তারকাখ্যাতি বা ফুটেজের লোভ কখনও জন্ম নেয়নি তার মধ্যে, যে ক্লাবটাকে শৈশব থেকে ভালোবেসেছে, যে ক্লাবের হয়ে খেলে বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের ছেড়ে যাওয়ার বাসনাও ঢোকেনি মনের মধ্যে।

আঠারোটা মৌসুম তিনি একটা ক্লাবের জার্সি গায়ে খেলেছেন। লীগ শিরোপা কি, সেটার স্বাদ তিনি পাননি। ইউরোপের মঞ্চে বড় কোন মুখ ছিল না তার ক্লাব, আর তাই কখনও ইউরোপ সেরা হবার কথা ভাবাও হয়নি।

এমন নয় যে তার কাছে ভালো ক্লাবের প্রস্তাব আসেনি। টপ ফর্মে যখন ছিলেন, তখন রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, জুভেন্টাস বা ইন্টার মিলানের মতো ক্লাবগুলো নিতে চেয়েছে তাকে, একবার-দুবার নয়, বহুবার। কিন্ত তিনি যাননি, রোমা নামের ক্লাবটাকে ঘর-বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি, রোমের সেই রোমান গ্ল্যাডিয়েটরের নামটা আপনারা সবাই জানেন- ড্যানিয়েল ডি রসি।

রোমা’র নাম নিলে সবার আগে ফ্রান্সেসকো টট্টির চেহারাটা মাথায় ভাসে। রোমা আর টট্টি তো দুটো সমার্থক শব্দই ছিল। ডি রসি নিজেকে খানিকটা দুর্ভাগা ভাবতেই পারে, তিনি টট্টির সমসাময়িক ছিলেন, ক্লাবে তার ছায়ায় ঢাকা পড়েছিলেন। টট্টি ছিলেন রোমার আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা, তাই পারফর্ম করেও আঁধারেই ঢাকা পড়তেন ডি রসি।

তবে তারকাখ্যাতি বা ফুটেজের লোভ কখনও জন্ম নেয়নি তার মধ্যে, যে ক্লাবটাকে শৈশব থেকে ভালোবেসেছে, যে ক্লাবের হয়ে খেলে বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের ছেড়ে যাওয়ার বাসনাও ঢোকেনি মনের মধ্যে। তাই তো ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল দিনগুলোতে স্পেন আর ইংল্যান্ড থেকে বারবার প্রস্তাব এলেও তিনি সাড়া দেননি, টাকার লোভ তার ভালোবাসাকে গ্রাস করতে পারেনি একবারও।

ক্যারিয়ারে বলার মতো অর্জন একটাই, সেটা আবার অনেক রথী মহারথীর ক্যারিয়ারেও নেই। ২০০৬ বিশ্বকাপে তরুণ ডি-রসি ছিলেন ইতালীর বিশ্বকাপজয়ী দলে, ফ্যাবিও ক্যানেভারোর হাত ঘুরে শিরোপাটায় চুমু খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তারও। রোমার হয়ে আঠারো বছরের ক্যারিয়ারে দুবার কোপা ইতালিয়া আর একবার সুপারকোপা ছাড়া আর কিচ্ছু জেতেননি, কিন্ত সেই অপ্রাপ্তিটা তাকে ক্লাব ছাড়ার প্ররোচনা দিতে পারেনি কখনও।

রোমার রসি

রোমার জার্সি গায়ে ৭১৭টা ম্যাচ খেলেছেন রসি, ছিলেন মিডফিল্ডের দক্ষ সেনানী। ইতালীয়ান লীগের খোঁজখবর যারা খুব একটা রাখেন না, তারা রসির পায়ের ঝলক দেখতে চাইলে ইউটিউবে যেতে পারেন। কিংবা স্মরণ করতে পারেন ২০১৭-১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচটার কথা- ঘরের মাঠে বার্সেলোনাকে সেদিন ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল রোমা।

সেই ম্যাচটাকে ধরা হয় ইউরোপিয়ান ফুটবলের অন্যতম সেরা কামব্যাক হিসেবে, পুরো নব্বই মিনিট জুড়ে লিওনেল মেসিকে বোতলবন্দী করে রাখার কাজটা করেছিলেন ডি রসি, তার বয়স তখনই ৩৪ বছর! রসির সামর্থ্যের জানান দেয়ার জন্যে এই একটা গল্পই তো যথেষ্ট! সেই ম্যাচে রোমার অধিনায়কও তিনিই ছিলেন, নতুন শতাব্দীতে তার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনাল খেলেছিল রোমা।

ক্ষীপ্রতা ছিল তার স্বভাবসুলভ সক্ষমতা, প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেয়ার কাজটা দারুণ করতে পারতেন তিনি। আক্রমণ নস্যাৎ করে দেয়ার পাশাপাশি ফরোয়ার্ডদের বলের যোগান দেয়ার কাজেও ছিলেন দক্ষ, পারফেক্ট ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন ডি রসি, ছিলেন নিজের সময়ের সেরাদের একজন। ইউরোপিয়ান জায়ান্টদের কাছে তার আকাশচুম্বী চাহিদা তো এমনি এমনি তৈরী হয়নি!

ইতালির হয়ে রসি মাঠে নেমেছেন ১১৭ ম্যাচে, ভঙ্গুর একটা দলে পরিণত হওয়া আজ্জুরিদের হয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপের পরে তেমন কোন সুখস্মৃতি নেই তার। বাছাইপর্ব থেকে বাদ যাওয়ায় ২০১৮ বিশ্বকাপটাও তো খেলা হয়নি। জাতীয় দলকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছিলেন তখনই, প্রহর গুণছিলেন একেবারেই বুটজোরা তুলে রাখার।

সেই কাজটা ডি রসি করলেন গতকাল। ভালোবাসার ক্লাব রোমা ছেড়ে এই মৌসুমেই বোকা জুনিয়র্সে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানেই প্রফেশনাল ফুটবলকে জানালেন বিদায়। নিজের সময়ে বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন ছিলেন যিনি, যে রসি রোমার হয়ে খেলার জন্যে টাকার লোভকে অগ্রাহ্য করেছেন বরাবর, তার বিদায়টা হতে পারতো রোমার ঘরের মাঠ স্তাদিও দেল্লা রোমা থেকেই। বিদায়বেলায় সেটাই হতে পারে রসির অতৃপ্তির একমাত্র কারণ…  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা