থ্রি ইডিয়টস দেখার পর যেমন মনে হতো, সব অভিভাবককে দেখাই, এই সিনেমাটি দেখার পর মনে হয়েছে সব শিক্ষককে যদি দেখাতে পারতাম!

সারা জীবন অসংখ্য সিনেমা দেখে আপ্লুত হয়েছি,অনুপ্রাণিত হয়েছি, ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়েছি। সব সিনেমার কথা সেভাবে মনেও থাকে না। মনে রাখাও যায় না। কিছু কিছু সিনেমা মনে গেঁথে থাকে অনেক দিন ধরে, কিছু সিনেমা দেখবার সময় মনে হয় খুব সহজ, কিন্তু অনেকদিন ধরে ভাবায়। এই সিনেমাটির নাম ডেড পয়েটস সোসাইটি। সিনেমাটি মুক্তি পায় অনেক আগে। আমি অবশ্য অতো আগে দেখিনি। কিন্তু, প্রথমবার দেখার পরেই ভেবেছিলাম এই সিনেমাটি নিয়ে কিছু লিখে রাখা দরকার।

থ্রি ইডিয়টস সিনেমাটা যেমন দেখার পর মনে হতো, সব অভিভাবককে দেখাই, এই সিনেমাটি দেখার পর মনে হয়েছে সব শিক্ষককে যদি দেখাতে পারতাম! বছরের পর বছর ধরে একটা স্কুলে একই রকম শিক্ষাব্যবস্থা চলে আসছে। স্কুলটিতে কিশোরদের পাঠিয়ে বাবা মায়েরাও নিশ্চিন্ত। এখানে কঠোর আইন কানুন। ছেলেরা আরামে ডুবে থাকতে পারবে পাঠ্যবইয়ের ভেতর। কোনো স্বপ্নরোগে তারা আক্রান্ত হবে না। পড়ালেখার বাইরে বাড়তি কিছু করতে চাইলে কঠিন কঠিন শিক্ষকরা সেসব ব্যামো ছুটিয়ে দিবেন। 

এরকমই একগুঁয়ে পরিবেশ। কোনো পরিবর্তন নেই। ছেলেরা বইয়ের লেখাগুলো পড়ছে, জানছে, পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, তারা কতটা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জন করছে? যে কবিতাগুলো নিতান্তই বিরক্ত হয়ে মুখস্থ করছে ছেলেরা, সেগুলোর প্রত্যেকটা লাইনের অন্তর্নিহিত মজাটুকু কয়জন নিতে পারছে? 

সিনেমার নাম ডেড পোয়েটস সোসাইটি

এমনই একটা অবস্থায় স্কুলটিতে আসলেন এক অদ্ভুত শিক্ষক। তার নাম জন কিটিং। যিনি পড়ালেখার স্টাইলটাই চেঞ্জ করে দিলেন। শুধু ক্লাসে না, শেখানোর প্রয়োজনে তিনি ছাত্রদের বাইরে নিয়ে যান। পড়ানোর বাইরে তাদের মানসিকতাকে বিকশিত করতে অনেক গল্প বলেন। খুব অবচেতনভাবে তিনি ছাত্রদের মধ্যে একটা রোগ ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। রোগটা হলো, জানার আগ্রহ, স্বপ্ন দেখার আগ্রহ। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার কৌশল। 

তিনি ছাত্রদের বলতেন, বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলতে। ওসব বইয়ে শুধু কবিতাই আছে। কবিতা বোঝার ভাষা শেখানো হয় না বইগুলোতে। কবিতার ভেতরকার রসটুকু তিনি ছাত্রদের বোঝাতেন। আর ছাত্রদের বলতেন, তাকে ক্যাপ্টেন বলে ডাকতে। মোটামুটি তাকে বলা যায় এক প্রথাবিরোধী শিক্ষক। তিনি ছাত্রদের কাছে শোনালেন, ডেড পয়েটস সোসাইটির কথা। ছাত্ররা তার প্রচ্ছন্নতায় নিজেরা আবার শুরু করলো, ডেড পয়েটস সোসাইটি।

কী হয় সেখানে? সিনেমায় দেখে নিবেন। পুরোটা না-ই বা বলে দিলাম। সিনেমার অন্যতম এক চরিত্র নীল। যে আমাদের নব্বুই ভাগ কিশোরের প্রতিচ্ছবি। ভিন্ন কিছু করবার তাড়না থাকলেও একটু অনুপ্রেরণার অভাবে তা আর প্রকাশিত হয় না। জন কিটিংস নীলের মধ্যে সেই ভিন্ন কিছু করবার তাড়না দিয়ে দিলেন। নীল খুঁজে পেয়েছিল তার জীবনের আনন্দের জায়গাটুকু, যা সে হাতড়ে বেড়ায়, যেই কাজটা সে তুমুল আনন্দ নিয়ে পারে সেই থিয়েটারের অভিনয়। যেই কাজটা আবার নীলের গম্ভীর পিতা অপছন্দ করেন। 

যা হবার তাই হলো। নীলের পিতা জেনে গেলেন, ছেলে আজকাল বড্ড সাহসী হয়ে উঠেছে। পড়ালেখার বাইরের জগতে তার পা পড়ছে। আর স্কুল প্রশাসন দেখলো, নতুন এই শিক্ষক সমস্ত প্রথাবিরোধী কাজ করে বেড়াচ্ছে। ফলে স্কুল প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিল তারা জন কিটিংসকে বরখাস্ত করবে। যেদিন তিনি বিদায় নেন, সেই শেষ ক্লাসের দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। কি দারুণ এক দৃশ্য। জীবানানন্দ বলেছিলেন, যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা.. জন কিটিংস ছাত্রদের সেই জগতের সাথে দেখা করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কতটা পেরেছেন, তা জানতে হলে সিনেমাটা দেখতে হবে।

এই সিনেমাটা যদি সব শিক্ষককে দেখানো যেতো!

এমনিতেও আপনি যদি জিরো এক্সপেকটেশন নিয়েও এই সিনেমা দেখতে বসে যান, সিনেমা শেষে ভীষণ প্রভাবিত হবেন, এই সিনেমার স্টোরিটেলিং দ্বারা, সিনেমার ডায়ালগ দ্বারা, নীল চরিত্রের স্বপ্নালু অভিনয় দ্বারা আর সবচেয়ে বেশি আপনি অবাক হয়ে ভাববেন, একজন শিক্ষকের ক্ষমতা কতখানি! চাইলে একটা মানুষের গোটা দৃষ্টিভঙ্গি একজন শিক্ষক কি অসাধারণভাবেই না পালটে দিতে পারেন! 

আমাদের এই মুহুর্তে ডেড পয়েটস সোসাইটির সেই জন কিটিংসের মতো কিছু শিক্ষক দরকার। একজন শিক্ষক আসলে শুধু পড়ান বলে শিক্ষক নন, তার চেয়ে বেশি তিনি একজন রোল মডেল। তিনি যেভাবে একজন ছাত্রকে শেখাচ্ছেন, জানাচ্ছেন, ছাত্ররাও কিন্তু সেরকমই হবে। পৃথিবীর যত বড় বড় মানুষ, বিখ্যাত মানুষ তাদের জীবনী পড়লে জানা যায়, মানুষগুলোর চিন্তার জগত বদলে দেয়ার পেছনে থাকে কোনো না কোনো শিক্ষকের অবদান। 

ডেড পয়েটস সোসাইটি সিনেমায় সেটিই দেখানো হয়েছে। রবিন উইলিয়ামস এই সিনেমায় এতটাই অসাধারণ ছিলেন যে, চিরকালের জন্য তিনি আমার প্রিয় অভিনেতা নন, প্রিয় মানুষের তালিকায় থাকবেন। তাকে এতটাই আপন লেগেছে এই সিনেমায়। আমার তারপর থেকেই মনে হতে থাকে, এমন একজন মানুষ যদি আমার মেন্টর হিসেবে থাকতেন! প্রিয় উক্তি-

"When you read, don't just consider what the author thinks, consider what you think."

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা