একবার দেশ ভেঙেছে। এ বার চৌকিও? চৌকি ভাঙলে অতীত ভাঙে। নদী, মাঠ, বকুল গাছ, ঘুঘু-ডাকা দুপুর সব ভেঙে যায়। এত ভাঙন এক জীবনে সয় না।
অনিমেষ বৈশ্যঃ
এই চৌকিটা আমার ঠাকুরদা এনেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। সম্ভবত এই তোরঙ্গটাও। কী ভাবে এনেছিলেন জানি না। সীমান্ত পেরিয়ে, পোষা কুকুর, হাঁস-মুরগি, কই-খোলসে, শিঙ্গি-মাগুরের অনন্ত ঘাই পিছনে ফেলে এই চৌকিটাকে তিনি এ-পারে এনে ফেলেছিলেন। চৌকিতেই মানবের জন্ম, চৌকিতেই মিলন, চৌকিতেই মৃত্যু। চৌকিতে ঘাপটি মেরে আছে পূর্বপুরুষের শ্বাসপ্রশ্বাস। একে তো ফেলে আসা যায় না!
আগে চৌকিটা ছিল বসার ঘরে। এখন ছাদের চিলেকোঠায়। আমার বাবা ছাদে উঠতে পারে না। কিন্তু মাঝেমাঝে চৌকিটার খোঁজ নেয়। আসলে চৌকি নয়, বাবা খোঁজ নেয় দ্যাশের। মানে বাংলাদেশ। চৌকিটার ছটি পায়া। চার কোণায় চারটে। মাঝে আরও দুটো। কোণার পায়াগুলো শক্তপোক্তই আছে। মাঝের দুটো নড়বড়ে। তা হোক। চৌকির পায়াতে আজও মাটি লেগে আছে। ও আমার দেশের মাটি। আমার বাবা মাটির গন্ধে এই চৌকিটাকে কিছুতেই বেহাত হতে দেয় না।
একবার ভেবেছিলাম, চৌকিটা ভেঙে নতুন করে গড়ব। বাবা তা হতে দেয়নি। একবার দেশ ভেঙেছে। এ বার চৌকিও? চৌকি ভাঙলে অতীত ভাঙে। নদী, মাঠ, বকুল গাছ, ঘুঘু-ডাকা দুপুর সব ভেঙে যায়। এত ভাঙন এক জীবনে সয় না। নরেন মিত্তিরের একটা গল্প ছিল---পালঙ্ক। একটা পালঙ্ক কী ভাবে মায়া-মমতা-ভালোবাসা-আভিজাত্য-অহংকারের সঙ্গে মিশে যায় তার কাহিনি। পালঙ্কে আসলে সময় টিকিটিক করে। ঠাকুরদা আরও দু'টি জিনিস এনেছিলেন। একটা দেওয়াল ঘড়ি। এবং একটা বিরাট বড় আলমারি।
এত বড় আলমারি আমি আর কোনওদিন দেখিনি। ওতে কাঁসার বাসন ছিল। আর ছিল শীতলপাটি, রামদা। আলমারির ঘুটঘুটে অন্ধকারে ফাগুনের আমের বনের ঘ্রাণ ছিল। অঘ্রানের ভরা খেতের মধুর হাসি ছিল। আলমারিটা আর নেই। মধুর হাসিও উধাও। ঘড়িটা এনেছিলেন বোধহয় নিজের সময়কে আঁকড়ে ধরতে। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়েই ঘড়ি গেল আধঘণ্টা পিছিয়ে। আরও কত কী যে পিছনে পড়ে রইল। এখন শুধু হুঙ্কার। খেদিয়ে দেব, ভাগিয়ে দেব। কাকে খেদাবি রে আবাগির বেটা? তোর বাড়িতে যদি এই চৌকি থাকত, পারতি খেদাতে? মাটি-ছাড়া মানুষের হাহাকার তুই কি বুঝবি? দে খেদিয়ে আমাদের। এই চৌকিটা কিন্তু থাকবে। মাটির গন্ধও থাকবে পায়ায়। আমি উদ্বাস্তু। একবার এ-পারে আসব। আর একবার ও-পারে যাব।
চৌকির পায়ায় মাটির গন্ধ ঠিক লেগে থাকবে।