এইসব রক্তচোষাদের রূপ এর মধ্যে বদলাবে না। এই বিপর্যয়ের মাঝে মুখোশ খুলে বের হয়ে আসবে আরো অনেকে। ট্রাই করবে এই মহা বিপর্যয়ের মাঝেও অন্যের ক্ষতি করে নিজের ব্যক্তি স্বার্থে ফুল এডভান্টেজ নেয়ার। সবাই সতর্ক থাকুন, প্লিজ।

২০০৭ সাল, বুয়েটে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন, একটা টিউশনি পেলাম মিরপুর ১ নম্বরে চাইনীজ এর গলিতে। ছাত্র একটু ফাঁকিবাজ, বেসিক খুব একটা ভাল না, টেনেটুনে পাশ করে এখন ও লেভেল দিবে। সম্ভবত বাবা নেই, মা এর একটা গার্মেন্টস আছে। টাকাপয়সা প্রচুর।

আন্টি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বাসায় গেলেই অনেক নাস্তা, যেদিন দেখা হতো একগাদা গল্প-স্বল্প, মাঝে মাঝে ফোন দিয়েও খবর নিতেন। আমার পেমেন্ট ছিল ৩০০০ টাকা। জুন মাস মাস পড়ানোর পর বেতন পেলাম জুলাই এর ৫ তারিখের দিকে। টিউশনি কন্টিনিউ করতে থাকলাম।

দুই তিন মাস যাবার পর বেতন টা পেতে একটু দেরী হওয়া শুরু করলো। আন্টি ডেকে বলতেন অনুপম এলসি খুলছি হাতে একটু টাকা কম তোমাকে ১৫ তারিখের দিকে বেতন দেব। মানে সেপ্টেম্বর এর বেতন পেলাম অক্টোবরের ১৫ তারিখে।

আমি খুব একটা গা করতাম না। টিউশনি চলতে লাগলো। এরপর বেতনের তারিখ পেছাতে থাকলো। ২০ তারিখ, ২৫ তারিখ। কোন মাসে তারা গাড়ি কিনতো, কোন মাসে নতুন টিভি, কোন মাসে আগে গার্মেন্টস এর শ্রমিকদের বেতন ক্লিয়ার করতো।

আমার ৩০০০ টাকা তাই ক্লিয়ার করাটা খুব ডিফিকাল্ট হয়ে যেত তাদের জন্য প্রায়ই! আন্টি শুধু বলতেন, চিন্তা করো না ৩০ তারিখের আগেই বেতন পেয়ে যাবা। (মানে ডিসেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে নভেম্বর এর বেতন পেতাম আরকি)।

যাই হোক, স্টুডেন্ট ও লেভেল দিল, মার্চ মাসে লাস্ট পড়ালাম। আন্টি মার্চের শেষে ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে বললেন এক্সাম তো শেষ, তাহলে সামনের মাস থেকে আর লাগছে না। আমি তোমাকে মার্চ এর টাকাটা সামনের মাসে দিয়ে দেব।

আমি বললাম আন্টি একচুয়ালি আমার তো গত মাস (ফেব্রুয়ারী) আর এই মাস (মার্চ) এই দুই মাসের বেতন বাকি। উনি বললেন না না, তোমাকে ত আমি ৩০ তারিখের মধ্যেই টাকা দেই আমি তিরিশ মিনিট বুঝানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। ঠিক আছে আন্টি এক মাসের ৩০০০ টাকাই দিয়েন।

তিনি বললেন আমাকে এপ্রিলের পয়েলা বৈশাখ এর আগে একটা ফোন দিয়ে এসো টাকা দিয়ে দেব। এরপর এপ্রিল গেল, মে গেল, জুন গেল - কখনো ফোন দিলে ফোন ধরেন না, অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে যদি পাই তাহলে বলেন অমুক তারিখ আবার একটা ফোন দিও।

এখন আজকে থেকে ১২ বছর আগে, একজন স্টুডেন্ট হিসাবে, আমার কাছে ৩০০০ টাকা কিন্তু অনেক টাকা (বাকি এক মাসের বেতন তো আগেই ছেড়ে দিয়েছি)।  আর একজন মানুষ, এত অমায়িক ব্যবহার, কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েও তার সামান্য কয়টা টাকার জন্য কাউকে এভাবে দিনের পর দিন ঘুরাতে পারে আমার ধারণাই ছিল না।

ধারণা হলো। আমার ছাত্র ভালভাবেই পাশ করে গেল। আমার হাতে আর কোন টিউশনি ছিল না তখন। লজ্জার মাথা খেয়ে তাই কয়েক মাস টাকা কয়টার জন্য ঘোরার পর অবশেষে আমি হাল ছেড়ে দিলাম। আর সেই থেকে আমি চিরতরে শ্রদ্ধা হারালাম এই রকম কোটি টাকার মালিক অথচ ভীষন রকম ছোটলোক দের উপর থেকে।

সব মিলায় এখন পর্যন্ত আমার স্টুডেন্ট থাকাকালীন টিউশনি বাবদ প্রাপ্য - ২৮০০০ টাকা! এই যে লাখো লাখো শ্রমিকদের উপর অবিচার, কয়টা টাকার জন্য মোটিভেশনাল স্পিকারদের এর রাতারাতি পল্টিবাজি, এসব দেখে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করলেও আমি কিন্তু একটুও অবাক হইনি। 

করোনাভাইরাস দ্বারা আজকের এই বিপর্যয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, কমিউনিটি লিডারদের ড্যাম কেয়ার ভাব, নিজেকে সর্বজ্ঞ মনে করে এক্সপার্ট অপিনিয়ন অবহেলার প্রয়াস আর সেই সাথে অসুস্থ পলিটিক্স। যদিও দেরীতে হলেও অনেকের এখন টনক নড়েছে, চেষ্টা করছে ড্যামেজ কন্ট্রোল করার।  

কিন্তু এইসব রক্তচোষাদের রূপ এর মধ্যে বদলাবে না। এই বিপর্যয়ের মাঝে মুখোশ খুলে বের হয়ে আসবে আরো অনেকে। ট্রাই করবে এই মহা বিপর্যয়ের মাঝেও অন্যের ক্ষতি করে নিজের ব্যক্তি স্বার্থে ফুল এডভান্টেজ নেয়ার। সবাই সতর্ক থাকুন, প্লিজ।

নইলে অসংখ্য ভাল উদ্যোগ হারিয়ে যাবে এরকম গুটিকয়েক অর্থালোভী, ক্ষমতালোভীদের হাতে। চলুন একসাথে লড়াই করি সকল প্রকার ভাইরাস এর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা