আমারই পোস্টের কোনো এক কমেন্টে কেউ বলেছিলেন তিনি কিছুদিন ধরে ডিপ্রেশনে আছেন। কী করতে পারেন। সাথে সাথে একজন রিপ্লাই দিলেন, "নামাজ পড়ুন। ডিপ্রেশন কেটে যাবে।" যেমন জঘন্য প্রশ্ন, তারচেয়ে জঘন্য উত্তর। কেন? সেটাই বলতেই এই পোস্ট লিখছি।
ডিপ্রেশন একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি। ক্ষেত্র বিশেষে প্রাণঘাতী হয়। শরীরে জ্বর-সর্দি-কাশি হলে যেমন দোয়ার পাশাপাশি দাওয়ারও প্রয়োজন হয়, ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রেও তাই। অবশ্যই অবশ্যই এবং অবশ্যই আপনাকে প্রফেশনালের শরণাপন্ন হতে হবে। ফেসবুকে দুই-চার লাইন লেখা পাবলিক যেমন প্রফেশনাল না, তারচেয়ে আরও বেশি ক্ষতিকর হচ্ছে কিছু না বুঝেই আজাইরা কমেন্ট করা লোকজন।
আপনি যদি দেখেন আপনার কাশির সাথে রক্ত বেরুচ্ছে, তখন কি আপনি ফেসবুকে পোস্ট লিখে জানতে চান আপনার কী করা উচিৎ? আর কিছু কমেন্ট করার আগে আপনি কি জানেন কে কোন কারণে ডিপ্রেসড? তাহলে আপনি কিসের ভিত্তিতে প্রেসক্রিপশন লিখতে বসে গেছেন? নামাজ, রোজা, হজ্ব, কোরআন, জিকির যাই করুন না কেন, সেটা কেবল স্পিরিচুয়াল অংশ বাদে আর কোনোদিকে আপনার রোগে সাহায্য করবে? আপনাকে অবশ্যই ক্ষেত্র বিশেষে ওষুধ নিতে হবে। তখন?
আমাদের সমস্যা হচ্ছে, ডিপ্রেশন যে কতটা ভয়াবহ ব্যাধি, সেটাই উপলব্ধি করি না। কেউ যখন আমাদের সাথে পরামর্শ করতে আসে, মন দিয়ে তাঁর কথা শোনার পরিবর্তে আগেই বাণী চিরন্তনী ঝাড়ি- "কারোর ঈমান শক্ত হলে সে কখনই ডিপ্রেসড হবে না।" কথা হচ্ছে, আমাদের নবী (সঃ) প্রায়ই মনোকষ্টে ভুগতেন। তাঁর নব্যুয়াতি জীবনটাই কেটেছে ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। তাঁকে তাঁর নিজের লোকেরাই অবিশ্বাস করতো, ঠাট্টা-বিদ্রুপ-ব্যঙ্গ করতো। তাঁর সামনেই তাঁর কথায় বিশ্বাসী ইয়াসির-সুমাইয়া (রাঃ) দম্পতিকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো, এবং তিনি কিছুই করতে পারলেন না। আল্লাহ কুরআনে সেটা বলেছেনও- "আমি জানি তাদের কথায় ও আচরণে আপনার মন কষ্ট পায়।" (কোন আয়াত ভুলে গেছি, কেউ মনে করিয়ে দিলে লিখে দিব) তারপরেও তিনি প্রতিটা মানসিক আঘাতে আল্লাহর পাশাপাশি তাঁর প্রিয় লোকজন, আবু বকর, উমার, আলী এমনকি পিচ্চি উসামা ইবনে যাইদের সাথেও পরামর্শ করতেন। বহু উদাহরণ আছে। লিখবো? আচ্ছা, একটা দুইটা বলা যাক।
মা আয়েশার (রাঃ) নামে যখন মুনাফেকরা গুজব রটাতে শুরু করে, এবং নবী (সঃ) কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না, তখন আলী এবং উসামাকে নিয়ে তিনি এই বিষয়ে বাড়ির ভিতর বৈঠক করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি হয়ে গেলে কুরাইশদের কাছে আত্মসম্মান বিসর্জন গেছে ভেবে সাহাবীদের যে ক্ষোভ প্রকাশ হচ্ছিল, তা দেখে তিনি মনোকষ্টে স্ত্রী উম্মে সালমার (রাঃ) সাথে শুধু কথা বলেনই না, বরং স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করে তা পালনও করেন। এইরকম হাজারও উদাহরণ আছে সীরাত গ্রন্থেও হাদিস শরীফে। তাহলে এই যে ভদ্রলোকেরা হুটহাট করে ফতোয়া জারি করেন যে ঈমান দৃঢ় হলে মানুষ ডিপ্রেসড হয় না, আমাদের নবীর (সঃ) চেয়ে দৃঢ় ঈমানদার এবং পারফেক্ট উপাসক দুনিয়ার মাটিতে আর কয়জন ছিল? তাঁর ব্যাপারে তারা কী বলবে?
ডিপ্রেশনের ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দেই। কাজে লাগবে। ভয় নেই, আমি কোন প্রেসক্রিপশন লিখছি না। ওটা অবশ্যই প্রফেশনালের কাছ থেকেই নিবেন। আমি বলছি যখন ডিপ্রেসড হবেন, বা যখন বুঝবেন কেউ ডিপ্রেসড, তখন কী করবেন।
সবার আগে, ফেসবুকে পোস্ট করা বন্ধ করুন। আপনি যে ডিপ্রেসড, এইটা মাইকিং করে জানানোর দরকার নাই। এতে সমস্যা হবে, লোকে উল্টাপাল্টা যা তা বলবে, সেটা আপনার লাভের বদলে ক্ষতি করবে বেশি। বরং আপনি আপনার অতি কাছের মানুষদের সাথে কথা বলতে চাইলে বলতে পারেন। এতে হয়তো মন হালকা হবে। কিন্তু একটা জিনিস মাথায় গেঁথে রাখুন, দুনিয়ার কোন মানুষের পক্ষেই আপনি কী অনুভব করছেন, সেটা ১০০% উপলব্ধি করা সম্ভব না। এটা আপনাকে মানতেই হবে। উল্টো আপনি যখন দেখবেন, লোকে আপনাকে বুঝতে পারছে না, তখন আপনি আরও বেশি ডিপ্রেসড হবেন। বুঝতে পারছেন? আমাদের কুরআনেরই একটি উদাহরণ শুনুন।
ইউসুফ নবীকে (আঃ) তাঁর ভাইয়েরা যখন কুয়ায় মরার জন্য ফেলে দিয়ে এসেছিল, এবং প্রিয় পুত্রের বিয়োগে পিতা ইয়াকুব (আঃ) ভয়াবহ ডিপ্রেশনে ছিলেন, তখন খুনি ছেলেরা তাঁকে তিরস্কার করে বলতো, "আর কতদিন আপনি তাঁর শোকে মুহ্যমান থাকবেন?" ইয়াকুব জবাব দিয়েছিলেন, "আমি আমার শোকের কথা কেবল আল্লাহকেই বিচার দিচ্ছি।" তিনি একজন নবী, এবং জানেন যে সন্তানবিয়োগের যন্ত্রনা, আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীর কেউই পুরোপুরি উপলব্ধি করবে না। আপনিও এই এক্সপেক্টেশন রাখুন। লোকে আপনাকে বুঝবে না। কারোর সাথে পরামর্শ করা না করা আপনাকেই বুঝতে হবে।
কারোর বাচ্চা মারা গেছে। আমরা গিয়ে বলি, "ধৈর্য্য ধরো। কেঁদো না, আল্লাহ নারাজ হবেন।" এইটা কোন কথা? তাঁর বাচ্চা মারা গেছে, আপনি আসছেন আজাইরা কথাবার্তা বলতে। কোন ছাগল বলে সন্তান বা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে কান্না করলে আল্লাহ রাগ করবেন? আমাদের নবী নিজে তাঁর সন্তানের মৃত্যুতে, হজরত হামজা, জাইদ, জাফরের (রাঃ) মৃত্যুতে কেঁদেছেন। হ্যাঁ, আপনি কান্নার পাশাপাশি বুক চাপড়ানো, এর ওর উপর দাপাদাপি ঝাপাঝাপি, বিলাপ বকতে বকতে করুন সুরে গান গাওয়া "আমার কী হবেরেএএএএএএএএএ, এ কী হলো রেএএএএএএ" ইত্যাদি করতে পারবেন না। শোক প্রকাশের নামে সস্তা মেলোড্রামা ইসলামে নিষেধ। দুইয়ে পার্থক্য আছে। বুঝতে হবে।
তো যা বলছি, কারোর মৃত্যুতে সান্তনা দিতে গেলে একটু সেনসিটিভ হবার চেষ্টা করুন। পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করুন। না জেনে এমন কিছু বলবেন না যার জন্য উল্টো ক্ষতি হয়। এ ক্ষেত্রে যেমন এমন হতে পারে যে সন্তান বিয়োগে এমনিতেই মা ডিপ্রেসড, এখন আপনি মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন যে আল্লাহও তাঁর উপর নারাজ হয়েছেন, কারণ তিনি কেঁদেছেন। ডবল ডিপ্রেশন। অনেক সময়ে কিছু না বলেও হাজার কথোপকথনের কাজ হয়ে যায়। তাই যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতিতে পড়বেন, চুপ থেকে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কেউ যখন আপনার সাথে নিজের মনের কথা শেয়ার করতে আসবে, তখন আল্লাহর ওয়াস্তে তাঁর কথা পুরোটা শোনার চেষ্টা করুন। মাঝপথে থামিয়ে নিজের মুখ খুলে বসবেন না।
অনেক সময়েই আমরা করি কি, এক ঘটনার সাথে আরেক ঘটনা গুলিয়ে এক করে ফেলি। আমার বন্ধু আসিফ পারিবারিক কারণে ডিপ্রেসড, আমার বন্ধু আকবরও তাই। কিন্তু দুইজনের ডিপ্রেশন দুই কারণে হতে পারে। হতে পারে আসিফের সন্দেহ তাঁর স্ত্রী পরকীয়া করছে, আর আকবরের বৌ তাঁর উপর মানসিক নির্যাতন করে। কিন্তু আমি আসিফের ঘটনা না শুনেই আকবরের মতন পরিস্থিতি ধরে নিয়ে আকবরকে যে পরামর্শ দিয়েছি, সেটাই দিয়ে বসলাম। তাহলে পরিস্থিতি কতটা বিগড়াবে অনুভব করছেন? এই ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব হচ্ছে আসিফের পুরো ঘটনা পূর্ণ মনোযোগে শোনা, তাঁর কষ্ট যতটুকু সম্ভব অনুভব করার চেষ্টা করে তাঁকে একটাই পরামর্শ দেয়া। "বন্ধু, আমি তোমার সাথে আছি। কিন্তু তোমার যদি কষ্ট বেশি হয়, তাহলে আমার মনে হয় তোমার কোন প্রফেশনালের কাছে যাওয়া উচিৎ। তুমি বলোতো আমি খোঁজ নিয়ে দিচ্ছি।" পারলে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে, তাঁকে চেম্বারেও নিয়ে যাওয়া উচিৎ। ডিপ্রেশনের রোগীর মাথায় এইসব থাকেনা।
আপনি ডিপ্রেশনে থাকলে, এবং মুসলিম হলে একটি ব্যাপার অবশ্যই বিশ্বাস রাখবেন, পরিস্থিতি যতই ভয়াবহ হোক না কেন, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। নিশ্চয়ই তিনি সব জানেন, এবং সময় মতন সব ঠিক করে দিবেন। আপনাকে আপনার দিক থেকে সব চেষ্টা করে যেতে হবে। আমাদের নবী (সঃ) যখন মক্কা থেকে মদিনায় যাচ্ছিলেন, এবং কুরাইশরা তাঁর প্রাণনাশে খোলা তলোয়ার নিয়ে পিছু ধাওয়া করে, তিনি ও আবু বকর (রাঃ) পাহাড়ের এক ফাটলে লুকিয়ে ছিলেন। কুরাইশরা সেই গর্তেরও সন্ধান পেয়ে যায়। মৃত্যু যখন মাত্র এক কদম দূরে, আবু বকর জানেন যে ওরা কেবল নিচে উঁকি দিলেই তাঁদের ইহকালের সব কর্মযজ্ঞ সমাপ্ত হবে, নিজের বুকের ধুকপুকানি তখন দামামার মতন বাজছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এমন পরিস্থিতিতেও কুয়ার জলের মতন শীতল নিস্তরঙ্গ ছিলেন। কীভাবে? সে কথাই তিনি তাঁর সঙ্গীকে বলেন, "ইয়া আবু বকর! তোমার কী ধারণা, সেই দুই ব্যক্তির কী ক্ষতি হতে পারে যাদের সাথে তৃতীয়জন হিসেবে আল্লাহ থাকেন?" আমি মুসলিম। যখনই কোন বিপদে পড়ি, আমি কেবল এই বাক্যটাই মনে রাখি। আমার ভয় কেটে যায়। এতে আমার মন হাতির বল পায়।
কিন্তু যদি ডিপ্রেশন তারচেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়, তবে অবশ্যই আমাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। সাধারণ সর্দি কাশির জন্য ডাক্তারের কাছে দৌড়ানোর প্রয়োজন নেই। শরীর নিজেই সামলে ফেলে। দুধ, ডিম, সব্জি দিয়ে শরীরের বল বৃদ্ধি করছি। কিন্তু দুই তিন সপ্তাহেও কাশি থামছে না। উল্টো মাঝে মাঝে রক্ত বেরুচ্ছে। তখন? বুঝাতে পারছি?
ডিপ্রেশনের শিকার আমিও হয়েছিলাম। ২০১১ সালে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন, ইকবাল, আমারই চোখের সামনে পানিতে ডুবে মারা যায়। ছেলেটা আমার ভাইয়ের চেয়েও আপন ছিল, ওর সাথেই আমি বড় হয়েছি। আমার মনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল সে। এর দুইমাস পরেই আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ আমি পাই। মাঝে আমার তিন বছর পুরানো স্থায়ী চাকরি হারাই। ২০১১ বছরটা আমার জন্য ভয়াবহ গিয়েছিল। তখন কিছুই ভাল লাগতো না। বাইরে বেরুতাম না। খিধা লাগলে কেবল দুধ সিরিয়াল খেতাম, তাও দিনে একবেলার বেশি না। রান্নার ইচ্ছাও হতো না। এমন পরিস্থিতে বুঝতেও পারিনি এটাই ডিপ্রেশন।
আলহামদুলিল্লাহ। সেটা কেটেছে। এখন যেকোন কঠিন পরিস্থিতে উপরে লেখা নবীর পরামর্শ মনে করি। মহাবিশ্বের প্রতিপালক আমার সাথে আছেন, আমার ভয় কী? এতে স্পিরিচুয়াল বলটা পাই। নামাজে, এক্সট্রা ইবাদতে আল্লাহর সাহায্য চাই। সবই ঠিক আছে। কিন্তু অবশ্যই অবশ্যই এবং অবশ্যই সবাইকে পরামর্শ দিব, প্রফেশনালদের সাথে আলোচনায় বসুন।
লেখাটি 'ক্যানভাস' ফেসবুক গ্রুপে পূর্বপ্রকাশিত