আমরা আশা করে আছি আমাদের সরকার কানাডার প্রধানমন্ত্রীর মতন হবেন, এদিকে আমরা যা করে বেড়াচ্ছি, তাতে আমরা যে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পাইনি, এইটাই আমাদের ভাগ্য!

আমাদের পরিচিত এক ডাক্তার বড় ভাই নিজের গ্রামে তাঁর ডাক্তার বন্ধুদের নিয়ে গ্রামবাসীদের ফ্রী চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। কেউ চোখের প্রাথমিক চিকিৎসা করবেন, কেউ ব্লাড প্রেশার, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ছোটবড় রোগ সম্পর্কে পরামর্শ দিবেন। প্রয়োজনে কাউকে কাউকে হাসপাতালে ভর্তি হবার নির্দেশ দিবেন।

প্রত্যেকেই ঢাকা শহরের বিরাট ডাক্তার। তাঁদের চেম্বারে বিরাট লাইন থাকে। মোটা অংকের ভিজিট। তাঁরাই আর্ত মানবতার সেবায় ফ্রী চিকিৎসা দিতে রাজি হয়েছেন। গ্রামের ঐ সাধারণ মানুষদের জন্য যা স্বপ্ন বাস্তবায়নের মতন ঘটনা। 

কিন্তু গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে সংবাদ পৌঁছালে তিনি বলে দিলেন, মাইকিং করে ঘোষণা দিতে হবে তিনি এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন! সাথে ব্যানার ঝোলানো হবে, এবং সেখানে থাকবে তার নাম। সে হবে সেই অনুষ্ঠানের সভাপতি। সে বক্তৃতা দিবে। সেই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবে।  

ভাইয়েরা ক্ষিপ্ত হলেন। চেয়ারম্যান জীবনেও যোগাযোগ করেনি, কোনো সাহায্য করেনি, একটা পয়সাও ঢালছে না, উল্টা পুরো ১০০% ক্রেডিট নিতে চাইছে। তারপরেও তাঁরা বললেন, যা শালার, ঠিক আছে। তুই খুশি থাক। গরিবরাতো চিকিৎসা পাক। কিন্তু এতেও ব্যাটার পেট ভরে নাই। সে তালিকা করে দিবে কোন কোন রোগী চিকিৎসা পাবে, কে কে পাবে না। মানে বিষয়টা পুরোই দলীয়করণ হয়ে গেল আর কি। 

এই বার সেই বড় ভাইয়ের বন্ধুরা বেঁকে বসলেন। তাঁরা সাধারণ চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন। এটাতো দলীয় প্রচারণা হয়ে যাচ্ছে। অতএব, ক্যানসেলড। মাঝ দিয়ে গরিব মানুষগুলো চিকিৎসা বঞ্চিত হলো। 

ঘটনা কেবল ঐ গ্রামের না। আমাদের নিজেদের উদ্যোগেও যখন এমন কাজ করা হয়েছে, যেমন ধরেন কোন স্কুলে ফ্রী চক্ষু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবকের চিকিৎসা করা হবে, সেখানেও এক রাজনৈতিক ক্ষমতাবান এসে দাঁত কেলিয়ে ক্রেডিট নিয়ে গেলেন। আমাদের দেশে এটাই হয়ে আসছে। 

তা বাংলাদেশে এখন এই চরম দুর্যোগের মুহূর্তে ডাক্তারদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করতে মার্ক্স্ এন্ড স্পেন্সারের বাংলাদেশ প্রধান স্বপ্না ভৌমিক উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি ব্যবস্থা করছেন যাতে ডাক্তাররা সুরক্ষা পোশাক পরে চিকিৎসায় যান। তাঁর এই উদ্যোগে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষের জন্য মানুষ ফাউন্ডেশন, বুয়েট এলামনাই এসোসিয়েশন, এবং পে ইট ফরওয়ার্ড। 

এখন আমি বলে রাখি, কিছুদিন পরে কোনো এক রাজনৈতিক তেলবাজ নিজের বক্তৃতায় এই ক্রেডিট নেয়ার চেষ্টা করবে। বলবে "জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের নয়নমনি, জননেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, ইসলামের প্রথম নারী খলিফা, প্রধানমন্ত্রী হজরত শেখ হাসিনা বিনতে মুজিব আল গোপালগঞ্জী আল বাংলাদেশী এই সুরক্ষা পোশাকের ব্যবস্থা করেছিলেন।"

অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তবতা হলো এই যে সরকারের তরফ থেকে পর্যাপ্ত কীটও আসেনি, যা দিয়ে করোনা পরীক্ষা করা হবে। সুরক্ষা পোশাকতো দূরের কথা, একটা মাস্কও ডাক্তাররা পাননি, গ্লাভসও না। ঢাকার বাইরের করোনা পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থাই করা হয়নি, চিকিৎসাতো বহুদূর। 

প্রিয় ভাইয়েরা ও বোনেরা, বুঝতেই পারছেন, সরকারের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। যা করার নিজেদেরই করতে হবে। আমরা আশা করে আছি আমাদের সরকার ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রীর মতন হবেন, এদিকে আমরা যা করে বেড়াচ্ছি, তাতে আমরা যে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পাইনি, এইটাই আমাদের ভাগ্য! আমাদের জন্য ১৪৪ ধারা জারি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার আগে নিজেদের কিছু করণীয় আছে। 

প্রথম কাজটি যা করতে পারেন তা হচ্ছে কিছুই না করে ঘরে বসে টিভি দেখবেন। পরিবারের সাথে সময় কাটাবেন। বাইরে বেরুবেন না। ডাক্তাররা বারবার বলছেন, "আপনাদের জন্য আমরা বাইরে আছি, আমাদের জন্য আপনারা ভিতরে থাকুন"- এই সামান্য অনুরোধ আমরা রাখতে পারছি না? এই জীবনে এই প্রথমবার এমন সুযোগ পেয়েছি যে কিছু না করেই অনেক বড় কাজ করে ফেলার কৃতিত্ব পাচ্ছি। তারপরেও আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছি না। 

দ্বিতীয় কাজটি হচ্ছে, কেউ কোয়ারেন্টাইনে আছেন, কেউ অসুস্থ হয়েছেন, এইসব শুনে দয়া করে নিজের কৌতূহল দমন করুন, তাঁকে দেখতে তাঁর বাড়িতে ভিড় করবেন না। হবিগঞ্জে দেখলাম এমনই আকাম করেছে একদল কৌতূহলী জনতা। পুলিশ ডেকে ওদের খ্যাদাতে হয়েছে। এটি কোনো তামাশার বিষয় না। দয়া করে মাথায় রাখুন- ভাইরাসটি ছোঁয়াছে। কেবল কাশির থেকে থুথু গড়িয়ে পড়লেই ছড়ায়, এমন না। আক্রান্তের ছয়ফিটের মধ্যে আপনি থাকলে আপনি আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকবেন। এই ভাইরাস বাতাসে তিন ঘন্টা পর্যন্ত ভেসে থাকতে পারে। এইসবই লেটেস্ট পরীক্ষার ডাটা, কাজেই "ভাইরাস বাতাসে পনেরো সেকেন্ডে মরে যায়," এবং "সারফেস থেকে ছড়ায়" বা "মাস্ক সাথে থাকলে ভয় নেই" ইত্যাদি ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। বাইরের দেশগুলোর অবস্থা দেখুন। একজন থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ম্যাসাকার বাঁধিয়ে দিয়েছে। এত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার পরেও দিনে সাতশোর বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। এইসব কোনো রূপকথার গল্প নয়, বাস্তবতা। কাজেই সতর্ক হন। 

তৃতীয় কাজ যেটি করতে পারবেন, সেটি হচ্ছে, নিজের কলকারখানা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বন্ধ রাখুন। একটা অসুস্থ কর্মচারী গোটা অফিসে রোগটি ছড়িয়ে দিতে পারে। আপনি নিজেও আক্রান্ত হতে পারেন। আপনার থেকে আপনার পরিবার, এবং এইভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে সব জায়গায়। একজনও যদি আপনজন মারা যান, পারবেন সেই ক্ষতি পোষাতে? আর্থিক ক্ষতি ইন শা আল্লাহ, কাটিয়ে তোলা যায়, কেউ হারিয়ে গেলে ফেরানো যায় না। বাকি আপনাদের ইচ্ছা। 

সবাই বলছেন, বাইরে না বেরুলে অনেকের খাওয়া খাদ্যের ব্যবস্থা হবেনা। সত্যিই তাই। যেমন রিকশাওয়ালা, দিন মজুর ইত্যাদি পেশার লোকজন। একদিন তাঁরা কাজ না করতে পারলে বাড়িতে অন্ন থাকবে না। এক্ষেত্রে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, দেশে যুদ্ধ বাঁধলে আমরা কী করতাম? তখনতো জীবনযাত্রা এমন স্বাভাবিক থাকতো না। এটিও যুদ্ধের মতোই ব্যাপার। গোটা মানবজাতি এক হয়ে একটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে। যারা কোয়ারেন্টাইন নিয়ম মানবেন না, তারা রাজাকার, মীর জাফর, বিশ্বাস ঘাতক। কারণ তাদের কারণেই আমাদের অন্যান্য সহযোদ্ধারা আক্রান্ত হবেন, নিহত হবেন, এবং ভাইরাস জিতে যাবে।

আমাদের দায়িত্ব এইসব দিনমজুর, অনাহারী, অর্ধাহারি মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো। তাঁদের অন্তত এক বেলা খাওয়া হয়, এমন খাবার (এক মুঠো চাল, একটা আলু, কিছুটা ডাল একটা সিদ্ধ ডিম ইত্যাদি) প্যাকেট করে রেখে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসতে পারি, যেখানে লেখা থাকবে শুধুমাত্র যাদের দরকার, তাঁরাই যেন নেন। ভিড় যেন না হয়। নিজেরাও যেন কম খাই। এক মুঠ ভাত কম খেয়ে সেটা অন্যের সাথে শেয়ার করলে আমি মরে যাব না, কিন্তু একজনের প্রাণ বেঁচে যাবে, এটা নিশ্চিত। এইসব ব্যাপার লক্ষ্য রাখলেই আমরা এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবো ইন শা আল্লাহ।

বারবার বলেছি,আবারও বলছি, রোগটি ছড়ানো বন্ধ করতে পারলে অতি দ্রুত এ থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে। সবাই যদি নিয়ম মানি, মাত্র দুই সপ্তাহ আমাদের গৃহবন্দী থাকতে হবে। এবং এরপর থেকেই জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর যদি না মানি, তাহলে প্রস্তুতি নিন, গোটা মানবজাতি ধ্বসে যাবে।  

আর যদি কোনো নেতা গলাবাজি করে বলে, "আমরা বাঙালিরা বিশ্ববাসীর কাছে রোল মডেল, আমরা অতীতেও নানান মহামারী মোকাবেলা করে এসেছি, আমাদের কিছু হয়না ইত্যাদি ইত্যাদি" তাহলে এইসব নেতার মুখ বরাবর থুথু মারুন। এবং দোয়া করুন, যেন সেটাতে করোনা জীবাণু থাকে। ব্যাটা বুঝুক মহামারী মোকাবেলা করতে কেমন লাগে। অন্যের উপর দিয়ে যায় বলে এইসব গলাবাজি করা অতি সহজ।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা