বড় ড্যাগার নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে এখন একজন আরেকজনকে ধর্মের নামে খুন করে ফেলতে চায়। ওয়াজ মাহফিলে ঘৃণার চাষাবাদ। আমরা যে কোরআন পড়েছি, যে সময়ে ধর্ম চর্চা করেছি, যে সময়ে এই দেশে বেড়ে উঠেছি সেই সময় থেকে কি আজকের কোরআন আলাদা?

'বালাগাল উলা বি-কামালিহি,/কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহি,/হাসুনাৎ জামিয়ু খিসালিহি,/সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি'- 

যে কোনো মিলাদ শরীফে আমার বাবা সুউচ্চ স্বরে পাঠ করতেন শেখ সাদী সাহেবের এই নাত-ই রাসুল। আমার বাবার গলার স্বর বড় সুমিষ্ট তা বলা যায়না কিন্তু 'ইয়া নবী সালা মাইলাইকা, ইয়া হাবিব সালা মালাইকার' ঠিক পর-পর এই নাত আমার বাবা বড় উঁচু স্বরে পাঠ করতেন এবং বোধকরি এখনও করেন।

আমরা আমাদের শৈশবে বড় হয়েছি একটি লিবারেল মুসলিম পরিবারে। যেখানে ধর্ম পালনে চাপাচাপি ছিলোনা। নামাজ পড়বার জন্য চাপ ছিলোনা কিন্তু স্পস্ট নির্দেশনা ছিলো।

পঞ্চম শ্রেণীতে পড়বার সময় আমাদের শ্রদ্ধেয় হুজুর আমাদের আরবী পড়াতে আসতেন। কায়দা দিয়ে শুরু। তারপর আমপারা এবং একদিন কোরান শরীফের পাঠ ধরেছিলাম। হুজুর কোরানের বেশ কিছু আয়াত মুখস্থ করিয়েছিলেন। আজও সেসব আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। 'জালিকাল কিতাবু লা'রাইবা ফিহি হুদাল্লিল মুত্তাক্বীন'...

আমপারা ছেড়ে যেদিন প্রথম কোরআন শরীফ ধরি সেদিন মা মিষ্টি কিনে আনিয়েছিলেন। সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো হয়েছিলো। এটাই ছিলো আমাদের সময়ের প্রথা। কোরআন ধরার আগে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে হয়।

শুক্রবারের ঝলমলে রোদের সকালে আমরা ভাইবোনেরা মাথা দুলিয়ে কোরআন পাঠ করতাম, সুরে সুরে স্রষ্ঠার বন্দনা করতাম, সে ছিলো এক মায়াবী সময়।

আমরা যেই কোরআন পড়েছি বা যে কোরআনের ভিত্তিকে আমাদের ধর্মের ভিত্তি বলে মনে করেছি, সেখানে বড় একটা ড্যাগার নিয়ে এসে কাউকে কোপানোর তাগাদা পাইনি, কাউকে দুঃখ দেবার অনুপ্রেরণা পাইনি, কাউকে জোর করে ধর্ম পালন করাবার তেষ্টা জাগেনি আমার।

আমরা দূর্গাপুজোর জন্য অপেক্ষা করতাম, আমরা কালীপুজোর জন্য অপেক্ষা করতাম। অবশ্য এসব অপেক্ষা ছিলো, এর প্রতিটি সময়ে আমাদের স্কুল বন্ধ থাকবে, এই আশায়। আমরা পুজো মন্ডপে যেতাম বাবার হাত ধরে, বন্ধুদের সাথে।

কোরবানির সময়ে আমরা পাড়া বেড়াতাম কোন বাড়ি কি গরু কিনেছে দেখার জন্য। সারা রাত আমরা গরু দেখে বেড়াতাম। গরুকে ঘাস খাওয়াতাম। পরদিন গরুকে জবাই করবে, এই দুঃখে হাপুস নয়নে বালিশে মাথা রেখে কেঁদেছিও কতবার। রোজার শেষ দিনে আমরা চাঁদ দেখার জন্য বাইরে বেরোতাম। পাড়ার সকলে মিলে রাস্তায়। মনে হয় কি এক অদ্ভুত উৎসবের সময় ছিলো সেসব।

শব-ই বরাতের রাতে আমাদের প্রতিবেশীদের বাসায় আমরা ট্রে তে করে হালুয়া রুটি নিয়ে যেতাম। আমাদের বাসাতেও আসতো হালুয়া আর রুটি। গভীর রাতে মরিচাবাতি ফুটোতাম, চকলেট বোম ফুটাতাম। তারও আগে মসজিদে যেতাম নামাজে। এই ছিলো আমাদের শৈশব।

কালী পুজোতে যাওয়া যাবেনা, দূর্গা পুজোতে যাওয়া যাবেনা, এসব আমাদের কেউ বলতো না। আমার হিন্দু বন্ধু ছিলো, বৌদ্ধ বন্ধু ছিলো, খ্রিস্টান বন্ধু ছিলো। আমাদের এসবে কখনো মনে প্রশ্ন আসতোও না, আমরা এসব নিয়ে কোনোদিন ভাবিওনি।

কিন্তু আজকের এই সমাজ দেখে আমি দুঃখের ভারে নিয়ে বসে থাকি। দেশটা কেমন যেন উগ্র ইসলামি হয়ে গেছে। অনেক বড় জোব্বা পরা হেফাজতের ছেলে গুলো ইয়াবড় লাঠি নিয়ে রাস্তায় বের হয়, অনেক বড় ড্যাগার নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলতে চায়। 

সাকিবকে হুমকি দেয়া মহসিন গ্রেপ্তার হয়েছে র‍্যাবের হাতে

ওয়াজ মাহফিলগুলোতে কেবল ঘৃণা-ঘৃণা আর ঘৃণার চাষাবাদ। কথা বলার সময় এদের মুখ দিয়ে বড় বড় ফোটায় থু থু বের হয়। সেগুলো এরা আবার টিস্যু দিয়ে কিছুক্ষন পর পর মোছে। ওরা তীব্র গলায় চেঁচায়। ওরা ঘৃণার কথা বলে। হত্যা করবার কথা বলে।

আমরা যেই কোরআন পড়েছি, আমরা যেই সময়ে ধর্ম চর্চা করেছি, আমরা যে সময়ে এই দেশে বেড়ে উঠেছি সে সময় থেকে কি আজকের কোরআন আলাদা? আমাদের সময় থেকে কি ইসলামী মূল্যবোধ পালটে গেছে?

কান পাতলেই আমি যেন শুনতে পাই হুজুরের মিষ্টি সুর। "তুমি যে নূরেরো নবী... নিখিলে ধ্যানেরো ছবি... তুমি না এলে দুনিয়ায়...আঁধারে ডুবিতো সবই..." আহা...আমরা মিলাদের ফাঁকে ফাঁকে চোখ মুছতাম নবীকে কল্পনা করে। বাবার সুচ্চ স্বরের "বালাগাল উলা বি কামালিহি" পড়া- সব যেন কানে বাজে এই নষ্ট সময়ে।

আমরা কি তবে ভুল কোরআন পড়েছিলাম?

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা