক্ষেত্রে যতই দক্ষ হন না কেন, তিনি কোনো কারণে অক্ষম হলে আশেপাশের মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্র তাকে একরকম ছুঁড়ে ফেলে দেয় সবকিছু থেকে। সেরকম এক সময়ে দাঁড়িয়ে এই ভিন্নধর্মী ঘটনাটি আমাদের বুঝিয়ে দেয়, মানবিকতা এখনো আছে। যে মানবিকতা একজন অসুস্থ সেনা কর্মকর্তাকেও শেষ সময়ে এসে সম্মান জানাতে পারে, তার গোটা কর্মজীবনের অসাধারণ কাজের জন্যে। সম্মান জানানোর সেনাবাহিনীর এই সুন্দর মডেল বাকি পেশার সবাই গ্রহণ করবেন, একজন মানু্ষ অক্ষম হলেই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন না কেউ, সমাজের সবখানেই মানবিকতা ও বিবেকের এক মেলবন্ধন থাকবে... এটাই আমরা প্রত্যাশা করি সবসময়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা