এই শহরে ৫০ বছর ধরে থাকি, তবুও এই শহরটা আমার হলো না!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

যতই জাদুর শহর, মায়ার শহর কিংবা তিলোত্তমা- যা খুশি বলি না কেন, দিন শেষে এই শহরটা তো আমাদের আপন হয়নি...
প্রায় পঞ্চাশটা বছর ধরে আলাল শরীফ এই শহরে বাস করছেন। একদম অল্প বয়সে এসেছিলেন বাবা-মায়ের সঙ্গে, যখন ভালো-মন্দ বোধটাও তৈরী হয়নি ঠিকঠাক। পঞ্চাশটা বসন্ত এই শহরে পার করেছেন, তার ছেলে-মেয়েরা এই শহরে জন্মেছে, বড় হয়েছে, পড়ালেখা করেছে, তাদেরও বিয়েশাদী দিয়েছেন। এতগুলো বছর পর যখন সংসার গুটিয়ে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন আলাল শরীফ, তখন আক্ষেপ নিয়েই মানুষটা বললেন, 'পঞ্চাশ বছর আমি এই শহরে ছিলাম, তবুও শহরটা আমার নিজের হয় নাই...' ছোট্ট এই একটা বাক্যের পেছনে যে কতটা হতাশা আর বুক ভাঙা কষ্টের গল্প লুকিয়ে আছে, সেটা কারো বোঝার কথা নয়।
করোনার প্রকোপে অর্থনীতির চাকা থমকে গেছে, যার সরাসরি ভুক্তভোগী আলাল শরীফের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তরা। মধ্যবিত্তের ঘরেও আগুনের আঁচ এসে লাগছে। করোনার কারণে আয় রোজগার বন্ধ, পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তিরা বসে আছেন ঘরে, অনেকের চাকরি চলে গেছে। ঢাকা শহরে হাজার হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেয়ার মতো সামর্থ্য নেই অনেকের, অগত্যা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ির পথ ধরতে বাধ্য হচ্ছে অনেক পরিবার। পেছনে রেখে যাচ্ছেন ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া কিছু স্বপ্ন, আর বিষাদে ঢাকা অজস্র স্মৃতি।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এই আশায় অনেকেই লকডাউনের মধ্যেও বাড়ি যাননি, ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন। সঞ্চয় ফুরিয়ে এসেছে, বকেয়া পড়তে শুরু করেছে বাড়িভাড়া। এদিকে আয়ের খাতা শূন্য। কারো চাকরি নেই, কেউবা বেতন পাচ্ছেন না কয়েক মাস ধরে। কিন্ত এই যুক্তিতে তো আর সংসার চলবে না, বাজার করতে হবে, বাসা ভাড়া দিতে হবে। সবটা মিলিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না ঢাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজ। আর এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতেই ঢাকা ছাড়ছেন তারা দলে দলে।
ভাড়াটিয়াদের এই বিপদের সময়ে ঢাকার বাড়িওয়ালারা যে খুব আরামে আছেন, এমনটা নয় মোটেও। ঢাকার প্রতিটা এলাকায়, অলিতে গলিতে এখন টু-লেটের সমারোহ। আগে যে ফ্ল্যাটের ভাড়া পনেরো হাজার টাকা ছিল, সেটা এখন দশ হাজার টাকায় ছেড়ে দিচ্ছেন বাড়িওয়ালারা, তবুও পাচ্ছেন না ভাড়াটিয়া। কারণ এই মন্দার সময়ে দশ হাজার টাকা বাসা ভাড়ার পেছনে খরচ করার মতো মানুষও যে খুব কম। কাজের সূত্রে ঢাকায় থাকতেই হবে, এমন অনেকে আবার আগের চেয়ে তুলনামূলক কম দামী বাসা ভাড়া নিচ্ছেন। কেউ পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে নিজে ছোট্ট একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকছেন। এই চিত্রটা শুধু ঢাকার নয়, মফস্বলেও দেখা মিলছে এমন অজস্র নজিরের।
পশ্চিম তেজতুরী বাজারের বাসিন্দা শাবানা বেগম। তিনি ওই এলাকায় দুটি ভবনে তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে হোস্টেলের ব্যবসা করতেন। কারওয়ান বাজারের ভাসমান ব্যবসায়ীরা তার বাসায় থাকেন। থাকা-খাওয়ার বিনিময় প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে দিতে হতো প্রতিজনকে। কিন্তু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ভাসমান ব্যবসায়ীরা গ্রামে যাওয়া শুরু করেন। লকডাউন শুরু হবার পর থেকেই তিনটি ফ্ল্যাটই ফাঁকা পড়ে আছে। কিন্তু প্রতিমাসে ওই তিনটি ফ্ল্যাটের ভাড়া গুনতে হয় ৭০ হাজার টাকা। আয় নেই এক টাকাও, ভাড়া দেবেন কি করে- এই দুশ্চিন্তায় এখন শাবানার রাতের ঘুম হারাম।

শুরুতে আলাল শরীফের কথা বলেছিলাম। দুই মাসের বাসা ভাড়া বাকী পড়েছিল তার। কিছু শোধ করেছেন, বাকীটার জন্য মাফ চেয়ে নিয়েছেন। বাড়িওয়ালাই বা কি আর করবেন, তিনি বিদায় জানিয়েছেন আলাল শরীফকে। অনেকে ভাগ্যের এটুকু ছোঁয়াও পাচ্ছেন না, কয়েক মাসের ঘরভাড়া বকেয়া পড়ায় কেউ কেউ মালপত্র রেখেই চলে গেছেন। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত মানুষজন এই কাজটা করতে বাধ্য হচ্ছেন নিরুপায় হয়ে। অনেকের কাছে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার গাড়ি ভাড়াটাও নেই, বাসা ভাড়া পরিশোধ কীভাবে করবেন তারা?
করোনা শুধু জীবনকেই আক্রমণ করেনি, জীবিকা অর্জনের রাস্তাটাও বন্ধ করে দিয়েছে। একটা জিনিস শুধু ভাবুন, এই যে পরিবারগুলো, বছরের পর বছর ধরে এই শহরে আছে, ছেলে-মেয়েরা এখানে বেড়ে উঠছে, তাদের জীবনটা একটা ছন্দে চলছিল, এই শহরটাকে মাটি ভেবে তারা শিকড় গেড়েছিল এখানে। আচমকা একদিন তারা আবিস্কার করলো, এই শহরে তাদের থাকার কোন জায়গা নেই, শহরটার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে চলে যেতে হবে অন্য কোথাও, যেখানে অন্তত খেয়েপরে বেঁচে থাকা যাবে।
এগিয়ে চলো-তে গতকাল একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটার মূলভাব ছিল, এই সংকটের জন্য মধ্যবিত্ত সমাজের বদলে যাওয়া লাইফস্টাইলও অনেকাংশে দায়ী। লেখাটা অনেকেই পছন্দ করেছেন, কেউ কেউ বিরোধিতাও করেছেন। মত-দ্বিমত থাকবে সবকিছুতে, সেটাকে একপাশে সরিয়ে রেখেও বাস্তবতাটাকে কি অস্বীকার করা যাবে? বাস্তবতা তো এটাই যে, কারণ যাই হোক, অজস্র মানুষ ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন, ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের সাজানো সংসার গুটিয়ে অনেক পরিবার ফিরে যাচ্ছে গ্রামে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। মানুষগুলো চলে যাচ্ছেন, পরিস্থিতি ভালো হলে আবার হয়তো ফিরবেন তাদের কেউ কেউ, অনেকে আবার ফিরবেন না। কিন্ত কষ্ট, হাহাকার আর বেদনার যে গল্পগুলো লেখা হচ্ছে তাদের যাবার বেলায়, সেগুলো কি ভুলে থাকা সম্ভব?
যতই জাদুর শহর, মায়ার শহর কিংবা তিলোত্তমা- যা খুশি বলি না কেন, দিন শেষে এই শহরটা তো আমাদের আপন হয়নি...