চোখ বন্ধ করে একটা ভবিষ্যৎবাণী করে রাখি। এই ডিসি সুলতানা পারভীনের পক্ষে লাইন ধরে একদল বিসিএস ক্যাডার দাঁড়িয়ে যাবেন। তিনি কতবড় বেগম রোকেয়া ইত্যাদির বয়ান আসবে। আরিফুল কতবড় গাঁজার ব্যাপারি সেটার তথ্য বের হতে থাকবে।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন নিজের নামে একটি পুকুরের নামকরণ করেছেন। বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম বিষয়টা নিয়ে ফট করে রিপোর্ট করে দিয়েছেন। আরিফুল এ বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি সাহেব। এছাড়া, সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে ডিসি সুলতানা পারভীনের অনিয়ম নিয়েও প্রতিবেদন তৈরি করেন আরিফুল। 

দুই টাকার সাংবাদিকের এহেন দুঃসাহস, তাও এই সরকারের আমলে? মোছা. সুলতানা পারভীন অনেক সহ্য করেছেন। আর সহ্য করতে না পেরে রাত একটার দিকে হাফ ডজন মেজিস্ট্রেট ও ৭০জন আনসার প্রেরণ করেন দুই টাকার সাংবাদিকের বাসায়। 

ডিসি অফিসের দুই-তিন জন ম্যাজিস্ট্রেট ১৫-১৬ জন আনসার সদস্যকে নিয়ে (পুলিশ নয় কিন্তু) মধ্যরাতে দরজা ভেঙে আরিফুলের বাসায় প্রবেশ করে, আরও ৬০-৭০ জন আনসার সদস্য ছিল বাইরে। এ সময় আরিফুলের বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে বলে তাকে পেটাতে পেটাতে বাসা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়।

আজ সকালে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। আরিফুলের স্ত্রী বলেছেন দরজা ভেঙে আরিফুলকে যখন পেটাচ্ছিল প্রজাতন্ত্রের মেজিস্ট্রেটগণ তখন তারা বলছিলেন-

"তুই অনেক জ্বালাচ্ছিস"

এই বিষয়ে আজ সকালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব বলেছেন, ‘কুড়িগ্রামের বিষয়টি আমাদের জন্য বিব্রতকর। কোনোভাবেই মধ্যরাতে টাস্কফোর্সের অভিযান আইনসম্মত নয়। অবশ্যই টাস্কফোর্সকে সকাল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তাই বিধান রয়েছে। মধ্য রাতে অভিযান ও সাজা দেওয়ার বিষয়টি প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মাঠ পর্যায়ে সরকার ও প্রশাসনের ওপর জনগণের আস্থা কমায় এবং পরিস্থিতি বিরূপ করে তোলে।’

এছাড়া প্রশ্ন উঠেছে রাতে দরজা ভেঙে মোবাইল কোর্ট ঘরে ঢুকতে কিনা তা নিয়ে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসান এমএস আজিম বলেছেন,  রাতে পুলিশ যেতে পারে তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের এভাবে যেতে পারেন না।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন

তিনি বলেছেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে সাজা প্রদানের বিষয়ে কোনও সময়ের উল্লেখ নেই। তবে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত তো আর রাতের বেলা পরিচালনা করতে পারেন না। রাতের বেলা পুলিশ যেতে পারে। আদালত রাতে যেতে পারেন না। এমনকি ঘরের দরজা ভেঙেও ঢুকতে পারেন না। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালত চাইলে সিলগালা করে দিয়ে আসতে পারেন। পরে আইন প্রনয়ণকারী সংস্থা গিয়ে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত ঘর ভেঙে ঢুকবে তাও আবার রিপোর্ট প্রকাশকে কেন্দ্র করে। এটা তো কাকতালীয় কোনও ঘটনা না। এখানে রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে ডিসির সাজা প্রদানের বিষয়ে কোনও যোগসূত্র থাকতেই পারে, সে সম্ভাবনা আমি দেখছি। সার্বিকভাবে এমন ঘটনা আইনের বিধিবিধানের সুস্পষ্ট পরিপন্থী।

অর্ধেক বোতল মদ এবং দেড়শ গ্রাম গাঁজার জন্য যে একবছরের সাজা দেওয়া হয়েছে এটাই যথাযুক্ত হয়নি বলে মনে করি। এ ধরনের সাজা প্রদান কখনোই পেশাদারিত্ব নয় বরং উচ্চ মাত্রার অপেশাদারিত্ব।

এছাড়া আইনত যেখানে অপরাধীকে পাওয়া যাবে সেখানেই সাজা দিতে হয়। কিন্তু বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে যদি ডিসি অফিসে সাজা দেওয়া হয় তাহলে তা অবৈধ হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচার মানে তাৎক্ষণিক অপরাধের স্থানেই বিচার দিতে হয়। হাইকোর্টের বেশ কিছু মামলায় এমন অসংখ্য নজির রয়েছে।’

বাংলাদেশে এখন একটা অলিখিত নিয়ম হচ্ছে সরকারের অনুমতি ছাড়া এমপি-মন্ত্রীদের বড় অপকর্ম নিয়ে নিউজ হয় না। এখন যদি ডিসি/ইউএনওদের নিয়েও নিউজ না করা যায় তাহলে এতো পত্রিকার কাজটা কি থাকে? প্রেস রিলিজ প্রকাশ করার জন্য আর কয়টা পত্রিকা দরকার? 

মাননীয় প্রশাসন, দুই টাকার সাংবাদিকদের না ধরে প্রশাসকদের একটু লাইনে আনুন। আপনাদের নিজেদের খোঁড়া গর্তে নিজেদের পড়ার সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছেই।

চোখ বন্ধ করে একটা ভবিষ্যৎবাণী করে রাখি। এই ডিসি সুলতানা পারভীনের পক্ষে লাইন ধরে একদল বিসিএস ক্যাডার দাঁড়িয়ে যাবেন। তিনি কতবড় বেগম রোকেয়া ইত্যাদির বয়ান আসবে। আরিফুল কতবড় গাঁজার ব্যাপারি সেটার তথ্য বের হতে থাকবে।  সচিবের জন্য আটকে রাখা ফেরির কারণে যখন এক কিশোর মারা গেলো তখনও কত বিসিএস ভাইয়ারা চাটতে নেমে গেলেন (অবশ্যই সবাই নন), এখানে তো কেউ মারা যায় নাই। 

আমরা আমাদের যতসামান্য কষ্টার্জিত আয়ের থেকে কেটে রাখা ট্যাক্সের টাকা দিয়ে সুলতানা পারভীনদের পুষি। বড় থেকে বড় নিপীড়ক বানাই। তাদের শানে কেউ বেয়াদবি করলে ওনারা সরকারী বাহিনী ব্যাবহার করে দরজা ভেঙে পেটাতে থাকেন নাগরিকদের। অথচ অভিযোগটা তো তেমন গুরুতর ছিল না। সামান্য একটা বিষয়। পুকুরের নামটা পাল্টে দিলেই হতো। ভুল স্বীকারও করা লাগতো না।   

কিন্তু তাতে যে বাহ্মণের জাত যাবে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা