কোন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নয়, হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার উদ্যোগ বাংলাদেশে সর্বপ্রথম নেয়া হলো একটা মাদ্রাসা থেকেই। এখানে বিমামূল্যে থাকা-খাওয়ার সাথে পড়াশোনা করা যাবে...

ধানমন্ডি লেকে হাঁটার সময় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের চাহিদার খপ্পরে পড়েননি, এমন লোকজন বোধহয় পাওয়া যাবে না। এদের চাহিদা খুব বেশি থাকে তা বলা যাবে না, দশটা টাকা হাতে গুঁজে দিলেই এরা খুশি হয়ে ইংরেজীতে একটা 'থ্যাংকস' দিয়ে চলে যায়। সঙ্গে প্রেমিকা বা বান্ধবী থাকলে অবশ্য এদের আবদারও একটু বাড়তি থাকে। এরকমই টাকা চাইতে আসা তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তিকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা চাকরি করেন না কেন? লোকটা ভীষণ শুদ্ধ ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন- 'আমাদেরকে কে চাকরি দেবে ভাইয়া? আমরা তো পড়ালেখা করিনি।' 

আমি এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, টাকা চাইতে আসা তৃতীয় লিঙ্গের ওই ব্যক্তিটি যত সুন্দর করে লাইনটা উচ্চারণ করেছিলেন, আমার পক্ষে কখনোই এত চমৎকারভাবে কথা বলা সম্ভব হবে না। যে কোন রেডিও স্টেশনের আরজে হওয়ার সামর্থ্য আছে তার। কিংবা কল সেন্টারের চাকরি, অথবা কোন কর্পোরেট অফিসের রিসেপশন বা ফ্রন্ট ডেস্কে সামলানোটাও খুব একটা কঠিন ব্যাপার হবে না তার জন্য। কিন্ত সমস্যা দুটো। এক হচ্ছে তিনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, আমাদের সমাজ একজন 'হিজড়া'কে এসব জায়গায় 'অ্যাক্সেপ্ট' করে নিতে প্রস্তুত নয় এখনও। দ্বিতীয় সমস্যাটা তিনি নিজেই বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তার, এই জায়গাটায় অন্য যে কোন ক্যান্ডিডেটের চেয়ে স্বভাবতই পিছিয়ে থাকবেন তিনি। 

বিবিসি বাংলায় আজ যখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য বিশেষায়িত একটা মাদ্রাসা চালুর খবরটা পড়লাম, তখন সবার আগে ধানমন্ডি লেকের ওই মানুষটার কথা মনে পড়লো আমার। ওই লোকটার মনের মধ্যে আক্ষেপ রয়ে গেছে পড়াশোনা করতে পারেননি বলে, সুন্দর করে কথা বলার যোগ্যতা থাকার পরেও এর ওর কাছে টাকা চেয়ে বেঁচে থাকা লাগছে, কারন তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, নামের পাশে ডিগ্রি নেই, এদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শিক্ষা প্রদানের ব্যাপারে বড় অনুদার; সেটা স্কুল হোক, কলেজ হোক, ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুল হোক অথবা হোক বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শুধু এই মানুষগুলোর জন্য আলাদা একটা মাদ্রাসা চালু হচ্ছে- এই খবরটা শুধু আনন্দেরই নয়, বিস্ময় জাগানিয়াও। 

পড়ালেখার পাশাপাশি এখানে ফ্রি থাকা-খাওয়ার সুযোগও পাবে শিক্ষার্থীরা

রাজধানী ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের লোহার ব্রিজ এলাকায় নির্মিত এই মাদ্রাসাটির নাম রাখা হয়েছে 'দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা'। আগামীকাল শুক্রবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি চালু হবে। হিজড়া, বৃহন্নলা, কিন্নরী বা তৃতীয় লিঙ্গ- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজে এই মানুষগুলো নানাভাবে অবহেলিত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অবাঞ্ছিত। এই জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর লক্ষ্যেই এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মূলত কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী শিক্ষাও দেয়া হবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন। ফলে এখান থেকে পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারিগরী পেশায় যুক্ত হতে পারবেন।

এই মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ বেশ আগে থেকেই হিজড়া জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্যকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, কামরাঙ্গীর চর, সিলেটি বাজার - এমন কয়েকটা এলাকায় শিক্ষা প্রদান করতেন। প্রতিটি এলাকাতেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০-২৫ জন করে। এদের সবাইকে এক ছাদের নিচে আনার উদ্দেশ্যেই এই মাদ্রাসাটি স্থাপন করা হয়েছে। এই শিক্ষার্থীদের পড়াতে ১০জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এবছরের গোড়ার দিকে মাদ্রাসার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। মাঝে করোনার কারনে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, অক্টোবরের শেষ নাগাদ মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গেছে মাদ্রাসাটি। তাই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উদ্বোধন করা হচ্ছে এটি। 

দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসাটি স্থাপন করা হয়েছে একটি তিন তলা ভবনে। এর প্রতিটি তলায় প্রায় ১২০০ বর্গফুট জায়গা রয়েছে। এখানেই সব শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া এবং পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এই মাদ্রাসায় পড়ার ক্ষেত্রে কোন বয়স সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি, অর্থাৎ হিজড়া জনগোষ্ঠীর যে কোন বয়সের মানুষ এই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে পারবেন। আরও চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে পড়াশুনা করতে শিক্ষার্থীদের কোন খরচ গুণতে হবে না। মরহুম আহমদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে মাদ্রাসাটির সব ধরনের কার্যক্রম চলবে। কাজেই 'পড়ালেখা করতে এলে খাবো কি, পেট চলবে কিভাবে'- এমন চিন্তায় থাকতে হবে না কাউকে।

চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি

বাংলাদেশে হিজড়াদের অফিসিয়াল সংখ্যাটা প্রায় দশ হাজার। কিন্ত আজ পর্যন্ত কেউ এই মানুষগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নেয়নি, মূল কর্মস্রোতে টেনে আনার চেষ্টাও করেনি। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্ত তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেছে সেটাও। বাধ্য হয়েই তাই এই মানুষগুলো বিভিন্ন বিয়ে-জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নেচে গেয়ে, অথবা কারও বাড়িতে নতুন শিশু জন্মালে বখশিশ তুলে জীবিকা চালিয়ে থাকেন। কখনও চাঁদা তোলেন, আবার বিয়েবাড়ি বা কোন বাড়িতে সন্তানের জন্ম হলে সেখানে গিয়ে টাকা দাবী করেন। 

পরিবার থেকে শিক্ষাক্ষেত্র, প্রতিটা জায়গায় এদের বিমাতাসুলভ আচরণের সম্মুখীন হতে হয়। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ বা মক্তবে ছেলেমেয়েদের যৌথশিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে হিজড়াদের জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা দেখা যায় না। স্কুল-কলেজে আধুনিক শিক্ষা বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা হয়, আলোচনা হয়, গবেষণা হয়, কিন্ত তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলোরও যে সেই শিক্ষাক্রমে অংশগ্রহণের অধিকার আছে, সেটা কারো মাথায় আসে না। 

হিজড়া জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত

মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধরা হয় দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা শিক্ষাব্যবস্থা। অথচ কোন স্কুল-কলেজ নয়, হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার উদ্যোগ বাংলাদেশে সর্বপ্রথম নেয়া হলো একটা মাদ্রাসা থেকেই। এই মাদ্রাসার মহাসচিব আবদুর রহমান আজাদের একটা কথা খুব ভালো লেগেছে, তিনি বলেছেন- "হিজাড়ারাও ইনসান (মানুষ), আল্লাহর সৃষ্টি। কিন্তু তাদের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা নাই, তাদেরকে কেউ মসজিদে ঢুকতে দেয় না। এ কারণে তারা বাধ্য হয়ে নৈতিক জায়গা থেকে সরে আসছে, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে মানুষকে বিরক্ত করছে। এটা তো ওদের দোষ না। এজন্য আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।" 

এই কথাগুলো অনেক বুদ্ধিজীবী বা এলিট সোসাইটির লোকজনের মুখেও শুনেছি, কিন্ত কেউ এগিয়ে এসে এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ায়নি, আজাদ সাহেবরা দাঁড়িয়েছেন। তাদের জন্য ভালোবাসা এবং শুভকামনা। শুভকামনা এই মাদ্রাসার সব ছাত্রদের জন্যেও। একটু একটু করে পরিবর্তন আসছে, অন্ধকার টানেলের শেষ প্রান্তে একটু আলোর রোশনাই দেখা যাচ্ছে কোথাও। সেই আলোর খোঁজে হলেও পথ চলতে ইচ্ছে হয়। পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই সমাজ, এই দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয়...

তথ্য ও ছবি কৃতজ্ঞতা- বিবিসি বাংলা

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা