ছবিতে যে ফুটফুটে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছেন, ওর নাম দিশা। বয়স মাত্র নয় বছর, বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায় মেয়েটা, খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কিন্ত ওর বোধহয় ডাক্তার হওয়া হবে না কখনও, কারণ দিশা যে 'পতিতাপল্লীর মেয়ে'!
কে জানে, কয়েক বছর পরে হয়তো ছোট্ট এই মেয়েটাই ঠোঁটে লিপস্টিক আর মুখে কড়া মেকাপ লাগিয়ে দৌলতদিয়ার কোন এক খুপড়ি ঘরে কাস্টোমারের মনোরঞ্জনের অপেক্ষায় বসে থাকবে! রাজবাড়ি জেলার একটা গ্রাম দৌলতদিয়া, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতিতা পল্লীটা এখানেই অবস্থিত। প্রায় ষোলশো নারী প্রতিদিন এখানে যৌনতার খোঁজে আসা হাজার তিনেক পুরুষের মনোরঞ্জন করেন। এটাই ওদের কাজ, রুটিরুজির একমাত্র পেশা। শরীরটাকে বিক্রি করেই বেঁচে থাকে ওরা।
এদের মধ্যে কেউ হয়তো শিশুকালে অপহৃত হয়েছিল, কাউকে হয়তো পরিবারের কোন সদস্য বা প্রেমিক এখানে এনে বিক্রি করে দিয়েছে, কেউবা প্রতারক প্রেমিকের হাতে স্বর্বস্ব খুইয়ে পতিতার জীবন বেছে নিয়েছেন, কারণ তাদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। দৌলতদিয়ায় মেয়েদের আসার রাস্তাটা খোলা, কিন্ত এখান থেকে ফেরার কোন রাস্তা নেই। এখান থেকে কেউ ফিরতে পারে না, ফিরতে চাইলেও আমাদের সমাজ তাকে ফিরিয়ে নেয় না কখনও।
বছর তিনেক আগে মায়ের সঙ্গে ট্রেনে চড়ে কোথাও যাওয়ার সময় হারিয়ে গিয়েছিল দিশা, রেলস্টেশন থেকে কেউ একজন নিয়ে এসেছিল দিশাকে, তার ঠাঁই হয়েছিল দৌলতদিয়ায়। এখানে সালেহা নামের এক মহিলা তাকে আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন, স্কুলে ভর্তি করেছেন। তাকেই দিশা নতুন মা বলে ডাকে। এখানে থাকতে একটুও ভালো লাগে না দিশার। চায়ের দোকানে বসে থাকা বয়স্ক লোকগুলো ওকে ডাকে, সুযোগ পেলেই গায়ে হাত দেয়, অশ্লীল ইঙ্গিত করে, এখানে আসা পুরুষেরা চোখ দিয়ে গিলে খেতে চায় ছোট্ট দিশাকে। পালক মা'কে নিয়ে এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে চায় দিশা, কিন্ত বিশাল এই দুনিয়ায় ওদের যাওয়ার কোন জায়গা যে নেই। আসল বাবা মা কোথায়, সেটা দিশা জানে না, তাদের চেহারাও মনে নেই এখন আর।
মেঘলা আর রুনার জন্ম এখানেই, ওদের নানী পতিতাবৃত্তি করতো, মা-ও একই পথে হেঁটেছিলেন। স্থানীয় একটা স্কুলে পড়ে রুনা, সেখানে প্রতিনিয়ত অপমান আর গালমন্দ সইতে হয় ওকে, কারণ ওর জন্ম পতিতালয়ে! এটা যেন রুনার অপরাধ! বড়বোন মেঘলা প্রতিদিন রুনাকে স্কুলে দিয়ে আসতে যায়, কেউ যদি পতিতার মেয়ে বলে রুনাকে মারধর করে, এই ভয়ে! পতিতাপল্লী থেকে বাইরে গেলে সারাক্ষণই আতঙ্কে কাটাতে হয় তাদের, এই সমাজ তো রাতের মনোরঞ্জন ছাড়া আর কোন ব্যাপারেই ওদের স্বীকৃতি দিতে চায় না।
দৌলতদিয়ায় মেয়েদের পতিতাবৃত্তির হাতেখড়ি হয় মাত্র ১৪ বছর বয়সে! অল্পবয়েসী মেয়েদের চাহিদা বেশি, আর তাই বাচ্চা মেয়েগুলোকে নামানো হয় পতিতাবৃত্তিতে। মাত্র দুইশো টাকার বিনিমিয়ে শরীর বিক্রি করতে বাধ্য হয় এখানকার মেয়েগুলো। পতিতাবৃত্তির কাজে নামতে না চাইলে নেমে আসে অকথ্য অত্যাচার। দশ বছরের মুন্নীকে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহরণ করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল দৌলতদিয়ায়, সে আর কখনও বাড়ি ফিরে যেতে পারেনি। চকলেটের লোভ দেখিয়ে তাকে এখানে এনে বিক্রি করে দিয়েছিল এক মহিলা।
সিনেমার মুন্নীর জন্যে একজন বজরঙ্গী ভাইজান ছিলেন, কিন্ত বাস্তবের মুন্নীর জন্যে উদ্ধারকর্তা হয়ে আসেনি কেউ। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার রাস্তাটা ছোট্ট মুন্নীর পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি তাই। মুন্নীর বয়স এখন ত্রিশ, গত দেড়যুগ ধরে হাজারো কাস্টোমার সামলেছে সে, এক সন্তানের মা হয়েছে। মুন্নী কখনও চায়নি তার সন্তান তার মতো হোক, এই পরিবেশে বেড়ে উঠুক। আর তাই সন্তানকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে সে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়, খারাপ লাগলে স্কুলে গিয়ে সন্তানকে দেখে আসে। কিন্ত এখানকার নোংরা পরিবেশে সন্তানকে আনার কথা সে ভাবতেও পারে না।
প্রায় সাড়ে তিনশো শিশু বাস করে দৌলতদিয়ায়, যাদের বয়স বারো বছরের নিচে। ওদের বেঁচে থাকার জন্যে ভালো কোন পরিবেশ নেই, একটা ভালো স্কুল নেই, নেই কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকও। ওরা বেড়ে ওঠে রাস্তাঘাটের কুকুর-বেড়ালের মতো লাথি-গুতো আর বিশ্রী সব গালাগালি খেয়ে, আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কর্কশ আর অমানবিক ওদের জীবন। সেই জীবনে ফেসবুক নেই, ইউটিউব নেই, আছে কাস্টোমারের নগ্ন শরীর আর কামুক হাসি।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, রেমিট্যান্সে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশ। পদ্মাসেতু হচ্ছে, মেট্রোরেল চালু হবে, উন্নতির পথে হাঁটছি আমরা। কিন্ত দিশা, মেঘলা বা রুমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না, ওরা বেঁচে আছে দৌলতদিয়ার সেই নোংরা, ঘিঞ্জি আর অস্বাস্থ্যকর জায়গাটায়। ওদেরও পড়তে ইচ্ছে করে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে ইচ্ছে করে, কিন্ত দিনশেষে ওরা শুধু পতিতার খাতাতেই নাম লেখায়, কারণ ওদের কথা ভাবার সময় যে কারো নেই!
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- দ্য গার্ডিয়ান।