অনেকেই বলছেন, দীপিকার এই কাণ্ড শুধুই সিনেমার প্রমোশনের খাতিরে। কিন্ত দীপিকা তো নিজের সিনেমার কথা বলেননি প্রতিবাদে গিয়ে, সিনেমার চরিত্র মালতির মেকাপ নিয়েও যাননি সেখানে।
ভারতে এই মূহুর্তে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্রগুলোর একটি হচ্ছেন দীপিকা পাড়ুকোন। এই মূহুর্তে বলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী তিনি, আগামীকাল তার নতুন সিনেমা 'ছপাক' রিলিজ পাচ্ছে, তাকে নিয়ে আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্ত এবারের আলোচনাটা অন্যরকম। দলে দলে লোকজন তার সিনেমা বয়কটের আহবান জানাচ্ছে, স্বয়ং সরকার দলের সাংসদ দীপিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে টুইট করছেন, তাকে খেতাব দেয়া হচ্ছে 'দেশদ্রোহী' হিসেবে!
দীপিকা যে জন্যে আলোচনায় এসেছেন, সেটার কারণ ঠিক সিনেমা নয়। তিনি দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন, সেখানে দু'দিন আগে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর মুখোশ পরে হামলা করেছিল ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ছাত্র সংগঠম এবিভিপি (অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ)। জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ আহত হয়েছেন সেই হামলায়, তার মাথায় ষোলটি সেলাই পড়েছে। পুরো দেশে ছি ছি রব পড়েছে এই ঘটনায়, বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালানো- এমন ন্যাক্কারজনক কাণ্ড ভারত দেখেনি এর আগে!
প্রতিবাদে মুখর হয়েছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জেএনইউ'র ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে ক্যাম্পাসে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন ঐশীও, এসেছেন কানহাইয়া কুমার, যিনি ছিলেন জেএনইউ ছাত্র সংসদের সাবেক প্রেসিডেন্ট, মোদি সরকারের সমালোচনা করায় রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল তাকেও। সেই প্রতিবাদে এসে যোগ দিয়েছিলেন দীপিকা পাড়ুকোন, অনেকটা আচমকাই, সবাইকে অবাক করে দিয়ে।
কানহাইয়ার কণ্ঠে তখন চলছে তার বিখ্যাত 'আজাদী' গান, শ্লোগান দেয়া হচ্ছে 'জয় ভীম' বলে। সেসবের ভীড়ে একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপিকা, কোন কথা বলেননি তিনি, নীরবেই সংহতি জানিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের এই প্রতিবাদে। ঐশীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন আলাদা করে, তাকে সাহস দিয়েছেন। কিছুক্ষণ সময় সেখানে কাটিয়ে চলেও গিয়েছেন দীপিকা, তবে ততক্ষণে বিজেপির আইটি সেল নিজেদের পরবর্তী নিশাণা বানিয়ে ফেলেছে এই অভিনেত্রীকে।
দীপিকাকে দেশদ্রোহি আখ্যা দিয়ে তার সিনেমা বয়কটের ডাক এসেছে সেদিন থেকেই। বিজেপির এক সাংসদ টুইট করে সবাইকে অনুরোধ করেছেন, দীপিকা এবং তার 'ছপাক' সিনেমাটাকে যেন সবাই বয়কট করে! ছপাকের সঙ্গে একই দিনে মুক্তি পাচ্ছে অজয় দেবগনের সিনেমা তানাজি, মোদি ভক্তরা সুর তুলেছে, সবার উচিত তানাজি দেখা, কারণ এটা দেশপ্রেমের ছবি। আর ছপাক নাকী দেশদ্রোহি সিনেমা, এটা বয়কট করা উচিত!
এদের মধ্যে কেউ কেউ তো আরও এক কাঠি ওপরে উঠে ছপাকের প্রি-বুক করা টিকেট ক্যান্সেলের ছবি আপলোড দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে, আহবান জানাচ্ছে, সবাই যেন টিকেট ক্যান্সেল করে। পরে দেখা গেছে, শত শত মানুষ ওই একই সিরিয়াল নম্বরের টিকেট ক্যান্সেলের ছবি আপলোড দিয়ে দাবী করছে, সে নাকী এই টিকেট ক্যান্সেল করেছে! একই সিরিয়াল নম্বরের টিকেট একশোজন কী করে বুকিং দেয়- এটা এক আশ্চর্য্য রহস্য!
মুম্বাইয়ে এমনিতেই নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে বলিউড সেলিব্রেটিরা রাস্তায় নেমেছেন দলবেঁধে। অনুরাগ কাশ্যপ একের পর এক বাক্যবাণে বিদ্ধ করছেন বিজেপি সরকারকে। ফারহান আখতার, স্বরা ভাস্কর, জিশান আইয়ুব, বিশাল ভরদ্বাজ, বিশাল দাদলানি, রিচা চাড্ডারা এগিয়ে এসেছেন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ভারত সরকারের অন্যায় মনোভাবকে রুখে দিতে। এখন জেএনইউতে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে গিয়ে তাদের সঙ্গে সংহতি জানালেন দীপিকাও। তার জেএনইউতে যাওয়াটা যে বিশাল প্রভাব ফেলেছে, সেটা তো বিজেপির অনলাইন উইঙের তাণ্ডব দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
এর আগেও অবশ্য দীপিকা এদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন। পদ্মাবৎ সিনেমা মুক্তির আগে দীপিকার মাথার দাম ধরা হয়েছিল পাঁচ কোটি টাকা। তিনি নাকি রাজপুতদের ঐতিহ্যকে অপমান করছেন এই সিনেমার মাধ্যমে! রাজস্থান সহ কিছু রাজ্যে তো সিনেমাটা নিষিদ্ধই হয়েছিল! কর্নি সেনা নামের ধর্মান্ধ একটা দল তখ। দীপিকার নাক কেটে ফেলার ঘোষণা দিয়েছিল। অবশ্য, কাটা নাক দিয়ে তাদের কী উপকারটা হতো, সেটা জানা যায়নি। দীপিকার নাক বহাল তবিয়তে তার মুখের সঙ্গেই জুড়ে আছে।
অনেকেই বলছেন, দীপিকার এই কাণ্ড শুধুই সিনেমার প্রমোশনের খাতিরে। কিন্ত দীপিকা তো নিজের সিনেমার কথা বলেননি প্রতিবাদে গিয়ে, সিনেমার চরিত্র মালতির মেকাপ নিয়েও যাননি সেখানে। আর যদি প্রচারণাই মূল উদ্দেশ্য হয়, ক্ষতি কী? সিনেমার প্রমোশনটা ভারতে খুব গুরুত্বের সঙ্গে করা হয়। নিজেদের সিনেমা মুক্তির আগে বিদ্যা বালান প্রেগনেন্ট সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, শাহরুখ খান পাবলিক ট্রেনে চড়েন, এরকম আরও হাজারটা কীর্তি দেখানো যাবে। দীপিকা সেসবের চেয়ে ভালো প্রচারণা চালিয়েছেন, একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি প্রচারণা চালাচ্ছেন- এটার চেয়ে ভালো প্রমোশন আর কী হতে পারে?
দল-মতের উর্ধ্বে উঠে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারেন খুব কম মানুষই। তার ওপরে তারকা হলে তো তাদের জন্যে কিছু বলাটা আরও কঠিণ, কারণ তারা টার্গেটে পরিণত হয়ে যাবেন। সেখানে নিজের সিনেমা মুক্তির ঠিক আগে সরকার দল আর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর বিরাগভাজন হতে কেউই চাইবেন না। দীপিকা সেই সাহসটা করেছেন, এজন্যেই তার প্রতি ভালোবাসাটা আরও বেড়ে গেল...