তিনি ভিত নাড়িয়ে দিয়েছেন শোষকের, গোঁড়ার, ভন্ডের। কথা বলেছেন মানুষের সার্বিক স্বাধীনতার, সামাজিক শিকল থেকে মুক্তির। তাই তিনি অনেকের চোখে হয়ে উঠেছেন একজন সাহসী নির্মাতা...

দীপা মেহতা। একজন নারী, একজন চলচ্চিত্রকার। তার চেয়েও বড় করে একজন সাহসী মানুষ। তাকে বিশ্ব চলচ্চিত্র চিনে তার বিখ্যাত এলিমেন্টস্‌ ট্রিলজি- ফায়ার, আর্থ এবং ওয়াটারের জন্য। এই তিনটি অসামান্য ছবি সব কিছু ছাপিয়ে তাকে একজন সাহসী চলচ্চিত্রকার হিসেবেই পরিচিত করে। 

“ফায়ার” মেহতার তৃতীয় ছবি। মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। ইন্দো-কানাডিয়ান ছবিটি ভারতে মুক্তি পায় আরো পরে, ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে। ফায়ার ভারতের রক্ষনশীল গোষ্ঠীর জন্য সত্যিকারের আগুন হয়ে উঠে। তাদের পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ ও দর্শনে তীব্র আঘাত হানে। মূল ধারার ছবিতে প্রথমবারের মতো উঠে আসে দুইজন নারীর পরস্পরকে ভালবাসার গল্প। সে ভালবাসায় যৌনতা আছে; তবে তার চেয়েও বেশী আছে মুক্তির স্বাদ।

দুইজন নারী নিজেদের যৌন স্বাধীনতা লাভ করে পরস্পরকে ভালবাসে। ভন্ড পুরুষতন্ত্রের অদৃশ্য শিকল কেটে মুক্তির স্বাদ লাভ করে তারা। মেহতার ভাষ্যে, ফায়ার সমকামিতা বিষয়ক ছবি না। সমকামিতা এখানে একটা দিক মাত্র। ছবিটি মূলত আমাদের জীবনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত বিষয়ক। 

ফায়ার সিনেমায় নারী মুক্তির ইংগিত বোঝানো হয়েছে

আমার চোখেও ‘ফায়ার’ নিছকই কোন সমকামিতা বিষয়ক চলচ্চিত্র না। বরং পুরো ছবিতে আমি দেখি পুরুষতন্ত্রকে বারবার আঘাত করা নারী মুক্তির ইংগিত। তাই ছবিটিকে সমকামিতা বিষয়ক ছবি হিসেবে না দেখে নারীবাদী ছবি হিসেবে দেখাই আমার কাছে বেশী যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে। 

ছবির ভিতরে যেমন আমরা দেখি দুইজন নারী তাদের অক্ষম স্বামীর সতী স্ত্রীত্বের শিকল কেঁটে মুক্তি ঘটায় নিজেদের নারীত্বের, লাভ করে যৌন স্বাধীনতা এবং সব শেষে সমাজ, সংসার থেকে বিতারিত হয়ে পরস্পরের বুকে খুঁজে নেয় মুক্তির স্বাদ; তেমনি ছবির বাইরে দীপা মেহতা লড়ে যান মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষনশীলতার শিকল থেকে মুক্তি দিতে। 

ভারতের সেন্সর বোর্ড প্রথমে কেবলমাত্র ছবির প্রধান চরিত্রের নাম সীতা (হিন্দু দেবীর নাম) থেকে বদলে নীতা রাখার শর্ত দেয় এবং ছবিটিকে প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ছবির সার্টিফিকেট দিয়ে ছাড়পত্র দেয়। কিন্তু রক্ষনশীল সংগঠন শিব সেনা ছবির বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে এবং সিনেমা হল ভাঙচুর, পোষ্টার জ্বালানোসহ ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী মনোহর যোশীও এদের সমর্থন করেন এবং বলেন তারা যা করেছে তাতে তাদেরকে আমি অভিনন্দন জানাই। এই ছবিটি আমাদের সংস্কৃতির সাথে বেমানান। 

পরে ছবিটি সেন্সরবোর্ডে পুনঃপরিক্ষার জন্য পাঠানো হয়। দিপা মেহতার সাথে দিলীপ কুমার, মহেশ ভাটসহ্‌ মুক্তমনা সংস্কৃতিকর্মী এবং অন্যান্য এক্টিভিটিস্টদের একটি গ্রুপ সুপ্রীম কোর্টে পিটিশন দাখিল করেন। দিপা মেহতার নেতৃত্বে ৩২ টি সংস্থার এক্টিভিটিস্ট গ্রুপ নিউ-দিল্লীতে ছবিটি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। ফ্রিডম অফ স্পীস্‌ বা বাক স্বাধীনতার পক্ষে লেখা নানা প্ল্যাকার্ড বহন করেন তারা। ১৯৯৯ এর ফেব্রুয়ারীতে ছবিটি আবার মুক্তি পায়।

ফায়ার নিয়ে দীপা মেহতাকে যতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে, তার আরেক ছবি আর্থ (১৯৪৭- দি আর্থ) নিয়ে অবশ্য তেমন কিছু করতে হয়নি। তবে এ ছবিটিও এই সাহসী নির্মাতার আরেক সাহসী কাজ। দেশভাগ অর্থাৎ ১৯৪৭- এর ভারত ভাগ যে ‘দি আর্থ’ অর্থাৎ পৃথিবীটাকে জাহান্নামে পরিণত করেছিলো, দীপা মেহতার এই ছবি দেখে তা আরো একবার অনুভব করেছে বিশ্ব। ধর্মের নামে দেশটা ভাগ হওয়ার পর শুরু হয় দুই ধর্মের কিছু মানুষের হিংস্রতা। সে এক বীভৎস চিত্র। আমির খান, নন্দিতা দাস, রাহুল রয় অভিনীত এ ছবিটি যারা না দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন না সত্যিই পৃথিবীটা সে সময় জাহান্নামে রূপান্তরিত হয়েছিলো ।

দেশভাগের বীভৎস কাহিনী নিয়ে তৈরী হয়েছে আর্থ

নির্মাতা এখানে ১৯৪৭- এর বাস্তবতার চিত্রের পাশাপাশি আমীর, নন্দিতা এবং রাহুল রয়ের গল্প দিয়ে রূপক একটা চিত্রও দাঁড় করিয়েছেন। যেখানে ছবির শেষে নন্দিতা রয়ের অসহায় পরিস্থিতি যেন গোটা ভারতের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলে। আর আমির আর তার দলবল হয়ে উঠে নিষ্ঠুরতা আর হিংস্রতার প্রতীক।

ছবিটিতে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের মানুষেরই হিংস্রতা এসেছে। এক দিকে হিন্দুরা পাকিস্তানগামী ট্রেনে মুসলিম যাত্রীদের কঁচু কাঁটা করে পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে তার প্রতিশোধ নিতে মুসলিমরা প্রতিবেশী হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। কী বিভৎস সে দৃশ্য! দেশভাগকে এতটা স্পষ্টভাবে অন্য কোন নির্মাতা পর্দায় জীবন্ত করতে পেরেছেন কিনা আমার জানা নেই। 

মেহতার এলিমেন্টস্‌ ট্রিলজির তৃতীয় এবং শেষ ছবি “ওয়াটার’’ সম্ভবত তার সবচেয়ে প্রশংসিত কাজ। গত শতকে হিন্দু বিধবাদের উপর সামাজিক এবং ধর্মীয় অনাচারের বিষয়টি উঠে এসেছে এ ছবিতে। আট বছরের এক বিধবা মেয়ের চোখে দর্শক দেখেছে ধর্মের নামে সামাজিক অনাচারের চিত্র। ছবিটি শুরু হওয়ার কথা ২০০০ সালে। শাবানা আজমী, নন্দিতা দাস এবং অক্ষয় কুমারকে নিয়ে নির্মাতা শুরু করতে চেয়েছিলেন কাজ। কিন্তু ছবি যেদিন শুরু হবে তার আগের দিন জানা যায় একদল আন্দোলনকারী ছবির সেট ভাংচুর করে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং ছবিটির শুটিং কোনোক্রমেই হতে দিবে না বলে আন্দোলন করছে। স্থানীয় একজন এক্টিভিটিস্ট ছবি বন্ধের জন্য সুইসাইড প্রটেস্টেরও ডাক দিয়েছিলেন। 

ওয়াটার সিনেমায় আট বছরের এক বিধবা মেয়ের চোখে দর্শক দেখেছে ধর্মের নামে সামাজিক অনাচারের চিত্র

দীপা মেহতা অবশ্য পরে গোপনে ভিন্ন নামে এবং ভিন্ন কাস্ট নিয়ে ছবির কাজ শেষ করেন শ্রীলংকাতে। সীমা বিশ্বাস, লিসা রে এবং জন আব্রাহাম অভিনীত ছবিটি কানাডায় মুক্তি পায় ২০০৫- এ। ভারতে আরো দুই বছর পর মুক্তি পায়। ছবিটি সমালোচকরা দারুণভাবে গ্রহন করেন। অস্কারে বিদেশী ভাষার সেরা ছবি হিসেবে মনোনীতও হয়। দীপা মেহতা মিডনাইটস্‌ চিল্ড্রেনসহ আরো বেশ কিছু ছবির নির্মাতা। তবে একজন নির্মাতা হিসেবে তিনি তার এলিমেন্টস্‌ ট্রিলজি দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। 

ফায়ার, আর্থ এবং ওয়াটারের গল্প, পটভূমি এবং এমনকি নির্মাণশৈলীও আলাদা। তবে একটা বিষয়ে তিনটি ছবিই এক সূত্রে গাঁথা। তিনটি ছবিই ভারতের ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থাকে সজোরে ধাক্কা দিয়েছে। রক্ষনশীলতা, পৌরুষতন্ত্র, ধর্মীয় ভন্ডামীর মতো বিষয় গুলোকে আঘাত করেছে বার বার। এই তিন ছবির মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি একজন নারী নির্মাতাকে, যিনি ভীত নাড়িয়ে দিয়েছেন শোষকের, গোঁড়ার, ভন্ডের। কথা বলেছেন মানুষের সার্বিক স্বাধীনতার, সামাজিক শিকল থেকে মুক্তির। তাই তিনি আমার মতো অনেকের চোখে হয়ে উঠেছেন একজন সাহসী নির্মাতা। তার চেয়েও বড় করে একজন সংবেদনশীল, সাহসী মানুষ।

কৃতজ্ঞতা- ফেসবুক গ্রুপ 'জাস্ট বলিউড'

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা