দিল্লির নাজমা আখতার সর্বশক্তি দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তার ছাত্র-ছাত্রীদের আগলে রাখার জন্যে। আর আমাদের বর্তমান উপাচার্য, আমাদের প্রক্টরেরা হামলার ঘটনাকে জাস্টিফাই করতে চান অবান্তর প্রশ্ন করে, এক মিনিটের দূরত্ব পেরিয়ে আসতে তাদের এক ঘন্টা লেগে যায়

নাজমা আখতার, দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার উপাচার্য। কয়েকদিন আগে সংসদে বিতর্কিত সিটিজেনশীপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল পাশ করার প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র-ছাত্রীরা। পরিণামে পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, অনুমতি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে চালিয়েছে বর্বরতা, এমনকি লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে পিটিয়েছিল ছাত্রদের। পুরো ভারত অবাক হয়েছিল জামিয়ার ছাত্রদের ওপর পুলিশের এমন আক্রোশ দেখে। 

সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন উপাচার্য নাজমা আখতার, ‘বিনা অনুমতিতে’ পুলিশের ক্যাম্পাসে ঢোকার প্রশ্নে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সাংবাদিকদের ক্যাম্পাসে ডেকে এনে ধ্বংসযজ্ঞ দেখিয়েছিলেন তিনি, প্রশ্ন তুলেছিলেন, স্বায়ত্বশাসিত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে উপাচার্য বা প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া কেন পুলিশ ঢুকবে? নাজমা জানিয়েছিলেন, এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করবেন এবং দিল্লি পুলিশের নামে এফআইআর-ও করবেন। শুধু তা-ই নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ঘটনার শেষ পর্যন্ত তাদের পাশে থাকবে কর্তৃপক্ষ।

জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ভিসি নাজমা আখতার

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটা নিয়োগ দেয় কেন্দ্র সরকার, নাজমা তার চাকরির ভয় না করেই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সরকারের বিরুদ্ধে। তার ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর অন্যায়ভাবে হামলা হয়েছে, তার ক্যাম্পাস ভাংচুর করা হয়েছে, টিয়ার শেল ছোঁড়া হয়েছে ছাত্রাবাসে, ছাত্রী হোস্টেলে, উপাচার্য হিসেবে সেটা মেনে নেয়া তার পক্ষ সম্ভব ছিল না। মেরুদণ্ড বলে একটা জিনিস আছে তার, সরকারকে তোয়াজ করতে গিয়ে সেটা বিসর্জন দেয়ার কথা তিনি মাথায় আনেননি। ছাত্র-ছাত্রীরা তার সন্তানের মতো, আর বিপদের মুহূর্তে সন্তানের পাশে দাঁড়ানোটাকেই তিনি কর্তব্য ভেবেছেন। 

বাংলাদেশে আসি। গত পরশু ডাকসু ভবনে ডাকসুর ভিপি নুরের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠন। নুরের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হাসান মাহমুদ বলেছেন, নূর কেন বহিরাগত লোকজনকে নিয়ে ডাকসুতে গিয়েছিলেন, এটা তদন্ত হওয়া দরকার। অর্থাৎ, নুরের ওপর হামলার তদন্ত হোক বা না হোক, ডাকসুতে কেন তিনি বহিরাগত সঙ্গীদের নিয়ে গিয়েছিলেন সেটার রহস্যভেদ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ! 

হাসান মাহমুদকে হিসেব থেকে বাদ দিলাম, তিনি একটা দলের রাজনীতি করেন, নিজের দলকে ডিফেন্ড করবেন, খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার সেটা। কিন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো কোন দলের নেতা হিসেবে এই পদে নিয়োগ পাননি, তার কথার সুর কেন হাসান মাহমুদের সঙ্গে শতভাগ মিলে গেল? নুরের ওপর হামলার ঘটনায় উপাচার্য আখতারুজ্জামানও একই প্রশ্নটাই করলেন- নুর কেন বহিরাগতদের নিয়ে ডাকসুতে এসেছিলেন? 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আখতারুজ্জামান

সবার এক প্রশ্ন। নুর জবাব দিয়েছেন, তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, এজন্যেই কয়েকজনকে সঙ্গে রাখেন সবসময়। তার ওপর হামলার ঘটনা তো এই প্রথম হলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই কয়েক দফা তার ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগ, কখনও নামে, কখনও বেনামে। উপাচার্য তো তখন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেননি, তাহলে এখন এই অবান্তর প্রশ্নটা তুলছেন কোন যুক্তিতে? নুরের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলা হয়েছে, সেটার বিচার না করে নুর কেন বহিরাগতদের নিয়ে এসেছিলেন, এমন প্রশ্ন তোলাটা তো আপনাদের  মেরুদণ্ডহীনতার প্রমাণ দেয় স্যার! বিশ্বের কোন সভ্য দেশে এমন ঘটনা ঘটলে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যেতো, কিন্ত এটা তো বাংলাদেশ, এখানে পদ আঁকড়ে ধরে রাখাটাই সভ্যতা!

ডাকসু ভবন থেকে প্রক্টরের কার্যালয়ের দূরত্ব হাঁটা পথে মিনিটখানেক। অথচ নুর এবং তার সঙ্গীদের ওপর দুই দফা হামলা হলো, প্রক্টর গোলাম রব্বানীকে ফোন দেয়া হলেও তিনি তখন আসেননি! রুমের লাইট বন্ধ করে লাঠি, বাঁশ এবং রড দিয়ে নুরদের পেটানো হয়েছে, এতসব জেনেও প্রক্টর নামের অমেরুদণ্ডী প্রাণীটি ঘটনাস্থলে এসেছেন পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে। যখন তথাকথিত 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চে'র দামাল ছেলেরা যুদ্ধ শেষ করে চলে গেছে ঘটনাস্থল থেকে। কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি ব্যস্ত ছিলেন, সেটা কি বলবেন তিনি? 

প্রক্টর গোলাম রব্বানি

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সালাহ উদ্দিন সিফাতের কাছ থেকে অন্যরকম একটা তথ্যই পাওয়া গেল। তিনি বললেন- ‘নুরসহ অন্যদের ওপর হামলার সময় আমি প্রক্টর স্যারের কাছে বিচারের দাবি নিয়ে যাই। তিনি আমাকে বলেন, “তুমি বেশি নেতা হয়ে যাচ্ছ। তোমাকে বহিষ্কার করবো।” আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী; তিনি আমাকে রক্ষা না করে উল্টো বহিষ্কার করার কথা বলেছেন, পুলিশে দেওয়ার কথা বলেছেন!’ এরপরে প্রক্টরকে নিয়ে আর একটা শব্দও লিখতে ইচ্ছে করে না, পদের লোভে মত্ত এই লোক এতটা পরিশ্রম ডিজার্ভ করেন না। 

উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ জোহা প্রাণ দিয়েছিলেন তার ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে গিয়ে, শিক্ষককে দেখলে পাকিস্তানী সেনারা হয়তো গুলি করবে না, এমনটাই ছিল তার ভাবনা। দিল্লির নাজমা আখতার সর্বশক্তি দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তার ছাত্র-ছাত্রীদের আগলে রাখার জন্যে। আর আমাদের বর্তমান উপাচার্য, আমাদের প্রক্টরেরা হামলার ঘটনাকে জাস্টিফাই করতে চান অবান্তর প্রশ্ন করে, এক মিনিটের দূরত্ব পেরিয়ে আসতে তাদের এক ঘন্টা লেগে যায়। ক্যাম্পাসে যখন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়, তখন তারা বাসভবনে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন! এই মানুষগুলোকে শিক্ষক ভাবতে আমাদের ভীষণ লজ্জা করে, আপনাদের কি লজ্জা হয় না স্যার? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা