আমাদের সবার মাঝে সটু কিংবা ড্যান আছে, এই সত্তাটিকে আমরা জাগ্রত হতে দেই কম। পুরুষ মানুষ কাঁদে না, একপাক্ষিক ভালোবাসার কোনো মানে হয় না, ও পারে তুই কেন পারিস না এসব কথার মাঝে হারিয়ে ফেলি আমরা এই সত্তাকে।

নিচে ছবির প্রথম অংশটি ‘অ্যা ডেথ ইন দ্য গাঞ্জ’ সিনেমার স্ক্রিপ্ট থেকে। নান্দু আর বনির কথোপকথন সটুকে নিয়ে। সটু কে? এই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র বললে এই চরিত্রকে বাড়তি ভার দেয়া হবে, যা সিনেমাজুড়ে এই ক্যারেক্টারকে কেউ দেয়নি। তাই খামাখা গৎবাঁধা নাম দিয়ে লাভ নেই। সটু একটা ইন্ট্রোভার্ট ছেলে। তার বাবা গত হয়েছেন কিছুদিন আগেই। মা আছে তার। পড়াশুনায় তেমন একটা ভালো না সটু। 

মাক্লাসকিগঞ্জে ঘুরতে এসেছে সে আত্মীয়দের সাথে, যাদের একটাই কাজ কীভাবে সটুকে অপদস্থ করা যায়। সটুও চুপচাপ মুখ বুজে সব সহ্য করে। কিন্তু মনের ভেতর তার ক্ষত বড় হতে থাকে। তার সঙ্গী হয় ছোট বাচ্চা, নইলে বাবার পোকা খাওয়া সোয়েটার। যে সোয়েটার সটু গায়ে জড়িয়ে রাখে সবসময়। সে সোয়েটার নিয়েই কথা ওঠে নান্দু আর বনির মাঝে। কেন সে সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে রাখে সটু? এত বড় ছেলে কই মায়ের দায়িত্ব নেবে, তা না করে এখনো মৃত্যুশোকে ডুবে আছে। এর চেয়ে অল্প বয়সেও ছেলেমেয়েরা বাবা-মা হারা হয়। ওরা সামলে নিতে পারলে সটু কেন পারবে না?

দুটি আলাদা সিনেমার অংশ, কিন্তু মিলটা যেন এক জায়গাতেই! 

মূলত আমাদের সমাজের সামগ্রিক ধ্যান ধারণার প্রতিভূ বনি, নান্দুরা। আমরা তুলনা দেয়ায় বিশ্বাসী। মনের মাঝে হীনমন্যতা সৃষ্টি করতে আমাদের জুড়ি নেই। সটু বাদ পড়বে কেন? ইন্ট্রোভার্ট, চুপচাপ ছেলে তো কী হয়েছে? দায়িত্ব নিতে হবে, পুরুষ হতে হবে। সিনেমার এক পর্যায়ে এসে মিমির মুখে সটুকে শুনতে হয়- তুমি এতো সুন্দর, যে তুমি মেয়েও হতে পারতে।

ছবি আঁকা, বই পড়া, মৃত বাবার সোয়েটার নাকে ঘষা সটু ঠিক আমাদের চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাথে যায় না হয়তো। টক্সিক ম্যাসকুলানিটির রোষানলে পড়ে সটুর স্বাভাবিক সত্তা বিলীন হয়ে যেতে নেয় নিয়মিত বুলিং আর প্র্যাঙ্কের ফাঁদে পড়ে। সটুর মেলানকোলিয়ার পুরোটা জুড়েই সে পোকা খাওয়া সোয়েটার। সোয়েটার আর সটু যেন অবিচ্ছেদ্য। বাবার ঘ্রাণ পেতে, বাবার স্পর্শ পেতে সটুর সম্বল ওটুকুই। যে সটু পিঁপড়েরা মারা গেলে কবর দেয় মাটি দিয়ে সে সটুকে মাটিতে মিশিয়ে ফেলতে দেরি হয়নি সমাজের। বন্দুকের গুলি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে সটু। পোকা খাওয়া সোয়েটারে লেগে থাকে লাল ছোপ ছোপ রক্ত। পারিবারিক নীল অ্যাম্বাসাডর গাড়ির ট্রাঙ্কে আশ্রয় হয় তার মৃতদেহের। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি  

ওদিকে ছবিটির দ্বিতীয় অংশে অক্টোবর সিনেমার স্ক্রিপ্ট থেকে একবারে শেষ সিনের বর্ণনা। শিউলি মারা গেছে কিন্তু ড্যান শিউলির অংশকে আলাদা করতে চায়নি। শিউলির বাড়ির শিউলি ফুলের গাছটি সে নিয়ে যেতে চায় যখন শিউলির পরিবার শিউলির মৃত্যুর পর শহর ছেড়ে চলে যায়। শিউলি নেই, শিউলি যে ছিল এমনও না। জীবন্মৃত অবস্থায় শিউলির সাথে অবোধ্য একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয় ড্যানের। শুধু ভালোবাসা বললে কম হয়ে যাবে, সমর্পণ বলা যেতে পারে। তাও কি বোঝানো হয়? 

বোঝার দরকারও নেই আসলে, যার যার ভালোবাসা, যার যার সমর্পণ তার তার কাছে। শিউলির প্রতি ড্যানের সমর্পণ দুর্বোধ্য বটে, কিন্তু মেনে নিতে কষ্ট হয় না। আমাদের মনে হয় যে হ্যাঁ ড্যান ঠিকই করছে। শিউলি যখন মারা যায় তখন অতো বেশি আফসোস লাগে না ড্যানের জন্য যে আহা সে তো আর ভালোবাসা পেল না বিনিময়ে। ড্যান আসলে আশাই করেনি, আশা করিনি আমরাও। 

শিউলি বাঁচবে আশা ছিল, কিন্তু মরে গেলেও শিউলিকে দোষারোপ করার সুযোগ ছিল না। কারণ ঐ যে ড্যানই সে সুযোগ তৈরি হতে দেয়নি। সে শিউলির জন্য শুধু করেই গেছে, শিউলির প্রিয় শিউলি ফুলের গাছকে যখন আমরা শেষ দৃশ্যে দেখি ড্যান জড়িয়ে ধরে আছে, তখন মনে হয় শিউলিকে নিয়েই যেন বাড়ি ফিরছে ড্যান। তার শিউলি, যাকে এতদিন ধরে সে যত্নে লালন করেছে।

অক্টোবর সিনেমার ড্যান 

ভালোবাসার সম্পর্কগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিনিময় চুক্তি থাকে অলিখিত। আমরা স্বীকার করি না, কিন্তু একপাক্ষিক ভালোবাসার মাঝেও চাহিদা থাকে, থাকে আশা। ড্যানের ভালোবাসার মাঝে পুরোটাই ছিল সমর্পণ, ছিল বাঁচিয়ে তোলার আকুতি। আমি নিশ্চিত শিউলি বেঁচে ফিরলে যদি ড্যানকে বলতো তুমি যাও তোমার স্বাভাবিক জীবন যাপন করো, ড্যান করতে পারতো। সে হয়তো উল্টো ফিরে তাকাতো, জিজ্ঞেস করতো যে কেন আমাকে ফিরিয়ে দিলে। কিন্তু শিউলি যদি উত্তর নাও দিত, ড্যান সেটি নিয়ে দ্বিধা করতো না। ড্যানের মাঝে ছেলেমানুষি আছে, ম্যাচিওরডও ঠিক বলা যাবে না। কিন্তু ড্যান ভালোবাসতে জানে, এরকম ভালোবাসতে জানি আমরা ক’জন?

সটু আর ড্যান মিলে যায় তাদের বিষণ্ণতার মাঝে। দুজনের চোখ দেখলেই বোঝা যায় চোখভর্তি বিষণ্ণতা, প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট। কিন্তু তারা ডুকরে কেঁদে ওঠে না। হুট করে চোখে জল জমে যেতে পারে, পাশের মানুষরা দেখেও অদেখা করতে পারে, কিন্তু তারা তাদের বিষণ্ণতায় কাউকে ভাগ দেয় না। সটুকে কিংবা ড্যানকে আলাদা করে ভিড়ের মাঝে চোখে পড়বে না, ওরা আমাদের মতোই সাধারণ। 

 অ্যা ডেথ ইন দ্য গাঞ্জ সিনেমার সতু

ওদের দুঃখগুলো আমাদের মতো, সুখগুলোও আমাদের মতো। ওরা অসাধারণ হয়ে ওঠে ওদের বিষণ্ণতায়, আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টায়, ওদের নীরবতায়, ওদের সরলতায়। আমাদের সবার মাঝে সটু কিংবা ড্যান আছে, এই সত্তাটিকে আমরা জাগ্রত হতে দেই কম। পুরুষ মানুষ কাঁদে না, একপাক্ষিক ভালোবাসার কোনো মানে হয় না, ও পারে তুই কেন পারিস না এসব কথার মাঝে হারিয়ে ফেলি আমরা এই সত্তাকে। 

তবুও মাঝে মাঝে পছন্দের কোনো বিষণ্ণ গান শুনে রিকশায় বসে কাউকে কাঁদতে দেখলে, আধুনিক ছেলের পকেট থেকে পুরনো রুমাল বের হতে দেখলে, বইয়ের আড়াল থেকে শুকনো ফুল পড়তে দেখলে, নব্বইয়ের পুরনো কোনো গান শেয়ার করতে দেখলে, লেখা মুছে যাওয়া শতচ্ছিন্ন চিঠি ড্রয়ারে আবিষ্কার করলে ভালোবাসার চোখে তাকাবেন, সামনের মানুষের বিষণ্ণতাকে আপন করে নেবেন পারলে। ড্যান আর সটুর মেলানকোলিয়ায় ডুব লাগাবেন। কতো দুঃখ পুষে বাঁচি আপনি-আমি, বিষণ্ণতায় ভয় কী?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা