তারা বলছে আমরা তোমাকে চাকরি দিবো, এজন্যে তোমার এ+ দরকার নাই, সিজিপিএ দরকার নাই, তুমি পাবলিকে পড়েছো নাকি ন্যাশনাল বা প্রাইভেটে পড়েছো জানার দরকার নাই, এমনকি তোমার কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া ডিগ্রিরও আমাদের দেখার দরকার নাই!

মন ভালো থাকলে অনেকে অনেক কাজ করে। আমি যেটা করি, মন ভাল থাকলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির চাকরির যোগ্যতানামা পড়ি। কিছুক্ষণ পরই মন মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ভাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র‍্যাজুয়েশন করা লাগবে, সাবজেক্ট ভাল হতে হবে, সিজিপিএ মোটা হতে হবে, এক্সট্রাকারিকুলার এক্টিভিটিজ থাকতে হবে, এই সেই নানান ভুং চুং লেখার পর শেষে লিখে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে ৩ বছর, ৫ বছর, যার যা খুশি।

প্রহসনের চূড়ান্ত রুপ হল, এতো কিছু রিকোয়ারমেন্টসে লিখার পর বেতন অফার করা হয় খুবই কম। এমনও বাংলাদেশে হয় এমবিএ করা একটা যুবককে অফার করা হচ্ছে ১০-১২ হাজার টাকা বেতন। এত কিছুর পর লিংক-লবিং-মামা-চাচা-খালু এগুলোও বাংলাদেশের চাকরিতে বড় এক্স ফ্যাক্টর। 

যাই হোক, এসব চাকরি-বাকরির খবর পড়ে কিছুক্ষণ মেজাজ খারাপ থাকার পর আমি পড়ি ফেসবুকের টিউশনি বিজ্ঞাপনগুলো, এগুলো পড়লেই তুমুল হাসি পায়। ক্লাস ফোরের বাচ্চাকে অংক করানোর জন্য টিচারকে হতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শুধু তা-ই নয়, তাকে হতে হবে ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের। সপ্তাহে পড়াতে হবে ৫ দিন, দেড় দুই ঘন্টা! বেতন আলোচনা সাপেক্ষে, মানে সেখানেও ছোট খাটো ইন্টারভিউ দিতে হবে।

এই যে অভিভাবকদের এমন অদ্ভুত মেন্টালিটি এটা ভেবেই হাসি পায় আমার, তারা কী চায় দিনশেষে? একটা এ প্লাস? একটা ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি? এগুলোই কি শেষ কথা জীবনের? গভীরে গিয়ে ভাবতে গেলেই শুধু হাসি পায় আমার। হাসাহাসি আর মেজাজ খারাপের এই ব্যালেন্স করার কম্বিনেশনটা দারুণ। বাংলাদেশে সারভাইভ করার স্বার্থেই মন মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়ার এই প্র‍্যাকটিসটা করি, যেন হুট-হাট কোনো ঘটনায় মন মেজাজ বিগড়ে গেলেও উলটা-পালটা কিছু করে না বসি৷ আবার হাসির প্র‍্যাকটিসও করি কারণ এরকম অনেক কিছুই হবে যা পরিবর্তন করা সহজ নয়, তারচেয়ে সহজে মেনে নিয়ে হাসাই ভাল। একটা নাটকে মোশাররফ করিমের চাকরির ইন্টারভিউ দেয়ার একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়লো হঠাৎ। শেয়ার করি একটু। 

ইন্টারভিউ রুম থেকে...

- নেক্সট? (মোশাররফ করিম রুমে প্রবেশ করলেন)
- মে আই কাম ইন?
- হ্যাঁ, প্লিজ আসেন। বসেন। (মোশাররফ করিম বসলেন সিটে।)
- ওকে। নাম?
- আনিস।
- আনিস। শুধু আনিস? আগে পরে কিছু নেই?
- আগে পরে যদি কিছু দিতে চান তাহলে সেক্ষেত্রে দিতে হবে আনিস। এবং তাতে দাঁড়াবে আনিস আনিস আনিস। (বোর্ডের সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো)
- আনিস আনিস আনিস? তাহলে সার্টিফিকেট নেইম কি?
- আপনাদের কাছে তো সিভি রয়েছে। প্রয়োজন হলে দেখে নেন..
- আমাদের কোম্পানির কাজকর্ম সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে?
- কেন থাকবে বলেন তো?
- কেন থাকবে মানে? আপনি কাজ করতে আসছেন তো কোম্পানির একটিভিটিজ সম্পর্কে কিছু জানবেন না?
- আরেহ এগুলো কোন প্রশ্ন হলো নাকি? দেখেন আমি ইন্টারভিউ দিতে আসছি কিন্তু আমি যে চাকরি করবো সে নিশ্চয়তা কিন্তু এখনো দিতে পারছি না।

- কেন?
- নাহ আপনাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আপনারা আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন!
- তো আপনার কি ধারণা আমরা আপনার সাথে ফাইজলামি করছি? আপনি কি এখানে ইন্টারভিউ দিতে আসেননি?
- নাহ ইন্টারভিউ মানে তো সাক্ষাৎকার, আর পরীক্ষা মানে এক্সাম। তো সেক্ষেত্রে আমিও তো আপনাদের পরীক্ষা নিতে পারি। (বোর্ডের সবাই মোটামুটি হতভম্ব) - কি মিন করছেন আপনি?
- বিষয় তো সহজ, না বোঝার তো কিছু নাই। মানে আমি যাদের আন্ডারে চাকরি করবো মানে যদি করি তাহলে আপনারা, আপনারা আসলে আমার যোগ্য কিনা, আমাকে রাখার যোগ্য কিনা সেটাও তো আমাকে বুঝতে হবে তাই না?
- আম্ম...আম্ম... হ্যাঁ, আপনার সেটা জানা দরকার। আগে আমার মনে হয় আমরা একটু আপনার সম্পর্কে কিছু জানি?
- হ্যাঁ, প্লিজ করেন, কিন্তু খুব বেশি সময় আমার নাই। একটু শর্টকাট করতে হবে।
- ও আচ্ছা আপনার তাড়া আছে?
- জ্বি (বোর্ডের লোক বাকরুদ্ধ)
- আচ্ছা একটু বলতে পারেন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কতটুকু?
- হাহাহাহাহাহাহা..
- হাসছেন কেন?
- এছাড়া আর কি করার আছে বলেন তো? আচ্ছা আপনাদের অফিসের কাজটা কি? মানে আমি যদি জয়েন করি তাহলে আমার কাজটা কি হবে?
- আমাদের তো এটা গার্মেন্টস বায়িং হাউজের ব্যবসা, বায়িং রিলেটেড কাজ হবে।
- ও আচ্ছা! সেক্ষেত্রে কি আপনারা এসব মালামাল চাঁদে পাঠাবেন চিন্তা করছেন?
- ওহ আম সরি, না মানে পরীক্ষা কি দেবেন না নেবেন?
- না দেয়ার জন্যে তো এসেছিলাম। কিন্তু এখন তো নিতে হচ্ছে, কি করবো বলুন! আচ্ছা বলেন তো এখন পূর্ণিমা না অমাবস্যা?
- কেন জানতে চাচ্ছেন? - নাহ দেখেন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে, আবার চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে, আবার সেই পৃথিবীর মধ্যে মানুষ নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে..
- রাইট..
- এখন আপনি বলুন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কি সব সময় সমান হবে? (ইন্টারভিউ বোর্ডের সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, প্রশ্নটার উত্তর ঠিক কি বুঝতে পারছে না)

যাই হোক, ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে উল্টা ইন্টারভিউ বোর্ডকেই পাজলড করে দিয়ে এসেছিলেন মোশাররফ করিম। নাটকে সারকাজম করে এমনটাই দেখানো হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে যারা ইন্টারভিউ দিতে যায়, যারা চাকরি খুঁজে বেড়ায় তাদের সাথেই সবাই সারকাজম করে, সেটা একদম শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে চাকরির বিজ্ঞপ্তি এবং চাকরির রিক্রুইটমেন্ট পর্যন্ত প্রত্যেকটা জায়গায়। 

আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা, চাকরী পাওয়ার যোগ্যতা একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নের ওপর দাঁড়িয়ে আছে

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আসলে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ব্যবস্থা। ব্রিটিশরা শিক্ষা ব্যবস্থার ডিজাইনটাই এভাবে করেছে যে, এই ব্যবস্থার আউটপুট টার্গেট ছিল কেরানি বানানো। তখনকার সময় সেটাই ব্রিটিশদের চাওয়া ছিল। তারপর অনেক কিছু বদলালেও শিক্ষার উদ্দেশ্য বদলায়নি। উদ্দেশ্য একটাই সার্টিফিকেটের এক টুকরা কাগজওয়ালা কিছু পটেনশিয়াল চাকরিজীবি তৈরি করা। সেটা সমস্যা না, ডেভেলপিং একটা দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী লাইফ সিকিউরিটি চিন্তা করে চাকরির দিকে ঝুঁকবে সেটাকে খুব খারাপও বলবো না।

কিন্তু এই চাকরি বলতে কোন চাকরি? শুধুই সরকারি চাকরি? বড় প্রাইভেট কোম্পানি, বড় বড় গার্মেন্টসের বড় সব পোস্টেই যারা চাকরি করে তাদের বেশিরভাগই বাইরের দেশ থেকে আসা মানুষ। কোনো এক পত্রিকায় কিছুদিন আগে দেখেছিলাম বাংলাদেশ থেকে হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স হয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে বিদেশী কর্মীদের হাত ধরে৷ তারা স্কিলড, তাই তারা ভাল পোস্টগুলোতে নিয়োগ পাচ্ছে। এটাকেও হিংসা করছি না। যে যোগ্য সে পেলে আমি কে তার বিরুদ্ধে বলার!

কথা হলো, আমাদের দেশের কেনো যোগ্য লোক ওই পর্যায়ে যেতে পারছে না? স্কিলের ঘাটতিটা কেনো? যে সার্টিফিকেটের জন্য এতো কিছু সেই সার্টিফিকেট কি তাহলে শুধুই এক টুকরা কাগজ, কোনো স্কিলের প্রমাণ না? 

সার্টিফিকেট ওরিয়েন্টেড এই পড়াশুনা দিয়ে কতদূর কি হবে? আমরা নিজেরাও কি বুঝতে পারছি না, এখন সেইদিন নেই। দিন বদলাচ্ছে। আপনি জানেন, আপনি যখন একটা সরকারি চাকরির জন্য দিন দুনিয়ার বাকি সব একপাশে রেখে প্রস্তুত করছেন নিজেকে, তখন অন্য দিকে দুনিয়ার সেরা সেরা কোম্পানি কী বলছে? তারা বলছে আমরা তোমাকে চাকরি দিবো, এজন্যে তোমার এ+ দরকার নাই, সিজিপিএ দরকার নাই, তুমি পাবলিকে পড়েছো নাকি ন্যাশনাল বা প্রাইভেটে পড়েছো জানার দরকার নাই, এমনকি তোমার কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া ডিগ্রিরও আমাদের দেখার দরকার নাই। হ্যাঁ, সেটা যদি থেকে থাকে ভাল, অর্জন হিসেবে দেখবো, সেটাকে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা কিংবা বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখবো না। আমরা দেখবো, তুমি কাজ জানো কিনা, তুমি কতটা দক্ষ, কাজের প্রতি কতটা প্যাশনেট, কতটা ক্রিয়েটিভ- এগুলো! 

বড় বড় কোম্পানিগুলো চাকরীর যোগ্যতা হিসেবে সার্টিফিকেটকে আমলে নিচ্ছে না

হ্যাঁ অ্যাপল, গুগল, আইবিএম, হিলটন, স্টারবাকসসহ ১৫টি কোম্পানি এমন ঘোষণাই দিয়েছে। তাদের টপ লেভেলের বেশ কিছু পজিশনের জন্য এখন থেকে আর কোনো ডিগ্রির প্রয়োজন নেই যোগ্যতা হিসেবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই উচ্চশিক্ষা অনেক ব্যয়বহুল। আমেরিকাতে যেমন, অনেকে কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে না কেবল টাকার জন্যে। কিন্তু, তাদেরও তো প্রতিভা থাকতে পারে, স্কিল থাকতে পারে। এখন একটা কাগজের সার্টিফিকেট নেই বলে যে তারা সুযোগ পাবে না এমন যেন না হয়, সেজন্যেই এই ডিগ্রির বাধ্যবাধকতাই উঠিয়ে দিয়েছে এই ১৫টি বিখ্যাত কোম্পানি। 

অথচ, আমাদের দেশে দিন দিন চাকরিপ্রার্থীদের জন্য প্রক্রিয়াগুলো আরো বেশি কঠিন হচ্ছে। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও যেন দিন দিন স্বপ্নকে আরো সীমিত রাখারই শিক্ষা দিচ্ছে। অভিভাবকরাও রেজাল্টের নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। চার-পাঁচটা টিচার রেখে পড়াতে পারেন যেন এ+ ঠিক থাকে অথচ একটা প্রোগ্রামিংয়ের ট্রেইনিংয়ে পাঠানোকে তারা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, একটা গানের টিচার রাখার খরচকে তারা বাড়তি বোঝা ভাবেন, আউটবই পড়াকে তারা টাউট কাজ ভাবেন। তারা বোঝেন শুধু রেজাল্ট এবং সার্টিফিকেট। কারো কি জানা আছে এই সার্টিফিকেট ওরিয়েন্টেড পড়াশুনা আর আশা ভরসা কতদিন চলবে আর?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা