হত্যা নাকি আত্মহত্যা: দ্য কিউরিয়াস কেস অফ সালমান শাহ্!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নিঠুর এই পৃথিবী থেকে অভিমানী মানুষটিকে অকালে চলে যেতে হয়েছে। ঝরে গিয়েছে বাংলাদশের আকাশের সবচেয়ে প্রতিভাশালী ও উজ্জ্বল নক্ষত্রটিকে। আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা কিংবা দুর্ভাগ্য...
পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেন চিত্রনায়ক সালমান শাহ, এমন তথ্য উঠে এসেছে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে। চলতি বছর ২৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ সব তথ্য জানান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এর প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, চিত্রনায়ক সালমান শাহ পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেছেন। হত্যার অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি।
প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তুলে ধরে এই তদন্তের ফল প্রকাশ করা হয়। সালমান শাহর আত্মহত্যার পেছনে ‘৫ কারণ’ পেয়েছে পিবিআই। সেখানে নায়ক সালমানের আত্মহত্যার পাঁচটি কারণ তুলে ধরা হয়। প্রথম কারণ, সালমান শাহ ও চিত্রনায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা। দ্বিতীয় কারণ, স্ত্রী সামিয়ার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ। তৃতীয় কারণ, মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়ার বা আত্মহত্যার চেষ্টা। চতুর্থ কারণটি হলো, মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা- জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জিভূত অভিমানে রূপ নেয়া। নায়ক সালমানের আত্মহত্যার পঞ্চম কারণ হিসেবে পিবিআই উল্লেখ করেছে, সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।
এ তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘আমরা সালমান শাহ্ এর সুইসাইড নোট পেয়েছি। সুইসাইডাল নোট বিষয়ে হস্তলিপি বিশারদ জানান, এটি সালমান শাহ্ এর হাতে লেখা।’ সালমান তার সুইসাইড নোটে লিখেন, ‘সালমান শাহ আমি চৌ. মো. শাহরিয়ার। পিতা কমরুদ্দীন আহমেদ আহমেদ চৌধুরী। ১৪৬/৫, গ্রীণ রোড ,ঢাকা #১২১৫ ওরফে সালমান শাহ। এই মর্মে অঙ্গিকার করছি যে- আজ অথবা আজকের পরে যে কোনো দিন। আমার মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। সেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আমি আত্মহত্যা করছি।’
এদিকে পিবিআইয়ের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে সালমানের পরিবার, শিগগিরই পুনরায় তদন্তের আবেদন জানাবেন তারা। আপত্তি জানিয়ে সালমান শাহ্ এর মামা আলমগীর কুমকুম দাবি করেন, সালমান শাহকে নিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন দিয়েছে পিবিআই। এ প্রতিবেদন নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। আমার প্রশ্ন হলো সালমান শাহ হত্যা মামলার রাজসাক্ষী তার মামি শাশুড়ি রুবি সুলতানা। তাকে যখন সিআইডিতে তলব করে, তার কোনো প্রশ্নের উত্তর নেওয়া হয়নি। তার উত্তরগুলো দিয়ে দিচ্ছিলেন সামিরার বাবা শফিকুল হক হীরা। রুবি সুলতানা এখন আমেরিকায়। পিবিআই কি তার সাক্ষ্য ছাড়াই তদন্ত প্রকাশ করতে পারে? এ তদন্তে অনেকে ভুল আছে। তদন্তকারী দলের গাফিলতি আছে। যার কারণেই তারা তাদের মনগড়া প্রতিবেদন দিয়ে বলছে, সালমান শাহ নাকি আত্মহত্যা করেছে। এখন হত্যার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য আত্মহত্যা বলা হচ্ছে। ন্যায়বিচারের জন্য আমরা উচ্চ আদালতে যাবো।’ তিনি আরও বলেন, ‘সালমানের মা নীলা চৌধুরী অসুস্থ। লন্ডনে আছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে আইনজীবীর মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ নিব আমরা।’
‘আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কিসের জন্য আমার নাম জড়ানো হচ্ছে! সালমান যদি আত্মহত্যাও করে, তাহলে আমার কারণে কেন করবে! আমার নামটা জড়ানোর আগে সবারই একবার ভাবা উচিত। সালমান শুধুই আমার নায়ক ছিল, সহশিল্পী ছিল, বন্ধু ছিল, এর বাইরে আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমি আগেও বলেছি, তাকে আমি ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। তার সঙ্গে আমার ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল।’ পিবিআই তদন্তে সালমান শাহর আত্মহত্যায় শাবনূরকে নিয়ে দ্বন্দ্বের জের প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিতে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন চিত্রনায়িকা শাবনূর।
এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে সালমান খুনে অভিযুক্তরা সব দায় থেকে মুক্ত হলেন। পিবিআইয়ের এই প্রতিবেদনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সালমান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি অভিনতো আশরাফুল হক ডন। তিনি জানান, অবশেষে বন্ধু সালমান হত্যার মিথ্যে অভিযোগ থেকে মুক্ত হলাম। এদিকে কথিত গডফাদার আজিজ মোহাম্মদ ভাই এর কোনো খবর নেই। তিনি সগৌরবে গা ঢাকা দিয়েছেন আগেই।
এবার আসি কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনায়। একজন সাধারণ মানুষ কিংবা সালমান শাহ্ এর গুনগ্রাহী হিসেবে মনে করি- এই তদন্তের আলাপ করে লাভ নেই আসলে। সালমান শাহ্ এর ভক্তরা কখনোই এই প্রতিবেদন মেনে নেবে না। মেঘনা গুলজারের তালওয়ার সিনেমাটি যারা দেখেছেন তার খুব সহজেই বুঝতে পারবেন হত্যাকান্ডের পর ক্রাইমসিন থেকে কিভাবে এভিডেন্স ম্যানিপুলেট করা যায়। শশুড়বাড়ির সাজানো নাটকেই কি শেষ পর্যন্ত ফেঁসে গেলেন সালমান সেই সত্যটা আমরা হয়তো কখনও জানবো না। সালমানের মৃত্যু এমন একটি মিস্ট্রি যা কখনোই সল্ভ হবে না। সালমান নিজে এসেও এখন যদি বলে তাকে খুন করা হয়েছে বা সে নিজেই নিজেকে মেরে ফেলেছে। কোনটাই কেউ আর বিশ্বাস করবে না। সবাই যে তার থেকেও বেশি জানে এখন। তার সিনেমার নাম ছিলো সত্যের মৃত্যু নেই। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, তার সত্যের মৃত্যু হয়ে গেলো।
সালমান শাহ্ এর মৃত্যুর পরের কথা। তার মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ পর মুক্তি পেলো "সত্যের মৃত্যু নেই"। ১৯৯৬ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর। মুহুর্তের মধ্যে সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেলো, টিকেটের জন্য হাহাকার করে বেড়াতে লাগলো সালমানের শোকে পাথর হয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষ। সারা বাংলাদেশের সিনেমাহলগুলোতে মানুষের ঢল নামলো, ঠিক তার প্রথম চলচ্চিত্র "কেয়ামত থেকে কেয়ামত" এর মতই। তখন পর্যন্ত অনেককে কোনভাবেই বিশ্বাস করানো যায়নি যে, সালমান শাহ্ মারা গেছেন। তাই "সত্যের মৃত্যু নেই" সিনেমায় হলে যখন সালমানের প্রথম এন্ট্রি ঘটলো, তখন কেউ খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন, কেউ তার পাশেরজনকে ধরে পাগলের মতই বলতে লাগলেন, বলছিলাম না আমাদের সালমান শাহ্ মরে নাই, বলছিলাম না! আবার অনেককেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে দেখা গিয়েছিলো সিনেমা হলেই। আবার কাউকে দেখা গেল একেবারে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। সালমানের মৃত্যুতে তার ভক্তদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। একজন নায়ক কতটা অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে গেলে তার মৃত্যুর পরেও তাকে ঘিরে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়!
একইসাথে বিরক্তি, হাস্যরস, গভীরতা, কিছুটা কপট অভিমান, রাগ সব কিছু কি নিখুঁতভাবে তার অভিনয়শৈলী দ্বারা পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন এই ক্ষণজন্মা মানুষটি! নব্বইয়ের দশকে যখন অতি অভিনয়ের প্রচলন ছিল, জোরে জোরে চিৎকার করে কথা বলা, অতিরঞ্জিতভাবে মুখভঙ্গি করাকেই সিনেমার জন্য যথাযথ অভিনয় বলা হতো, সেই সময় প্রথার বাইরে গিয়ে তিনিই একমাত্র ছিলেন যিনি সহজাত, সাবলীল অভিনয় নিয়ে এগিয়ে আসেন। আমরা সাধারণত যখন তার কথা স্মরণ করি সবার আগে তার ফ্যাশন সেন্স আর স্টাইল এর প্রশংসা করি।
অথচ তার যে অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা ছিল, এতো ক্ষুদ্র সময় কাজ করেও যে তিনি একটা অন্যরকম শক্তিশালী, জাদুকরী ও অতীব হৃদয়গ্রাহী ছাপ ছেড়ে যেতে পেরেছেন সেটা আমরা কখনো বড়ো পরিসরে তুলে ধরি না। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ক্যারিয়ার, ২৭ টি সিনেমা। যার কোনটিই সেইরকম গল্পভিত্তিক বা মিনিংফুল সিনেমা নয়। যে ধরণের মেইনস্ট্রিম সিনেমা তিনি করেছেন সেগুলোতে কোনো অভিনেতার পক্ষে নিজেকে শক্তিশালী পার্ফরমার বা তুখোড় অভিনেতা হিসেবে প্রমান করা সম্ভব নয়। সিনেমার ইতিহাস ঘেঁটে দেখে নিন- প্রথা এটাই যে বাণিজ্যিক ছবির নায়ক নায়িকাদের ষ্টার বলা হয়, দুর্দান্ত অভিনেতা নয়!
আমরা সালমান শাহকে অত দিন পাইনি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে অভিমানী এই মানুষটিকে অকালে চলে যেতে হয়েছে। ঝরে গিয়েছে বাংলাদশের আকাশের সবচেয়ে প্রতিভাশালী ও উজ্জ্বল নক্ষত্রটিকে। যে মানুষটি একটিও 'তথাকথিত' ভালো গল্পের আর্ট ফিল্ম করে যেতে পারেননি, বাণিজ্যিক ধারার সিনেমার গতানুগতিক ধারার মধ্যেই যাকে কাজ করতে হয়েছে তার মধ্যেও যে তিনি তার করা প্রতিটা দৃশ্যকে আলাদা করে ভালো লাগার মতো, মুগ্ধ হওয়ার মতো, রুচিবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে গিয়েছেন, এর জন্য তার প্রতি অফুরান ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা থাকবে আজীবন। কতটা গুণী হলে মানুষ এভাবে নিজেকে বারবার প্রমান করতে পারে সেটা ভেবে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। আমরা তাকে বেশি সময় পাইনি, যেটুকু পেয়েছি তাতে খুব বেশি কাজেও লাগাতে পারিনি। সেটা আমাদের ব্যর্থতা কিংবা দুর্ভাগ্য বলা যায়।
যে দেশে অসংখ্য মানুষ আজও সালমান শাহকে প্রবলভাবে ভালোবাসে, অসংখ্য সিনেমাবোদ্ধা এবং সমালোচকেরা আছেন- সেখানে আজ তার মৃত্যুর ২৪ বছর পর তাকে আমাদের শুধু ভালোবাসাই আছে কিন্তু কোনও গবেষণা নেই কেন? এই গবেষণাগুলো থাকলে আরও আগেই হয়তও আমরা তার মৃত্যু রহস্য উন্মোচন করতে পারতাম, সেই চেষ্টা অন্তত করতে পারতাম। সালমানের অনুপস্থিতিতে পুরো ইন্ডাস্ট্রিই মুখ থুবড়ে পড়তো না। ২০০০ পরবর্তী চরম অশ্লীলতা আর নোংরা নগ্নতার স্রোতে তলিয়ে যেত না। শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন ছিল শুধুই পরিবারের। কিন্তু তিনি যখন সালমান শাহতে পরিণত হলেন, তখন তিনি পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ। প্রযোজক-পরিচালকদের জন্য হয়ে ওঠেন পরম নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু সেই নির্ভরতার ক্ষেত্র কেন অকালে ধ্বংস হয়ে গেল, তার কারণ আজও অস্পষ্ট। আর এই নির্ভরতার জায়গা ধ্বংস হওয়ায় আমাদের চলচ্চিত্র কত যুগ পেছনে চলে গেছে, সেটা আর না বলে দিলেও চলছে।
এই ঘর এই সংসার সিনেমায় সালমান একটা সংলাপ বলেছিলেন। যেটা এ মুহূর্তে খুব বেশি মনে পড়ছে, 'ইয়া আল্লাহ! এ কোন সাইজ তুমি আমার কপালে দিলে?' এভাবেই আমাদের এই স্বপ্নের নায়ক, সেই ‘ভালো আছি ভালো থেকো’র কথামালায় চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন স্মৃতির অতল গহীনে। আমাদের ভালোবাসা এবং হতাশায় মিশে থাকবেন প্রিয় সালমান শাহ্!