বাংলাদেশের 'সোনালী আঁশ' পাঁট আজ বিগত অতীত। পাঁট দিয়ে তৈরী পণ্যগুলোও আজকাল খুব বেশি আলোচনায় নেই। এরকম এক সময়ে বাংলাদেশের এক প্রকৌশলী এলেন অন্যরকম এক সাইকেলের মডেল নিয়ে; যে সাইকেল হবে পুরোটাই পাঁটের!

বাংলাদেশে পাটকে বলা হয় 'সোনালী আঁশ।' একটা সময় পাটই ছিলো এ দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। কিন্তু সেই সময় এখন আর নেই। বছরের পর বছর ধরে দেশের পাটকলগুলো লোকসানের মাশুল গুনতে গুনতে ফতুর হয়ে গিয়েছে। এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাটের তুমুল চাহিদা আছে। কিন্তু সেসব দেশের মানুষ জানেও না, পাট আসলে বাংলাদেশের পণ্য। বাংলাদেশ থেকে ভারতে নামমাত্র মূল্যে পাট রপ্তানি হয়ে 'ভারতীয় পণ্য' হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে। যদিও এ আক্ষেপের গল্প বলে লাভ নেই। কথায় কথা বাড়ে। বরং আজ কথা বলা যাক বাংলাদেশের এক তরুণ প্রকৌশলীকে নিয়ে, যিনি 'সোনালী আঁশ' পাটকে ব্যবহার করে বানিয়েছেন সাইকেল। না, ভুল পড়েননি, সাইকেলই লিখেছি। এই তরুণ প্রকৌশলী স্বপ্ন দেখছেন, বাংলাদেশের 'পাঁটের সাইকেল' সারাবিশ্বে নাম কুড়োবে। আমরা আজকে জানার চেষ্টা করবো 'পাঁটের সাইকেল' বস্তুটি আসলে কী, সেটা নিয়েই। 

নোমান সৈকত পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কর্মজীবনের প্রথম দিকে নয়টা-পাঁচটার একটা চাকরী করছিলেন। বেশ ভালোই কাটছিলো সব। কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে তিনি হুট করেই শুরু করেন সাইকেল তৈরীর কারখানা৷ তিনি ভেবে দেখলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এসে মানুষ কাস্টমাইজড ডিজাইনেরই সবকিছু কেনে। মোবাইলের কাভার থেকে শুরু করে জামাকাপড়...সবকিছুই নিজের ইউনিক পছন্দ অনুযায়ী কাস্টমাইজ করে বানিয়ে ব্যবহার করতে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু সাইকেলের বেলাতে এসেই মানুষ কেন যেন টিপিক্যাল ডিজাইনের রেডিমেড সাইকেল কিনেই খুশি হয়ে যায়। কাস্টমাইজড ডিজাইনের কথা ভাবেও না। ঠিক এখান থেকেই আইডিয়া পান তিনি। অল্প দামে কাস্টমাইজড সাইকেল বানিয়ে বিক্রির চিন্তা থেকেই চাকরী বাদ দিয়ে সাইকেল বানানোর কারখানা শুরু করেন তিনি। কারখানার নাম দেন- সাইকেল জংশন।

কাস্টোমাইজড সাইকেলের বিভিন্ন মডেল, ডিজাইন নিয়ে গবেষণা করতে করতে তিনি একটি জিনিস ভাবলেন- মানুষ তো সবসময় শক্তপোক্ত অথচ হালকা ফ্রেমের সাইকেলের কথা বলে। কেমন হয় যদি এরকম কিছু পাওয়া যায়। সাইকেলের মেটাল বডির বিকল্প হিসেবে হালকা কিছু হিসেবে ভাবতে ভাবতে তিনি পেয়ে যান- পাঁট। পাঁট দিয়ে যেহেতু ঢেউটিন বানানোর নজির আছে, তাহলে সাইকেলও হতে পারে। এভাবেই পাঁটের আঁশ দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে করে এক সপ্তাহের মধ্যে একটি সাইকেল তৈরী করে ফেলেন তিনি।

পাটের সাইকেল! 

এই সাইকেল বানানোর প্রসেস খুব শক্ত না। পাটের বস্তা বা পাট দিয়ে তৈরী কোনো কাপড়কে সাইকেলের মেটাল ফ্রেমের সাথে রেজিন বা খুব শক্তিশালী আঠা দিয়ে শক্ত করে আটকে এরপর ভেতর থেকে সেই মেটাল ফ্রেমকে বের করে আনলেই পাঁটের ফ্রেম তৈরী হয়ে যায়। পাটের ফ্রেমের সবচেয়ে বড় সুবিধে, হালকা অথচ মজবুত হয় এগুলো। ইচ্ছেমত কাস্টোমাইজও করা যায় এগুলোকে। এগুলো ব্যবহার করলে সাইকেলের দামও দশ থেলে পনেরো হাজারের মধ্যে হয়ে যায়। অর্থাৎ লাভ সবদিকেই। একটা সাইকেলের প্রায় আশি শতাংশ যন্ত্রপাতি ও বডি, পাঁট থেকেই করা যাবে বলে আশাবাদী নোমান। সাইকেলের হ্যান্ডেলবার, সিট পোস্ট, রিম, ফর্কের মতন জিনিসপত্রগুলোও পাঁট থেকে করার ব্যাপারে ইচ্ছে আছে তার।

নোমান সৈকত সামনে কী করবেন, জানা নেই আমাদের। তিনি পাটের মাধ্যমে সাইকেল নিয়ে ঠিক কবে নাগাদ ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনায় যাবেন, সেটাও অনিশ্চিত। তবে তিনি যদি পাট দিয়ে সাইকেল তৈরীর এই কনসেপ্টকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তাহলে কে জানে, হয়তো তার এই উদ্যোগের মধ্য দিয়েই আবার ফিরবে বাংলাদেশের 'সোনালী আঁশ' এর সুদিন। তবে সেজন্যে দরকার অনেক বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা। পাঁটের তৈরী এই বাহন কতটুকু পরিবেশবান্ধব, শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হবে, যাছাইবাছাইয়ের প্রচুর 'যদি-কিন্তু' আছে সেখানেও।

এই উদ্যমী প্রকৌশলীর জন্যে শুভকামনা রইলো। উদ্যোগটি সফল হবে কী না, জানা নেই আমাদের। তবে অন্যরকম এক চিন্তাভাবনার জন্যে হলেও তাকে ধন্যবাদ জানানো অবশ্যই উচিত।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা