এলাকায় একসাথে এত টু-লেট কখনো দেখিনি। প্রায় সব বাড়িতেই ভাড়ার নোটিশ। অজস্র মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। কিন্ত সব দোষ কি করোনার? আমাদের মধ্যবিত্তের বদলে যাওয়া লাইফস্টাইল কি দায়ী নয় এজন্যে?

কাজী তাহসিন আহমেদ: একটা অপ্রিয় কথা বলি, কিছু মনে করবেন না। আমাদের এই শহরে লাইফস্টাইলে প্রব্লেম ছিলো। শো অফ বেশি ছিলো। নইলে অন্তত ছয় মাস বসে খাওয়ার মতো টাকা সব পরিবারেই জমে থাকার কথা। যতটুকু ইনকাম, কালের স্রোতে গা ভাসাতে যেয়ে খরচ তারচেয়ে বেশি হয়েছে।  যতটুকু স্ট্যাটাস, যতটুকু সামর্থ্য, মানুষ নগদে তার চেয়ে উঁচু তলায় বাস করেছে।

আমি আমার এলাকায় একসাথে এত টু-লেট কখনো দেখিনি। প্রায় সব বাড়িতেই টু-লেটের নোটিশ। অজস্র মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। দুঃখজনক।

৯০ দশকে মানুষের আর্থিক অবস্থা এখনকার চেয়ে অনেক খারাপ ছিল। কিন্তু এই গরীব মানুষদেরই আজীবন যথেস্ট সেভিংস ছিলো, খেয়ে না খেয়ে শহরের কোনায় এক টুকরো জমি ছিলো। গ্রামে একটা স্থায়ী ঠিকানা ছিলো। পরিবার গরীবি হালে চললেও মায়ের আঁচলের গিঁট আর ডানোর খালি ডিব্বাতেও কয়েক গাছি টাকা থাকতো।

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

আর এখনকার মানুষদের কার্ড ভর্তি লোন, ইন্সটলমেন্ট, ব্যাংক লোন। জমি জিরাতের খবর নেই অথচ শহরের প্রাণকেন্দ্রে টাইলসওয়ালা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতে পারলেই খুশি। সঞ্চয়ের খবর নেই অথচ ঘোরাঘুরি আর রেস্টুরেন্টে খেতে পারলেই খুশি। পকেটে টাকা নেই তাই মন মানসিকতা মলিন, অথচ পার্লারে/সেলুনে হাজার টাকা খরচে ফেসিয়াল করে চামড়া চকচকে করতে পারলেই হলো। এটা কোনো লাইফ?

কেউ এখন আর ঘরের ড্রইংরুমে আড্ডা দেয়না। পাঁচ দশ টাকার বাদাম কিনে ছাদে গোল হয়ে বসে গল্পগুজব করেনা। সবার ফাস্টফুডের দোকানে যেতে হবে। মাল্টিপ্লেক্সেই মুভি দেখতে হবে। শখের সব খেলনাই কিনতে হবে। এফেয়ার করতেই হবে, ভ্যালেন্টাইন ডে থেকে শুরু করে চকলেট ডে কিস ডে সব সেলিব্রেট করতে হবে। অথচ বিশ বছর আগেও রেস্পন্সিবল লাইফ কাটাতে হবে দেখে অনেক ছেলে চাকরী পাবার আগে মেয়েদের ধারে কাছেও যেতোনা। এখন সবাই হিরো, পাপাস প্রিন্স, মাম্মাস প্রিন্সেস।

ছবি যখন কথা বলে

এসব করে মাসে মাসে যে পাঁচ সাত হাজার টাকা বেশি খরচ করেছে, সেটা জমালে বছরে ৬০-৭০ হাজার টাকা অতিরিক্ত জমতো। দশ বছরে ৬-৭ লাখ টাকা। যেটি দিয়ে এখন ঘরে বসে ছয় সাত মাস বড়লোকের মতোই পরিবারগুলো কাটাতে পারতো। অথচ সেটা না করে বরং গর্ব ভরে মিম শেয়ার করেছে যে মানিব্যাগে পাঁচশো নিয়ে বের হলে এক ঘন্টা পরে ভাংতি বিশ ত্রিশ টাকার বেশি থাকেনা।

একটু রোজগার করতে পারলেই একান্নবর্তী পরিবার থেকে সবাই আলাদা হয়ে গেছে। ইউনাইটি কি জিনিস ভুলে গেছে। গ্রামের শেকড় ভুলে গেছে গর্বের সাথে, অথচ গ্রাম থেকে বছরে দু চার আসা বস্তা ভর্তি আম কাঠাল বা চাল/মুড়ির কি বরকত সেটা বুঝতে চায়নি। ছুটিতে কক্সবাজারের ফাইভ স্টার হোটেলে খরচ না করে গ্রামের বাড়িতেও যে বেড়ানো যায় সেটা বুঝেনি। আগে মানুষ কয়েক বছরে এক আধবার লাক্সারি ট্যুর দিতো। আর এখন  প্রতি বছর লাখ টাকা খরচ করে ইন্সটলমেন্টে হলেও দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাচ্ছে দুইটা ফটো তোলার জন্য।

আমি গত পাঁচ সাত বছরে এই শহরে মধ্যবিত্ত বলে কিছু দেখিনি। সবার ঠাঁঠবাট প্রায় একরকম। তবে এখন দেখছি, গত কয়েক মাস ধরে। এত খরুচে আর ভোগপণ্যের দাস হয়ে আজীবন বর্তমানে বেঁচে থাকতে গিয়ে দুই-তিন মাসের ভবিষ্যত নিরাপত্তাটা নিয়েও ভাবার ক্ষমতা হারানো এই শহরবাসীদের এখনকার বাস্তবতা খুব দুঃখজনক।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা