ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কয়েকটা প্রচলিত কথা আছে, যেমন- একবার এক ছাত্র ক্লাসে স্যারকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা স্যার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গেইট নাই কেন? পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের তো গেইট আছে। স্যার বললেন, সমুদ্রের কখনো গেইট থাকতে দেখেছিস? সমুদ্রের কোনো নির্দিষ্ট গেইট নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশাল এক সমুদ্রের মতো। জ্ঞ্যানের সমুদ্দুর, মুক্তচিন্তার সমুদ্দুর। এই বিশাল সমুদ্রের কোনো কার্পন্য নেই। সবাইকেই দুই হাত ভরে দেয়। সবাই আসতে পারে, সবাই শিখতে পারে। তোকে কেউ আটকাবে না, তুই চাইলে এই সমুদ্র দূর থেকে দেখে চলে যেতে পারিস, আবার চাইলে বিশাল এই সমুদ্র থেকে মনি-মুক্তা খুঁজে নিতে পারিস। এই স্বাধীনতা আছে বলেই গেইট নেই...

আমার ভীষণ ভালো লেগেছিলো যখন প্রথম কথাগুলো শুনি। তখন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলোয়ার। ছাত্র হইনি। অন্য সবাই কী কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়, আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আমি পড়তে চেয়েছিলাম সমুদ্রের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের প্রেমে পড়ার কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আমি কোনো পরিচয়পত্র সংগ্রহ করিনি, না হলের না ডিপার্টমেন্টের। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিক্রি করে বাড়তি কোনো সুবিধা পেতে কখনো ইচ্ছে করেনি। তবুও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে অনেক জায়গায় প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সম্মান পেয়েছি। এরকম একটা ঘটনা বলি। 

একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কাজে ব্যাংকিং বিভাগের এক বন্ধুসহ মতিঝিল গেলাম। এক বহুতল ভবনে সুপরিচিত এক ব্যাংকের এমডি সাহেবের সাথে দেখা হলো। তিনি যখন শুনলেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি, খুবই সমীহ দেখালেন। আমরা যে কাজে গিয়েছি, সেটার কথা শুনে তিনি নিজে রুম থেকে বেরিয়ে কাগজপত্রগুলো খুঁজে দিলেন। আপ্যায়ন করতে চাইলেন। লজ্জামিশ্রিত একটা গর্বের অনুভূতি হয়েছিল। লজ্জাটা এ কারণে যে, নিতান্তই ছোট মানুষ আমরা। মনে হচ্ছিলো, এই সম্মানের যোগ্য হয়ে উঠিনি এখনো। কিন্তু, এই সম্মানটুকু আমার বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে দিয়েছে। 

ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের অধিকাংশ মানুষ খুব সম্মানের চোখে দেখে। যারা দেখে না, তারাও মনে মনে এই বিশ্ববিদ্যালয়টাকে ভালবাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। প্রশাসনিক কারণেই মূলত সমালোচনারগুলোর জন্ম। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো সমুদ্রের মতো সবাইকে ধারণ করতে পারে। আমাদের টিএসসি, শাহবাগ, রাজু ভাস্কর্য, সোপার্জিত স্বাধীনতা, কার্জন হলের প্রাঙ্গন শুধুই কি আমাদের? কত গল্প এখানে এসে জড়ো হয়, তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষী মাটিগুলোই ভাল জানে।

কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে আমরা যে স্বপ্ন দেখি, এমনকি সুহৃদ সমালোচকরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়কে যেভাবে দেখতে চান, সেই জায়গা থেকে আমরা কি সঠিক অবস্থানে আছি? আজকে আমাদের যে অধিকারটুকু, ভালবাসাটুকু আমরা পাই তা পেতাম না, যদি না আমাদের পূর্বপুরুষেরা দেশের জন্য ইতিহাস রচনা না করতেন। তারা যদি একটু স্বার্থপর হতেন, আজকে হয়ত বাংলাদেশটারই সৃষ্টি হতো না। তারা রিয়েক্ট করেছিলেন নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য, আমরা কেন তাহলে ভুলভাল জায়গায় রিয়েক্ট করবো! রিয়েক্ট যদি করতেই হয়, নতুন ইতিহাস সৃষ্টির জন্য রিয়েক্ট করবো। উদ্ভাবনের জন্য রিয়েক্ট করবো। সম্মান শুধু লোগোটার জন্যে না, কাজের জন্যেও যেন পাই সে জন্য রিয়েক্ট করবো! 

আমরা শুধু ঐতিহাসিক সফলতার গল্পে সুখী হয়ে যদি নস্টালজিক হয়ে থাকি, নতুন কিছু সৃষ্টি না করি, পরের প্রজন্মের জন্য ভাল একটা শিক্ষার পরিবেশ না তৈরি করতে পারি, তাহলে শতবছরের পরের শতকে আমাদের নিজেদের নিয়ে গর্ব করার কী থাকবে তা কি আমরা ভেবেছি? 

যাহোক, শিক্ষার কথা যখন আসলো, তখন বলতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যা কিছু শিখেছি তার বেশিরভাগটাই এই ক্যাম্পাসের চরিত্রগুলো থেকে পাওয়া। শ্রেণীকক্ষের লেকচার থেকেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কোনা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। এডমিশন কোচিংয়ে একদিন জাহিদ ভাই বলেছিলো, প্রচলিত এই কথাটা অবশ্য আরো অনেকের মুখেই পরে শুনেছি- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তুমি যদি শুধু হাঁটাহাটিও করো তাহলে যা শিখবা,এক জীবনে এত শিক্ষা টাকা দিয়েও আর কোনো জায়গা থেকে কিনতে পারবা না। এই কথাটার সত্যতা আমি প্রতিদিন পাই। বিভিন্ন কারণে অন্যদের তুলনায় ক্লাস কম করা হয়েছে। তবুও হলফ করে বলতে পারি বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা আমি পেয়েছি, যেটা হয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়া আর কোথাও আমি পাবো না।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী, স্টাফ, দোকানের ছেলেপেলে, চায়ের দোকানি এমনকি বহু বছর ধরে এই এলাকায় রিকশা চালায় এরকম মানুষেরাও অত্যন্ত স্বতন্ত্র স্বত্তার অধিকারী। এরা কেউ খুব ভাল, কি খুব খারাপ সেই বিচারে যাব না, এদের যা ভাল লেগেছে তা হলো- এখানে সবাই আলাদা ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেছে। টাকা দিয়ে সব কিছু এখানে হয় না, আবার শুধু ভালবাসায় আন্তরিকতায় অনেক কিছু সম্ভব হয় এখানে। পরিবেশের প্রভাব বলে একটা কথা আছে যে!

ঢাবি সম্পর্কে প্রচলিত আরেকটা কথা দিয়ে লেখা শেষ করি। এই কথাটাও বেশ কয়েকজন গুণী মানুষের কন্ঠে শুনেছি- 'অন্যরা যা আগামীকাল ভাববে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেটা গতকালই ভেবে রেখেছে। অন্যরা যখন শুধু আজকের কথা চিন্তা করছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন চিন্তা করছে আগামীদিনের কথা।' এটার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু আছে এখন জানি না, কিন্তু সত্যিই এখনই সময় আমাদের আগামীকালের কথা চিন্তা করবার, যে আগামী শুধু নস্টালজিয়ার হবে না, নতুন ইতিহাস হবে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা