মজিবর রহমান দেবদাস: যে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পাকিস্তানী সেনাদের গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন 'দেবদাস', বিনিময়ে জুটেছিল টর্চার সেলে নৃশংস অত্যাচার। মানসিক ভারসাম্য হারানো সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান দেবদাস অভিমান বুকে নিয়েই চলে গেছেন নীরবে, তাকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারেনি এই জাতি...
দেবদাস বললে এখন সবাই শাহরুখ খানের কথা স্মরণ করবে, যারা পড়ুয়া, তারা হয়তো শরৎচন্দ্রের দেবদাসের কথা মনে করিয়ে দেবে। অথচ আমাদেরও যে একজন দেবদাস আছেন, অকুতোভয় এক প্রতিমূর্তি, সাহসের জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ- সেই দেবদাসের কথা আমরা জানিনা। যে মানুষটা পাকিস্তানীদের অত্যাচারের প্রতিবাদে একাত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে অবস্থায় নিজের মুসলমান নাম পরিবর্তন করে 'দেবদাস' রেখেছিলেন, পাকিস্তানী সেনাদের নির্মম অত্যাচারে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এতগুলো বছর বেঁচেছিলেন, তার খোঁজ আমরা রাখিনি, তার গল্প আমরা সবাইকে শোনাতে পারিনি। সেই মানুষটা, মজিবর রহমান দেবদাস এবছরের ১৮ই মে চলে গেছেন চিরতরে, পাড়ি জমিয়েছেন অন্য ভূবনে।
১৯২৮ সালে জন্মেছিলেন মজিবর রহমান নামের মানুষটা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে পড়াশোনা শেষ করে তিনি বগুড়া ও কুমিল্লার দুটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে মেলবোর্নে যান উচ্চতর শিক্ষার জন্য। ফিরে এসে যোগ দেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে চলে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, যোগ দেন গণিত বিভাগে।
একাত্তরের উত্তাল সময়ে মজিবর রহমান ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় চালানো গণহত্যার খবর তিনি পেয়েছিলেন ঢাকায় থাকা বন্ধুদের মুখে, ঢাকা থেকে প্রাণভয়ে রাজশাহীতে যাওয়া অনেকের সাথে তার দেখা হয়েছে, তাদের কাছে তিনি জেনেছেন, কি ভয়াবহ বিভীষিকাময় প্রহর পেরিয়ে এই লোকগুলো প্রাণ বাঁচিয়ে ছুটে এসেছে। মজিবর রহমানের বুকের ভেতরে দ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো, তবে সেটা প্রকাশ করলেন না তিনি তক্ষুণি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, অধিকাংশ শিক্ষকই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে গ্রামে-গঞ্জে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউবা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় তখন প্রায় ফাঁকা। তবু কয়েকজন শিক্ষক মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ক্যাম্পাসেই থেকে গেলেন, যদি কোনভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা যায়, কোন তথ্য দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, বা অন্য যে কোনভাবে। সেই শিক্ষকদের একজন ছিলেন মজিবর রহমান।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছিল। ২৬শে মার্চ সকালে পাকিস্তানী সেনাদের একটা দল হানা দিয়েছিল ক্যাম্পাসে। প্রগতিশীল ও হিন্দু শিক্ষকদের খোঁজ করছিল তারা। জুবেরী ভবনে অবস্থানরত তিন শিক্ষক অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম, অধ্যাপক অজিত রায় ও অধ্যাপক মজিবুর রহমানকে তারা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। প্রথম প্রশ্নই ছিল- এখানে কোনো হিন্দু শিক্ষক আছে কি না? পাকিস্তানী সেনাদের বর্বর সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কথা অধ্যাপক মজিবুর রহমান ভালো করেই জানতেন। তিনি নিজের বিপদের কথা না ভেবে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, 'না এখানে কোনো হিন্দু নেই'। পাকিস্তানী সেনারা আরেকটু খোঁজাখুঁজি করলেই বেরনকরে ফেলতে পারতো অজিত রায়ের পরিচয়, কিন্ত মজিবুর রহমানের দৃঢ়চেতা মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা বিশ্বাস করেছিল তারা। বেঁচে গেলেন অধ্যাপক অজিত রায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই ঘাঁটি গেড়ে বসলো পাকিস্তানী সেনারা, শহীদ জোহা হলকে বানিয়ে নিলো টর্চার সেল। রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মানুষকে ধরে আনা হতো সেখানে, চালানো হতো নির্মম নির্যাতন, মেরব ফেলা হতো অনেককে। প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককেও সেই টর্চার সেলে নেয়া হয়েছিল, তারা আর ফেরত আসেননি। মজিবর রহমান ক্ষোভে ফুঁসতে থাকলেন, বুকের ভেতর ছাইচাপা আগুনটাকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না তার পক্ষে আর। এমন এক কাজ করে বসলেন, শুনে হতভম্ভ হয়ে গেল সবাই!
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি লিখলেন, এই ক্যাম্পাস ছেড়ে তিনি চলে যাচ্ছেন, কারণ এটা এখন আর বিশ্ববিদ্যালয় নেই, একটা মিলিটারি টর্চার ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। যখন সেনাবাহিনীর শেষ সদস্যটি ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাবে, তখনই তিনি ফিরবেন। চিঠির শেষ অংশে এসে আরেকটা বোমা ফাটালেন, লিখলেন- সংখ্যালঘু এবং প্রগতিশীলদের ওপর নির্মম নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসেবে তিনি তার নাম পরিবর্তন করেছেন, আজ থেকে তার নাম দেবদাস। এই নামেই যেন তাকে ডাকা হয়।
একবার শুধু চিন্তা করে দেখুন, বুকের মধ্যে সাহসের কি স্ফুলিঙ্গ নিয়ে বাস করতেন সাদামাটা এই লোকটা! অফিসিয়াল লেটারে পাকিস্তানী আর্মিকে গণহত্যার জন্য তুলোধোনা করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে টর্চার সেলে পরিণত হতে দেয়ায় প্রশাসনের সমালোচনা করছেন, আবার জানাচ্ছেন, আজ থেকে তার নাম মজিবর রহমান নয়, দেবদাস নামে যাতে তাকে ডাকা হয়! সবাই ভাবলো, এই লোকের মাথা নির্ঘাত বিগড়ে গেছে। নইলে এই অসময়ে এমন আচরণ কেউ করে!
তবে মজিবর রহমানের মাথায় কোন সমস্যা হয়নি, তিনি শুধু ভেতো বাঙালির চাদরটা গায়ের ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। এই ভুখণ্ডের মানুষের ওপর পাকিস্তানীদের এই ভয়াল অত্যাচার তিনি মেনে নিত্ব পারছিলেন না, কোন বিবেকবান মানুষের পক্ষেই সেটা মানা সম্ভব না। কিন্ত অজস্র মানুষ যখন চুপ থাকাটাকে শ্রেয় ভেবেছে, মজিবর রহমান তখন চিৎকার করে উঠেছে আক্রোশে, আঙুল তুলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন।
তারপর যা হবার তাই হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অফিস থেকে তার চিঠি পৌঁছে গেল সেনাদের হাতে। ক্যাম্পাস থেকেই গ্রেফতার করা হলো মজিবর রহমানকে, ভাবলেশহীন নির্বিকার মুখে আর্মি জীপে উঠলেন মজিবর রহমান। চেহারায় দুশ্চিন্তার কোন ছাপ নেই। এই যাত্রাটা যে তার জীবনের শেষ যাত্রা হতে পারে, আর কোনদিন তিনি ফিরে নাও আসতে পারেন, সেসব তিনি তখন ভাবছিলেন বলে মনে হয় না। তাকে গ্রেফতার করতে আসা আর্মির ক্যাপ্টেন যখন তার নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, তখন তিনি শরীরটাকে সোজা করেই জবাব দিয়েছিলেন- মাই নেম ইজ দেবদাস।
সেদিনই তাকে শহীদ জোহা হলের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দেয়া হয় বৈদ্যুতিক শক, লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়, শরীরের স্পর্শকাতর জায়গা ও চোখের কোনায় সুই ঢুকিয়ে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। পরবর্তী সময়ে পাবনা ও নাটোরের বিভিন্ন জেলখানায় নিয়ে গিয়েও তার ওপর চালানো হয় নির্যাতনের স্টিম রোলার।
দেবদাস স্যার ফিরে এসেছিলেন, জীবন্মৃত হয়ে। টানা চার মাস ধরে পাকিস্তানী সেনাদের নির্মম অত্যাচারের।শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধের পর অবস্থা খানিকটা ভালো হলে ফিরে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় তার এই কৃতি শিক্ষককে ফিরিয়ে নেয়ার বেলায় কত বাধার সৃষ্টি করলো! তাকে বলা হলো, দেবদাস নামে কোন শিক্ষক যেহেতু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই, তাকে চাকরি করতে হলে মজিবর রহমান নামেই করতে হবে। কিন্ত নিজের আদর্শ থেকে যাকে পাকিস্তানী সেনারা টলাতে পারেনি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হেরে যাবেন?
শেষমেশ এফিডেফিটের মাধ্যমে নাম পরিবর্তন করলেন তিনি। নানা টালবাহানার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অধ্যাপক দেবদাস নাম গ্রহণ করে তাকে পূর্ণ বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু এরপরেও নানা সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অসহযোগীতার শিকার হয়েছেন অধ্যাপক দেবদাস। বিশ্ববিদ্যাল থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ক্ষোভে অভিমানে ২৫ মে পদত্যাগপত্র পেশ করে চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আসেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এমন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল হয়তো, তারা তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে সব কিছুর ইতি টানে। তবে চাকরি ছাড়লেও, মন থেকে তিনি কখনোই এই ক্যাম্পাসকে মুছে ফেলতে পারেননি। ১৯৭৬ সালে প্রায়ই তিনি লুঙ্গি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে এসে বসতেন, এলোমেলো কথা বলতেন। আবার কখনো কখনো বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকতেন।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর ২০১৫ সালে এই অসীম সাহসী বীরকে একুশে পদক দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছিল। তাকে নিয়ে একাত্তরের দেবদাস নামে একটা গ্রাফিক নভেল তৈরী করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্মের জন্য নিজেকে বিসর্জন দেয়া দেবদাস স্যারের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি এই দেশ এদেশের সরকার, কিংবা মানুষ। বরং স্বাধীন দেশেও তিনি পদে পদে অবহেলার শিকার হয়ে অভিমানেই আড়ালে চলে গেছেন। দ্রোহ আর প্রতিবাদের জ্বলন্ত এক স্ফুলিঙ্গ নিভে গেছে চিরতরে, যে আগুন জ্বলেছিল একাত্তরে, যার খোঁজ আমরা রাখিনি, যার কদর আমরা করতে পারিনি...