করোনা তো এমপি, সচিব কিংবা এসআলম গ্রুপ চেনে না! করোনার কাছে প্রত্যেকই একেকটা সংখ্যা। চাইলেও আপনি এখন চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড ছুটতে পারবেন না, এমনই বাস্তবতার মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই ভাইরাস!

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গতকাল ঢাকার দাপুটে সাবেক সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মকবুল হোসেন মারা গেলেন। ওদিকে চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম মারা গেছেন। করোনা তো আসলে এমপি, সচিব কিংবা এসআলম গ্রুপ চেনে না! করোনার কাছে প্রত্যেকই একেকটা সংখ্যা। এই যে দেখেন, এমপি মারা যাচ্ছেন। শীর্ষ ব্যাবসায়ী, দুজন অতিরিক্ত সচিব, দুদকের পরিচালক মারা গেছেন। আমি জানি না এই তালিকা আরও কতো দীর্ঘায়িত হবে। 

দেখেন, বাংলাদেশের সবক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে বিকল্প একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আর্থিক বা ক্ষমতাশালী মানুষের জন্য সীমিত সেই বিকল্প ব্যবস্থা। ধরেন বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আপনি সন্তুষ্ট নন। আপনার অনেক টাকা আছে, আপনি মুহূর্তের মধ্যেই সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিতে যেতে পারবেন। 

একইভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট নন। টাকা বা ক্ষমতা আছে আপনি সন্তানদের হয় নামীদামী ইংরেজি মাধ্যমে পড়াবেন নয়তো বিদেশে। 

শুধু স্বাস্থ্য বা শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, সর্বক্ষেত্রে আমরা বিকল্প একটা ব্যবস্থা করে তুলেছি। মূলত সম্পদশালী বা কোন না কোনভাবে ক্ষমতাশালীরাই এই বিকল্প ব্যবস্থার সুবিধাভোগী। তবে করোনা সেই বিকল্প ব্যবস্থায় দারুণ আঘাত হেনেছে। চাইলেই এখন যখন তখন বিদেশে যাওয়া যাচ্ছে না। 

ভাবেন একবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলমকে হয়তো থাইল্যান্ডের সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেয়া যেত। কিন্তু সেটি এখন সম্ভব হয়নি। ফলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালেই জীবনের শেষ মুহূর্তে কাটলো তাঁর। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

শুনেছি তাদের স্বজনরা একজন আর একজনের আইসিইউ বদল করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। কারণ, এস আলম গ্রুপের আরও কয়েকজন পরিচালকও করোনায় আক্রান্ত। চট্টগ্রাম নগরীর সুগন্ধায় তাদের পারিবারিক বাসভবন প্রশাসনের পক্ষ অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। অবশ্য এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম নিজে মার্চের মাঝামাঝি থেকে সিঙ্গাপুরে আছেন।

শুধু চট্টগ্রাম নয় দেশের প্রায় লোকই এসআলমের কথা জানে। বাংলাদেশের ইস্পাত, চিনি, ভোজ্যতেল, ভোগ্যপণ্য, পরিবহন, আবাসন, সিমেন্ট খাত, শিপিং, বিদ্যুৎ এবং আর্থিক খাতে ছড়িয়ে আছে এস আলম গ্রুপের ব্যবসা। দেশে অন্তত ছয়টি ব্যাংকের মালিকানার অংশ রয়েছে এই পরিবারের সদস্যদের হাতে। 

ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। শুধু বাংলাদেশে নয়, সিঙ্গাপুর ও কানাডার ধনীদের তালিকায়ও স্থান পেয়েছে গ্রুপটি।‌ ভেবে দেখেন, সব ধরনের সক্ষমতা থাকলেও, বিপুল পরিমান সম্পদ থাকলেও উন্নত দেশের বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের কাজে আসছে না। 

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকেই লিখেছেন, এস আলম গ্রুপ চাইলেই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থা পাল্টে দিতে পারতেন। শুধু এস আলম কেন চট্টগ্রামে অনেক ব্যবসায়ীরই শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা আছে। কিন্তু চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সুবিধা নেই বললেই চলে। 

শুধু চট্টগ্রাম বলছি কেন সারা দেশেই তো কম বেশি একই অবস্থা। এই ঢাকাতেই তো সরকারের দুজন অতিরিক্ত সচিব মারা গেলেন। এদের একজনের কন্যা নিজে চিকিৎসক ছিলেন। বাবাকে নিয়ে তিনি এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরেছেন। সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব হয়েও তিনি কাঙ্খিত চিকিৎসা পাননি। পাবেন কী করে? বিপুল সংখ্যক লোককে একসঙ্গে আধুনিক মানের সেবা দেওয়ার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থা তো দেশে আমরা গড়ে তুলিনি। 

আপনাদের মনে করিয়ে দেই। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন সর্বোচ্চ ২৮ জন। এ নিয়ে মারা গেলেন ৪৮০ জন। আর মোট সংক্রমিত ৩৩ হাজার ৬১০ জন শনাক্ত হলেন। প্রতিদিন যেভাবে গড়ে দেড় হাজারেরও বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছেন তাতে ১৫ দিন পর যদি রোগী ৫০ হাজার হয়ে যায় কি অবস্থা হবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। অনেক চিকিৎসকই বলছেন, আইসিইউ সুবিধা তো দূরের কথা, সামনে হয়তো রোগী ভর্তি করাও কষ্ট হয়ে যাবে।

এই যে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই দৈন্যদশা সেটি কিন্তু হঠাৎ করে একদিনে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে সরকারি হাসপাতালগুলোর জীর্ণশীর্ণ অবস্থা চলছে। নানান ধরনের অনিয়ম দুর্নীতি লুটপাট হয়েছে সেখানে। ব্যবস্থাপনার নানা সংকট ছিল। কিন্তু কখনো যথাযথভাবে সেদিকে আমরা নজর দেইনি। বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছিল চাকচিক্যময় বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। দেশের মধ্যে যাদের সামর্থ্য ছিল তারা সেখানে গিয়েছে। ক্ষমতা থাকলে সেখানে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেত। আর যাদের আরেকটু বেশী সামর্থ্য ছিল তারা তো চলে যেতেন দেশের বাইরে। কিন্তু এখন? 

বেসরকারি হাসপাতালগুলো দরজা প্রায় বন্ধ। আর বিদেশে যাওয়া যাচ্ছে না। না চাইলেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে তাই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। কিন্তু একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেয়ার মতন ব্যবস্থাপনা তো আমরা সেখানে গড়ে তুলিনি। অথচ সেটাই দরকার ছিল। দরকার ছিল সার্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা। যাতে বড়লোক হোক, সরকারের আমলা কিংবা সাধারণ মানুষ বা শিল্পপতি যে কেউ কোনরকম দুশ্চিন্তা ছাড়া সেখানে চিকিৎসা নিতে পারেন।
 
শুধু কী স্বাস্থ্যখাত? শিক্ষার দিকে নজর দিন। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সরকারি স্কুল-কলেজও। বছর সাতেক আগে এই রাজধানী শহরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা নিয়ে কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে হয়েছিল। 

শুনে অবাক হবেন, এই ঢাকা শহরে ২৯৩ টা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী বা মধ্যবিত্তের সন্তানরা সেখানে পড়তে যায় না। এমনকি ওই স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীদের সন্তানরাও যায় আসে না। এমনকি এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আয়া বলেছিলেন তিনি তার সন্তানকেও বেসরকারি স্কুলে পাঠান। কারণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মান ভালো না? কী অবস্থা বোঝেন! বছরের পর বছর ধরে রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই দৈন্যদশার দিকে কারও নজর নেই। কারণ বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা।

ঢাকাসহ প্রায় সব বড় শহরে এখন নামীদামি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আছে নামকরা সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুল যেখানে খরচের শেষ নেই। একটা দেশে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা ও ইংরেজি মাধ্যমের জগাখিচুড়ি চলছে। গড়ে ওঠেনি কোন সার্বজনীন ব্যবস্থা। সামর্থ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী প্রত্যেকেই বিকল্প ব্যবস্থা বেছে নিয়েছেন। আর বিদেশে তো রয়েই গেছে। বড় রাজনীতিবিদ বড় বড় আমলা তাদের প্রায় সবাই সন্তান বিদেশে পড়ে। দেশে শিক্ষাবর্ষ ধ্বংস হলে তাদের কি যায় আসে?

আসুন দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থায়। এই শহরে মধ্যবিত্ত একজন মানুষ তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে বাসে চড়তে পারবেন কী? একজন এমপি বা সচিব বা শিল্পপতি বাসে করে চলাচল করছেন ভাবতে পারবেন? অসম্ভব? বরং যাদের টাকা আছে তাদের সবার ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ঈদে ব্যক্তিগত গাড়িতে যেখানে সেখানে যাওযা যায়। ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থার কী দরকার? বিকল্প তো আছেই। আর প্রযুক্তির সাথে সাথে এসেছে নতুন বিকল্প ব্যবস্থা উবার-পাঠাও। কাজেই ঢাকা শহরে যে নিম্নমানের বাস চলে, গণপরিবহনের যে দৈন্যদশা সেটি নিয়ে ক্ষমতাশালীদের মাথা ব্যাথা নিয়ে। 

শুধু শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা পরিবহন ব্যবস্থা নয় সবক্ষেত্রেই একই অবস্থা। আসলে আমরা প্রত্যেকের সামর্থ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী সবক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলছি। রাজনীতিবিদরা তাদের সন্তানদের নিরাপদ করতে চেয়েছেন। ক্ষমতাশালীরা, আমলারা, ব্যবসায়িরা, মধ্যবিত্ত প্রত্যেকই সবকিছুতে বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজেছেন। লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। কানাডা আমেরিকা মালয়েশিয়ায় গড়ে উঠেছে বেগমপাড়া। বঞ্চিত হয়েছে শুধু বাংলাদেশ। সার্বজনীন কোন সুন্দর ব্যবস্থাপনা এই দেশে গড়ে উঠেনি। কিন্তু করোনা সবাইকে দেখিয়ে দিলো বিকল্প ব্যবস্থা সব সময় কাজে লাগে না।

আচ্ছা ভাবুনতো যদি করানোর আগে থেকেই যদি আমাদের শিল্পপতিরা-সচিবরা বা ক্ষমতাশালীরা সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য নিয়মিত যেতেন তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটি কী উন্নতর হতো না? যদি এমন নিয়ম করা হয় রাজনীতিবিদ বা সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানেরা অবশ্যই সরকারি স্কুলে পড়বেন। তখন কী সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান কী ভালো হবে না? আপনি যেই দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনীতি করেন, সরকারি চাকুরে হিসেবে যেই দেশের সেবার কথা সবসময় বলেন সেই দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবা কেন আপনার সন্তানরা নেবে না?

না, আমি বলছি না সম্পদ বা ক্ষমতা থাকলে কিংবা প্রয়োজন হলে কেউ পৃথিবীর আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলো নেবেন না। অবশ্যই নেবেন। তবে একটি সার্বজনীন সুন্দর ব্যবস্থাও তো থাকা উচিত। 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা আমাদের স্বাধিকার আর স্বাধীনতার লড়াইয়ে কিন্তু সার্বজনীন এই ব্যবস্থার কথা ছিল। করোনা সেটিই যেন আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। একইসঙ্গে ঈদও। আসুন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নীতি নির্ধারক আমরা সবাই বিকল্প বাদ দিয়ে সবার জন্য সার্বজনীন সুন্দর একটা বাংলাদেশের কথা ভাবি। সবাইকে ইদ মোবারক। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা