সর্বপ্রথম করোনাভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করার পর, গুজব ছড়ানোর অভিযোগে জননিরাপত্তা ব্যুরো তাকে আটক করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় চীনা কর্তৃপক্ষ।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে সবার আগে সতর্ক করেছিলেন তিনি। কিন্তু এর জন্য উল্টো তাকে অপদস্থ হতে হয়। চীনের জননিরাপত্তা ব্যুরো তাকে আটক করে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, তিনি মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছেন বলে সরাসরি অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এ সম্পর্কিত একটি নথিতে দোষ স্বীকার করে সই করতে বাধ্য করা হয় তাকে। পরবর্তীতে গুজব না ছড়ানোর জন্যও সতর্ক করা হয়। অথচ এই মানুষটির জন্য বেঁচে যেতে পারতো করোনায় প্রাণ হারানো মানুষগুলো।

এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৭০০ জন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পুরো বিশ্ব এখন হুমকির মুখে। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। উহান সেন্ট্রাল হসপিটালে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলেন ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং। এই হাসপাতালেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন তিনি। এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি মারা গেছেন।

তার মৃত্যুতে চীনের নাগরিকদের মধ্যে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ইতিমধ্যেই চীনারা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই ক্ষোভের যথেষ্ট কারনও রয়েছে। ডাক্তার লি ঐ সতর্কতা দেওয়ার পর চীনা সরকার সেটা আমলে তো নেয়নি বরং তাকে তিরস্কার করেছিলো। সরকার অভিযোগ করেছিলো, তিনি গুজব ছড়াচ্ছেন। শুধুমাত্র ডাক্তার লি নয়, মোট আটজন ডাক্তার এই সতর্কবাণী দিয়েছিলো। কারো কথায় পাত্তা দেয়া হয়নি। সবাইকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। অথচ চীন সরকারের উচিত ছিলো তাদের মতামতকে কাজ লাগানো কারণ এটি ছড়িয়ে পড়ার আগেই তারা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন।

ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং এর ছবি হাতে প্রতিবাদ করছে চীনারা 

একটু সতর্ক হলেই কতগুলো প্রাণ বেঁচে যেতে পারতো। আসলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের খবর গোপন করতে চেয়েছিল চীনা কর্তৃপক্ষ। তাইতো এই ভাইরাস সম্পর্কে যারা আগাম সতর্কবাণী দিয়েছিলেন সবাইকেই চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছে। ডাক্তার লির মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়িয়েছে চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়। তার মৃত্যুতে চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েবুতে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ব্যবহারকারীরা। এ মৃত্যুতে দুটি হ্যাশট্যাগ চালু হয়েছে। একটি হলো ‘উহান সরকার লির কাছে ক্ষমা চাও’। আরেকটি হলো ‘আমরা বাকস্বাধীনতা চাই’। পরিহাসের  ব্যাপার হচ্ছে, এই হ্যাশট্যাগ দুটির ওপরেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে সেখানকার সরকার।  কারণ লাখো মানুষ এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা শুরু করেছিলো।  

এদিকে, ডাক্তার লির মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করতে চেয়েছিলো চীনা কর্তৃপক্ষ। তাই  প্রথমে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর সেটি সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে হাসপাতাল সূত্র নিশ্চিত করে যে তিনি মারা গেছেন। উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বরে ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং তার সহকর্মীদের একটি সতর্কবার্তা পাঠান, যেখানে তিনি সার্সের মতো একটি ভাইরাসের কথা জানান। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে তিনি তার সহকর্মী চিকিৎসকদের সুরক্ষামূলক পোশাক পরার পরামর্শ দেন। এর চার দিন পর ডাক্তার লিকে ডেকে নিয়ে যায় করে চীনের জননিরাপত্তা ব্যুরো। ১০ জানুয়ারি লির কাশি শুরু হয়। পরদিন আসে জ্বর। তার দুই দিন পর তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।

গত ৩০ জানুয়ারি ডাক্তার লি এর করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টি শনাক্ত হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডাক্তার লি চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েইবুতে তার গল্প শেয়ার করেছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থার একটি ছবিও দিয়েছিলেন সাথে। তার গল্প ওয়েবুইতে ছড়িয়ে পড়লে সবার কাছে তিনি হিরো হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই হিরো করোনাভাইরাসের কাছে হেরে গেলেন। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। 

তার এই মৃত্যুতে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন চীনা নাগরিকরা। চীনের সরকার অবশ্য ইতিমধ্যেই স্বীকার করে নিয়েছে যে, ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবস্থা গ্রহণে ঘাটতি ছিলো। তবে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। জনগনকে নিয়ন্ত্রণ করা ক্ষমতার লোভ খুব জঘন্য পরিণতি ডেকে আনে। আর চীন সরকারের এই অপরাধের মাশুল যেন পুরো বিশ্বকে দিতে না হয়।   

 

 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা