কোন সভ্য দেশ কক্সবাজারকে পেলে অন্যরকম বানিয়ে ফেলতো, আর আমরা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মুসলমান দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ায় পর্যটনের সব সুবিধা রেখেছে পাবেন। এমনকি সৌদ আরবও যেখানে তার দরজা উম্মুক্ত করছে বিদেশিদের জন্য, সেখানে আমরা এখনো বসে আছি মান্ধাতা আমলে, বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, নেই যথাযথ নিরাপত্তাও...
সকালে ঘুম ভাঙলো সাগরের শব্দে। অবশ্য গত তিনদিনই এমন হয়েছে। সাগরের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমাতে গিয়েছি, আবার সাগরের শব্দ শুনে সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। কক্সবাজারে থাকলে অবশ্য এমনই হওয়ার কথা। আর তাতে মনও ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কক্সবাজার দেখে এখন আমার যতোটা না মন ভালো হয় তার চেয়েও বেশি মন খারাপ হয়!
আমি দেখি আর ভাবি অসাধারণ এক পর্যটন শহরের প্রকৃতি কীভাবে দিনকে দিন ধ্বংস হচ্ছে! দেখি সাগরের পাড় ধরে হোটেলের সারি ছড়িয়ে যাচ্ছে মেরিন ড্রাইভের দিকে। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। আমি ফিরে যাই তিন দশক আগে আগে আমার শৈশবে।
না খুব বেশিদিন আগের কথা নয়! বাবার চাকুরির সুবাদে চট্টগ্রামে আসা, সেই সুবাদে প্রথম কক্সবাজার বেড়াতে আসা। ১৯৯২ বা ৯৩ সালে বোধহয় প্রথম বোধহয় কক্সবাজার আসি। এরপর বছরে একবার দুইবার। ১৯৯৯-২০০০ সালেও কলেজের বন্ধুরা মিলে চট্টগ্রাম থেকে চলে আসতাম! ২০০৩-০৪ সালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালে রাতের বাসে চড়ে চলে আসতাম কক্সবাজারে। তখনো আমি মুগ্ধই হতাম!
সারারাত ভ্রমণ করে শহরে ঢোকার আগে বাসটা যখন উঁচু পাহাড় থেকে কলাতলী পয়েন্টে আসতো মনে হতো বাসটা সাগরে চলে যাবে। আমার ঘুম ছুটে যেতো। আর এখন! আপনি শহরে ঢুকতেই দেখেবেন বড় বড় বিল্ডিং। আমি সাগজুড়ে লাল কাকড়াদের দল দেখেছি। এখন দেখি আবর্জনা। বিশেষ করে গত একযুগে যতোবারই কক্সবাজার আসি আমার মন কাঁদে।
অনেকেই হয়তো অবিশ্বাস করবেন, আমি গত চারবছরে কক্সবাজারে এসে হোটেল থেকে আর মূল সৈকতে যাই না। লাখ লাখ লোক। নোংরা, আবর্জনা। আমি এসব ছেড়ে মেরিন ড্রাইভ ধরে হিমছড়ির দিকে যেতাম। এখন সেখানেও যাই না। হিমছড়ি পেরিয়ে দরিয়ানগরের দিকে একটু ভালো লাগতো, সেখানেও দেখি নতুন নতুন স্থাপনা!
অথচ কক্সবাজারের পুরোনো ছবিগুলো দেখুন। কে বলবে পাহাড়ের পাশেই সাগর ছিল। আমার ধারণা পৃথিবীর কোন সভ্য দেশ কক্সবাজার পেলে অন্যরকম বানিয়ে ফেলতো। আর আমরা? আমরা ধ্বংস করছি।
আপনারা অনেকেই হয়তো থাইল্যাণ্ডের পাতায়া গেছেন। ছোট্ট একটা সৈকত। দেখেন সেটা ঘিরে কতো কী আয়োজন! কাজের কারণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ডেনমার্ক, জার্মান, নেদারল্যাণ্ড, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী, পোলাণ্ড, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র আমি যেমন দেখেছি তেমনি এশিয়ার জাপান, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যাণ্ডও দেখেছি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশই আমি দেখেছি। আবার দেখেছি মরুর দেশ কাতার, আরব আমিরাত, বাহরাইন কিংবা পৃথিবীর আরেক প্রান্তের মরক্কোও।
বাংলাদেশের কক্সবাজারে মতো এত সুন্দর সৈকত আমি কোথাও দেখিনি। সমুদ্রের এমন শব্দ! এত দীর্ঘ সৈকত! অথচ আমরা আমাদের কক্সবাজারকে হত্যা করছি। সেই হত্যাকে আর প্রলম্বিত করবে হয়তো রোহিঙ্গা সংকট।
আপনাদের একটু ইতিহাসে নিয়ে যাই। গুগল করলেই পেয়ে যাবেন, মুঘল সম্রাট শাহ সুজা পাহাড়ী রাস্তা ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং এখানেই ক্যাম্প স্থাপনের আদেশ দেন। তার যাত্রাবহরের প্রায় একহাজার পালঙ্কী কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা নামের স্থানে অবস্থান নেয়। ডুলহাজারা অর্থ হাজার পালঙ্কী। মুঘলদের পরে ত্রিপুরা এবং আরকান তার পর পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশরা এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। বদলে ফেলে তারা কক্সবাজারের নাম।
এর আগে কক্সবাজারের আগের নাম ছিল পালংকি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিরাম কক্সকে পালংকির মহাপরিচালক করে পাঠায়। তখনো এই শরনার্থী সংকট ছিল। ক্যাপ্টেন কক্স আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান হাজার বছরের পুরোনো সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেন। কিন্তু কাজ পুরোপুরি শেষ করার আগেই ১৭৯৯ সালে তিনি মারা যান। তার পুনর্বাসন অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর নাম দেয়া হয় কক্স সাহেবের বাজার। সেই থেকে কক্সবাজার।
সত্যি বলছি, পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ ঘুরে আমার মনে হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা দুহাত ভরে বাংলাদেশকে দিয়েছেন। পর্যটন প্রকৃতি আমাদের অসাধারন। কক্সবাজারের মতো একটা সাগর সৈকত দিয়ে একটা দেশের সম্পদশালী হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমরা পারি না। কেন পারি না?
মাঝে মধ্যে মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা উদাহরভাবে দেওয়ার পরেও আমরা অভাগা জাতি বলে সব কাজে লাগাতে পারছি না। দেখেন মরুর শহর দুবাইতে আমি দেখেছি ওরা ওদের সাগরপাড়ে কী সুন্দর করে কাঠের রেস্টুরেন্ট বানাচ্ছে। সবাই প্রকৃতি বাঁচায়। আর আমরা পারলে সৈকতের ভেতরেও হোটেল করি। তার কোন ডিজাইন নেই, নকশা নেই। কিছু কিছু ভবন আবার বানিয়ে ফেলে রাখা। দেখলে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর।
এতো কিছুর পরেও বলুন তো কেন বিদেশিরা কক্সবাজারে আসবে? তারা কী জানে বিশাল এক সমুদ্র সৈকত আছে কক্সবাজারে। বিশ্ববাসীর কাছে তো আমরা আমাদের কক্সবাজারকে তুলে ধরতে পারিনি। আবার যে কয়কজন বিদেশিও বা আসবে কেন আসবে? আপনি ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া যান। মুসলমান দেশ হওয়া সত্ত্বেও পর্যটনের বেলায় সব সুবিধা রেখেছে তারা। এমনকি সৌদ আরবও যেখানে তার দরজা উম্মুক্ত করছে বিদেশিদের জন্য সেখানে আমরা এখনো বসে আছি মান্ধাতা আমলে। আমরা বিনোদনের জন্য কী করেছি? আবার লোকে যে প্রকৃতি দেখতে আসবে সেই প্রকৃতিও তো ধ্বংস করছি আমরা।
আচ্ছা বিদেশির কথা বাদ দিলাম। দেশে শান্তিতে ঘোরার জন্যও কক্সবাজার কী খুব স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা? মোটেও না। হোটেল খরচ ভয়াবহ বেশি। শহরটা ধুলাময়। কোথাও নির্জনতা নেই। খালি হোটেল আর হোটেল। আর দশ লাখ রোহিঙ্গা আসার পরে তো কথাই নেই। এখন বিল্ডিং বানানো আর ভাড়া দেওয়া তো বিরাট ব্যবসা! প্রকৃতির দরকার কী!
অবশ্য শুধু কক্সবাজার কেন? সারা দেশেই আমাদের পযর্টনগুলোর বেহাল দশা! বহুবার বলেছি আমাদের সম্পদের ঘাটতি নেই, আমাদের সংকট ব্যবস্থাপনার। আমি জানি না কথাগুলো কেন লিখি! আমি জানি না কক্সবাজার নিয়ে আমরা কতোটা ভাবছি, কতোটা করছি!
আমি এখনো বিশ্বাস করি কক্সবাজারটা ঠিক করা সম্ভব। বড় বড় হোটেল বাদ দিয়ে ১২২ কিলোমিটাররের পুরো সৈকতজুড়ে ইকো রিসোর্ট টাইপ হতে পারতো! মানুষজন দেখতো প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, উচ্ছ্বসিত সমুদ্রতরঙ্গ, ঝাউবন, পাহাড়। রাতে সাগরের গর্জন শুনতে শুনতে ঘুমাতে যাওয়া যেতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে শীতের রোদের আলসেমিতে সাগর দেখতে দেখতে বলা যেতো, শুভ সকাল কক্সবাজার। শুভ সকাল বাংলাদেশ!