পণ্ডিত রবিশঙ্কর সামনের জনস্রোতের দিকে তাকান। মনে হচ্ছে পুরো নিউয়র্ক আজ জড়ো হয়েছে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। এখনও স্বাধীনতা না পাওয়া একটি দেশকে সমর্থন জানাতে। সমগ্র বিশ্বে একশো ষাটের উপরে দেশ, কয়টার ভাগ্যে এমন অভ্যর্থনা জুটেছে?
ছেচল্লিশ বছর আগের কথা। আগস্টের শুরুর সময়টা নিউইয়র্কে গ্রীষ্মকাল। তাপমাত্রা ত্রিশ ডিগ্রীর কাছাকাছি থাকে সদাসর্বদা। মাঝে মাঝে সেটা ত্রিশ ছাড়িয়েও যায়। আজও মনে হচ্ছে সেরকমই একটি দিন। গ্রীনরুমে চিন্তিত মুখে বসে আছেন একজন, মুখভর্তি দাড়িগোঁফের জঙ্গল। হাতে গিটার। তারে টুংটাং করছেন। বাইরে কোলাহল শোনা যাচ্ছে। তার সামনে অস্থির পায়চারী করছেন বব ডিলান। গত দুই বছরে কোন কনসার্টে অংশ নেননি ডিলান। খানিকটা অনভ্যস্ততা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। হালকা কেশে নিলেন লম্বাচুলো।
-কিহে বব, এমন করছো কেনো?
-বুঝতে পারছি না। টেনশান হচ্ছে খানিকটা।
-তুমি তো কাঁপছো দেখছি। কাল রাতে বেশী গিলে ফেলেছিলে নিশ্চয়ই।
-আরে নাহ। নার্ভাস লাগছে। আমি বোধহয় পারবো না জর্জ।
-পারতে হবে বব। পারতে হবে। মনে রেখো, সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটা দেশের জন্যে গাইছি আমরা। মানুষগুলোর কথা ভাবো, ওদের অবস্থার কথা কল্পনা করো একটু!
-হুম। দাঁতে দাঁত চেপে ছোট্ট করে জবাব দিলেন বব ডিলান।
জর্জ ফিরে গেলেন কয়েকদিন আগের স্মৃতিচারণে। আনুমানিক মাসখানেক আগেই রবি এসেছিলেন তাঁর কাছে। পন্ডিত রবিশঙ্কর। বয়সে তেইশ বছরের বড় রবির সাথে জর্জের সম্পর্কটা বন্ধুর মতোই; যদিও তাঁরা একে অপরের গুরু-শিষ্য। রবিশঙ্কর ভারতীয়। তিনিই তাঁকে জানালেন বিষয়টা। ভারতের পাশেই পূর্ব বাংলা নামে একটা জায়গা আছে, যেটা পাকিস্তানের অংশ। দীর্ঘদিন ধরে স্বাধিকারের দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে আসা এখানকার অধিবাসীদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাচ্ছে পাকিস্তানী জান্তা সরকার। চলছে হত্যাযজ্ঞ। প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে পাশের দেশ ভারতে। পার করছে মানবেতর জীবনের কঠিন সময়। রবিশঙ্কর এসেছিলেন এদের জন্যে কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে। কিছু পত্রপত্রিকাও নিয়ে এসেছিলেন। জর্জ সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখলেন। পাকিস্তানীদের অত্যাচারের বিবরণ শুনে আটাশ বছরের তরুণের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল সেদিন।
লম্বা ঝাঁকড়া চুলের এই যুবকের পুরো নাম জর্জ হ্যারিসন, বিটলস কিংবদন্তি জর্জ হ্যারিসন। দিন বিশেক পরে তখনও গর্ভাবস্থায় থাকা একটা দেশের জন্যে, খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাতির জন্যে যিনি গিটারে ঝংকার তুলবেন। বছরখানেক আগেই বিটলস ব্যান্ড ছেড়ে এসেছেন হ্যারিসন। নিজের একটা ব্যান্ডদল গড়ার চেষ্টায় ছিলেন। সাবেক দলের সাথে তখন তাঁর সম্পর্ক ভালো নয়। তবুও তিনি ডাকলেন সবাইকে। রিংগো স্টার রাজী হলেন এক কথায়। জন লেননও প্রথমে রাজী হয়েছিলেন। পরে ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলার কারণে তাঁর আর থাকা হয়নি। হ্যারিসনের আহবানে সাড়া দিলেন তখনকার সাড়া জাগানো শিল্পীরা। এলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেল, ক্লাউস ভুরম্যান ও ব্যাডফিঙ্গার। আর ওদিকে রবিশঙ্করের সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে অংশ নেন ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাখাসহ আরো কয়েকজন।
গ্রীনরুমে ফিরে যাই আবার। বাইরে কোলাহল বাড়ছে। প্রথমে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দলের স্টেজে ওঠার কথা। তার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখবেন রবিশঙ্কর এবং জর্জ হ্যারিসন। রবিশঙ্করের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে মাইক্রোফোনে। জর্জ মঞ্চের পেছন দিকটায় এসে দাঁড়ালেন। তিনি ভাবছেন, আজকের এই ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্ট বন্ধ করার জন্যে কতো চেষ্টাই না করা হয়েছে। গতকালই নিক্সনপন্থী এক সিনেটর ফোন করেছিলেন। ভদ্রভাষায় হুমকী দিলেন, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন বিষয় আমেরিকায় টেনে না আনার জন্যে। জর্জ জবাব দিয়েছিলেন- “দুঃখিত জনাব, আমি গান গাই; আপনার মতো রাজনীতি করি না। নিজের লম্বা নাকটা কোথায় কতোটুকু গলাতে হবে সেটা বেশ ভালো জানা আছে আমার, ধন্যবাদ...”
আনমনেই হাসি পেলো জর্জ হ্যারিসনের। রবিশঙ্করের কথা শেষ হয়েছে। জর্জ পায়ে পায়ে হেঁটে গেলেন মঞ্চের মাঝামাঝিতে, মাইক্রোফোনের কাছে। ছোট করে বর্ণনা করলেন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার কথা। এও জানিয়ে দিলেন, তারা এখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন এক দেশ। সে দেশের নাম বাংলাদেশ....আর তাই আজকের কনসার্টের নামও ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ!’
পণ্ডিত রবিশঙ্কর সামনের জনস্রোতের দিকে তাকান। মনে হচ্ছে পুরো নিউয়র্ক আজ জড়ো হয়েছে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। এখনও স্বাধীনতা না পাওয়া একটি দেশকে সমর্থন জানাতে। সমগ্র বিশ্বে একশো ষাটের উপরে দেশ, কয়টার ভাগ্যে এমন অভ্যর্থনা জুটেছে? আবার কয়টি দেশের কপালেই বা এতো রক্তক্ষরণ লেখা ছিলো? আনমনে ভাবতে থাকেন রবিশঙ্কর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ম্যাডিসন স্কোয়ার উত্তাল হয়ে ওঠে জর্জ হ্যারিসনের গিটারে। পুরো কনসার্টে মোট আটটি গান পরিবেশন করেন হ্যারিসন। শেষ গানটির নাম বাংলাদেশ। এই কনসার্টের জন্যেই এটা তৈরী করেছিলেন হ্যারিসন। My friend came to me with sadness in his eyes He told me that he wanted help Before his country dies Although I couldn't feel the pain, I knew I had to try… ............................ ............................ We've got to relieve Bangla Desh... Relieve the people of Bangladesh...
হ্যারিসনের মনে হয়, অবসাদে তাঁর গলা ভেঙ্গে আসবে। তবুও তিনি গেয়ে যান। প্রতিবার বাংলাদেশ বলার সাথে সাথেই সমবেত জনতা তাঁর সাথে কোরাস মেলাচ্ছে। হ্যারিসনের কন্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসে। হাজার হাজার মাইল দূরের ঢাকায় যখন রুমী-বদি-জুয়েল-কামালদের মতো দুর্ধর্ষ ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলারা দেশমাতাকে রক্ষায় ক্রমাগত আতঙ্ক সৃষ্টি করছে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের উপর, তখন ঢাকা থেকে সাত সাগর তেরো নদী দূরত্বের নিউইয়র্কে তাঁদের জন্যে সমর্থন আদায়ে লড়ছেন রবিশঙ্কর-হ্যারিসন-ডিলান-ক্ল্যাপটনরা। এরাও কি ক্র্যাক পিপল নন? যে ভূমির সাথে কোন লেনাদেনা নেই, রক্তের টান নেই, জন্মের মায়া নেই; শুধু মানবতার তাগিদে হাজারটা চাপ আর বাধা উপেক্ষা করে পাশে দাঁড়ানো- এটাকে কোন শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়?
জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ বাংলাদেশ গানের সাথে চিৎকার ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে ম্যাডিসন স্কয়ার। রবিশঙ্করের মনে হয়, কমপক্ষে এক লাখ লোকের জনসমুদ্র চিৎকার করে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। যদিও পরে আমরা জানতে পারবো, সেদিনের কনসার্টে উপস্থিতি ছিলো চল্লিশ হাজারেরও বেশী। এই কনসার্ট থেকে চাঁদা উঠেছিলো দুই লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার ডলার। যার পুরোটাই ইউনিসেফের তত্বাবধানে পাঠিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্যে।
আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগে, উত্তাল একাত্তরের ১লা আগস্ট, নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার মুখরিত হয়েছিলো বাংলাদেশ বাংলাদেশ ধ্বনিতে। জয় হয়েছিলো সঙ্গীতের, তার চাইতেও বড় জয় হয়েছিলো মানবতার। আর সে জয় এসেছিলো পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসনের মতো কিছু তারছেড়া পাগলাটে মানুষের হাত ধরে; যাদের অন্তরটা ছিলো মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন