ডি ক্যাপ্রিও- এক অবিশ্বাস্য অভিনেতার উপাখ্যান!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় শুটিং করলেন, ভাল্লুকের সাথে যুদ্ধ করলেন, বাইসনের কাঁচা কলিজা খেলেন, ঘোড়ার পেটের ভেতরে ঘুমালেন। এরপরেই মিললো সেই আরাধ্য অস্কার!
তিনি মুগ্ধ হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন! তার মুখ থেকে আপনাআপনি বের হয়ে আসলো- অপূর্ব! একজন মেয়ে যখন আরেকজনের মেয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে “অপূর্ব” বলে সেটাকে আজকের দুনিয়াতে অনেকে ভিন্নভাবে দেখলেও, ১৯৭৪ সালে সম্ভবত এসব জিনিস নিয়ে মানুষ খুব একটা মাথা ঘামাত না। তাছাড়া তিনি যে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন, সে তখন বাস্তবে উপস্থিত ছিল না। তিনি তাকিয়ে ছিলেন একটি পেইন্টিং এর মেয়ের দিকে, আর পেইন্টিং এর সেই মেয়েটির নাম ছিল মোনালিসা।
ইতালির ফ্লোরেন্স এর উফিজি মিউজিয়ামে তিনি মোনালিসাকে মুগ্ধ চোখে দেখছিলেন আর ঠিক তখনই একটি কাণ্ড ঘটলো! তাকে কেও একজন লাথি দিল! একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে লাথি দিলে বা আঘাত করলে স্বাভাবিকভাবে আক্রান্ত মানুষটি কষ্ট পাবে বা প্রতিবাদ করবে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে তিনি উল্টো কাজ করলেন- একই সাথে প্রচণ্ড অবাক আর আনন্দিত হলেন! ঘটনাটা অবশ্য আনন্দিত হওয়ার মতই। নিজের ভেতরে গত দশ মাস ধরে আরেকটি সত্ত্বাকে তিনি যে লালন করে আসছেন, তাকে লাথি মেরেছে সেই সত্ত্বা! হ্যাঁ, তার সেই অনাগত সন্তান।
প্রচণ্ড খুশিতে Irmelin নামের সেই মহিলা কি করবেন ভেবে পেলেন না! এই অনুভূতি শুধুমাত্র একজন গর্ভবতী মা-ই বুঝবে, আর কেও না। যতটা সম্ভব দ্রুত এসে স্বামীর কাছে এই ঘটনা বললেন। আরও বললেন- যেহেতু এই ঘটনা লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির বিখ্যাত মোনালিসা পেইন্টিং দেখার সময়ে হয়েছে, এই কারণে তিনি নিজেদের অনাগত সন্তানের নাম লিওনার্দো দিয়ে রাখতে চান। স্বামী সহাস্যে রাজি হলেন।
জন্মের আগেই নাম ঠিক হয়ে যাওয়া পুত্র অবশেষে পৃথিবীতে আসলেন। বাবা ছিলেন ইতালির আর মা ছিলেন জার্মানির, কিন্তু ছেলের বেড়ে ওঠা লস অ্যাঞ্জেলসে। কমিক বুক আর্টিস্ট বাবার অনেক আগেই থেকেই মিডিয়ার প্রতি আকর্ষণ আর মিডিয়ার লোকদের সাথে অল্পস্বল্প পরিচিতি ছিল। বাবার প্যাশন ছেলের মাঝে ঢুকতে খুব একটা সময় নেয়নি।
বয়স তখন মাত্র তিন বছর, একদিন রাস্তায় হাঁটার সময় হিপ্পিদের একটি স্ট্রীট পার্টিতে বাবা নিজের ছেলেকে তুলে দিলেন নাচতে, ছেলেও কিছু না বুঝে নাচা শুরু করল। সেখানে উপস্থিত ছিল প্রায় ১০০ এর মত মানুষজন। তিন বছরের ছেলের এন্টারটেইন করার ক্ষমতা দেখে বাবার সাথে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই ১০০ এর মত মানুষ। বাবা তখনই বুঝেছিলেন- তার একমাত্র এই সন্তান একাই একশ হবে একদিন।
ছেলের প্রতিভা সম্পর্কে বাবা মা দুইজনেই ভাল বুঝলেও, নিজেদের মাঝেও সম্পর্কের সমীকরণগুলো খুব একটা বুঝতে পারছিলেন না। ফলাফল যা হয় তাই- ডিভোর্স। তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে মা চলে আসলেন, মায়ের কাছেই বড় হতে থাকলেন জন্মের আগেই মাকে লাথি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়া সেই ছেলে। বাবার ছায়া সরে যাওয়ার কারণে পাশাপাশি দেখতে লাগলেন- অভাব জিনিসটা কি। যেখানে থাকতেন তার আশপাশেই মাদকাসক্ত মানুষ আর যৌনকর্মীদের ছড়াছড়ি। অভাবের সাথে সাথে মানুষের অন্ধকার দিকটাও তিনি অনেক আগেভাগেই দেখে ফেলেছিলেন।
অভাবে নাকি স্বভাব নষ্ট হয়, কিন্তু তার ক্ষেত্রে হল উল্টো। জেদ বেড়ে গেল। অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল অনেক আগে থেকেই, সেটাই ঠিকমতো করার চেষ্টা করলেন। ক্লাসে পড়াশুনা ঠিকমতো করতেন না, তবে চালাক ছিলেন, যারা ভাল করে পড়াশুনা করত, তাদের পাশে বসতেন সবসময়। পাঁচ বছর বয়সে প্রথমে টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন অডিশন দেয়ার জন্য, তবে প্রচণ্ড দুষ্টামি করার কারণে তাকে বাদ দেয়া হল। এরপরে আবার অডিশন, আবার বাদ পড়া বা ছোটোখাটো রোল পাওয়া। রোল পেতেন বা না পেতেন, বন্ধু কীভাবে যেন জুটিয়ে ফেলতেন।
এই অডিশনের সময়ই একদিন পরিচয় হল টবি ম্যাগুয়েরের সাথে, ছোটবেলার সেই বন্ধুত্ব এখনও অটুট আছে- শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও সত্যি! এই বন্ধুর সাথে মিলেই একবার একটি সিনেমা বানিয়েছেন, কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর সেটা দেখে নিজের কাছেই এত জঘন্য লেগেছিল যে এই সিনেমা যেন কখনো রিলিজ না হয় এই কারণে আইনের আশ্রয় নিয়েছিলেন!
টিভি থেকে শুরু করা মানুষটি অবশেষে এদিন সিনেমাতে ডাক পেলেন। ১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়া লো বাজেটের এই হরর সিনেমার নাম Critters 3. সিনেমা খুব একটা নজরে না আসলেও, নিজের কাজের বেলায় তিনি ঠিক ছিলেন। যদিও খুবই ছোট্ট একটা রোলে তাকে কতজন ঠিকমতো দেখেছিল সেদিন, সেটা ব্যাপক গবেষণার পরে বুঝা যাবে। এরপরে আবার ব্যাক টু দ্যা প্যাভিলিয়ন- মানে টিভিতে ফিরে আসা।
১৯৯৩ সালে আবার সিনেমার কাজ পেলেন আর এই সিনেমাতে তার সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি রবার্ট ডি নিরো। নিরো আর স্করসিজের জুটির তখন জয়জয়কার অবস্থা। এই নিরো শত শত ছেলের অডিশন নিয়ে অবশেষে তাকে সিলেক্ট করলেন এই সিনেমার জন্য। ১৯৯৩ সালে মুক্তি পাওয়া This Boy’s Life নামের এই সিনেমাতে ছেলের অভিনয় দেখে নিরো এতটাই মুগ্ধ হলেন যে স্করসিজকে বললেন, ভবিষ্যতে জানি না তোমার সাথে আর কতদিন কাজ করতে পারব, তবে আমার মনে হচ্ছে আমার পরে এই ছেলের সাথে কাজ করেই তুমি অন্যরকম আনন্দ পাবে।
তিনি যে খুব একটা ভুল বলেন তিনি, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম সেই বছরেই। সেই বছরেই মুক্তি পেল What’s eating gilbert grape নামের একটি সিনেমা। এই সিনেমাতে প্রতিবন্ধী শিশুর ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করে তিনি জিতে নিলেন জীবনের প্রথম অস্কার মনোনয়ন, তবে বেষ্ট অভিনেতা ক্যাটাগরিতে না, বেষ্ট সাপোর্টিং রোলে। মনোনয়ন পেলেও অস্কার পেলেন না, কিন্তু তখন আর কে জানত- ছোট্ট অস্কার নামের এই মূর্তির সাথে তার শত্রুতা তখন মাত্র শুরু হল!
যদিও ১৯ বছর বয়সের সেই ছেলে তখন সবচেয়ে কম বয়সী অভিনেতা হিসেবে অস্কার মনোনয়ন পাওয়া লিস্টে ৭ নাম্বারে নিজের নামটি নিয়ে আসলেন, অস্কার না পেলেও। কি আর করা, আপাতত এই নিয়েই খুশি থাকলেন। তবে এই সিনেমার ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন- এই সিনেমাতে কাজ করে আমি যেই মজা পেয়েছি, সেটা অন্য সিনেমার সাথে তুলনা চলে না।
দুই বছর পরে অভিনয় করলেন দ্যা বাস্কেটবল ডায়রিজ নামের সিনেমাতে। মাদকাসক্ত ছেলের ভূমিকায় তার ম্যাচিউরড অভিনয় দেখে অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তিও সম্ভবত ভয় পেয়ে যাবেন- এতটাই অসাধারণ অভিনয় করলেন তিনি। যদিও এই ক্যারেক্টারের জন্য তার সাথে অডিশন দিয়েছিলেন মার্ক ওয়েলবার্গ, এবং মার্কের ভাল অডিশনের কারণে মার্কের প্রতি তার কিছুটা অপছন্দের অনুভূতিও ছিল, কিন্তু শেষমেশ নিজে এই সিনেমাতে কাজের সুযোগ পাওয়াতে এই অনুভূতি তিনি আর খুব বেশিদিন জিইয়ে রাখেননি। তবে তিনি নিজেকে জিইয়ে রেখেছিলেন নিজের অভিনয় দ্বারা, প্রমাণ ১৯৯৬ সালে মুক্তি পাওয়া রোমিও জুলিয়েট সিনেমা।
শেক্সপিয়ারের অমর এই সৃষ্টিকে নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেই। তবে রোমিও জুলিয়েটে তাকে দেখে তার সাথে যোগাযোগ করলেন ডিরেক্টর জেমস ক্যামেরুন। ডুবে যাওয়া একটি জাহাজে দুইজন প্রেমিক প্রেমিকার মাঝের প্রেম নিয়ে একটি সিনেমা বানাচ্ছিলেন তখন তিনি। রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয়ের কোন ইচ্ছে না থাকলেও অবশেষে জেমস ক্যামেরুন অনেক কষ্টে সেই ছেলেকে রাজি করালেন। যার ফলাফল হলো অবিশ্বাস্য!
টাইটানিক নামের সেই সিনেমা যেন ইতিহাস তৈরি করল, ডুবে যাওয়া জাহাজের কাহিনী তার ক্যারিয়ারকে একদম নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। ব্যবসার সর্বকালের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিল, নতুন রেকর্ড স্থাপন করল! আমেরিকার প্রতিটি মেয়ের যেন স্বপ্নের পুরুষ হয়ে গেলেন তিনি। একটি নয়, দুটি নয়- ১১ টি অস্কার পেল এই সিনেমা, শুধু তিনি বাদে, নমিনেশন পর্যন্ত পাননি। জেদ এতটাই বেশি ছিল যে- অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রামেও তিনি যাননি পরিচালকের শত অনুরোধের পরে। তার সাফ কথা- আমি নমিনেশনই পাই নাই, আমি কেন যাব? কি করতে? তার চেয়ে টিভিতে ভাল করে প্রোগ্রাম দেখা যায়, আপনারা যান।
টাইটানিক নাম বলার পরে আশা করি বুঝতে অসুবিধা হবে না যে এই ছেলের নাম কি? নাম তার লিওনার্দো ডি কেপ্রিও। অনেকের হলিউড পরিচিতি ঘটেছে বলতে গেলে টাইটানিক সিনেমা দিয়ে, সেই ক্ষেত্রে ডি কেপ্রিওর প্রতি ভাল লাগা আমাদের আশৈশব বলা যায়। তবে টাইটানিকের জন্য নমিনেশন না পাওয়ার জেদটাই সম্ভবত পরের দশকে নতুন এক কেপ্রিওকে জন্ম দিল।
টাইটানিকের বেঁচে যাওয়া শেষ যাত্রীর হসপিটাল বিল তিনি আর সহকর্মী ক্যাট উইনস্লেট মিলেই দিলেন। নিজের এক ইন্টার্ভিউতে তিনি বললেন- Yes, I can play younger than my age. But I can play characters older than I am, too. I'm not an actor who can just play the kid. পরিচালক স্করসিস এতদিন নিরোর কথাকে মাথায় রেখেছিলেন, অবশেষে তিনি সেটাকে বাস্তবে রুপ দিলেন। গ্যাংস অফ নিউইয়র্কে তিনি কেপ্রিওকে নিলেন ড্যানিয়েল ডে লুইস এর সাথে- ফলাফল দারুণ একটি সিনেমা। এরপরে আসলো সত্য ঘটনার উপরে নির্মাণ করা সিনেমা- ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান, যেখানে তার সাথে ছিলেন টম হেঙ্কস। স্পিলবার্গের এই ফান রাইড সিনেমা নিয়ে প্রশংসা যত করব, ততই কম হবে।
তবে ২০০৪ সালে করা দ্যা এভিয়েটর সিনেমাটি তাকি নিয়ে গেল অন্য উচ্চতায়। অনেক সমালোচকদের মতে এটি এখন পর্যন্ত কেপ্রিওর বেষ্ট পারফর্মেন্স। এই সিনেমাতে কাজ করার সময়ই কেপ্রিও সবার কাছে প্রকাশ করলেন যে তিনি ছোটবেলায় OCD (Obsessive–compulsive disorder) নামের রোগে আক্রান্ত ছিলেন যেটা আবার ফিরে এসেছে কারণ এই সিনেমাতে তার ক্যারেক্টারটাও একই রকম OCD দ্বারা আক্রান্ত।
প্রচণ্ড ভাল অভিনয় করা সত্ত্বেও এবারো অস্কার নামের সোনার মূর্তি থেকে তিনি বঞ্চিত থাকলেন নমিনেশন পাওয়া সত্ত্বেও। তবে ভাল সিনেমা করা থেকে নিজেকে তিনি বঞ্চিত রাখেননি। নিজের প্রিয় অভিনেতা জ্যাক নিকলসনের সাথে কাজ করলেন দ্যা ডিপার্টেড নামের সিনেমায়, তবে জ্যাক নিকলসনের দাপটে তিনি অদৃশ্য হয়ে যাননি পর্দা থেকে। এরপরে করলেন ব্লাড ডায়মন্ড নামের সিনেমা। এবারও অস্কারে মনোনয়ন এবং যথারীতি অস্কার থেকে বঞ্চিত।
তবে বঞ্চিত হওয়ার কষ্ট কেমন, সেটা ততদিনে তিনি টের পেয়ে গিয়েছিলেন- ফলাফল- এই সিনেমার কাজের সময় তিনি আফ্রিকান এক মেয়েকে দত্তক নিলেন। এই মেয়ের পড়ালেখা থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ তিনি বহন করা শুরু করলেন, প্রতি মাসে টাকা যথাসময়ে পাঠিয়ে দিতেন। এখনও নিয়ম করে প্রতি রাতে তার খোঁজখবর নেন। জন্মদাতা অনেক বাবাও এতটুকু করতে পারেন কিনা বা করেন কিনা, সেই বিষয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। এই পালক মেয়ের দোয়াতেই সম্ভবত সেই বছর হাঙরের পেটে যাওয়ার হাত থেকে তিনি একটুর জন্য বেঁচে গেলেন। এছাড়া স্কাইডাইভিং করতে গিয়ে দেখেন নিজের প্যারাসুট খুলছে না, সেবার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত- কিন্তু কপাল ভাল যে একজন ইনস্ট্রাক্টর তখন ঐখানে ছিলেন আর তিনি তাকে বাঁচান।
ওদিকে পর্দায় চলছিল একের পর এক দুর্দান্ত কাজ। বডি অফ লাইজ, রেভলিউশনারি রোড, শাটার আইল্যান্ড, ইনসেপশন- কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব? প্রতিটা সিনেমাতে যেন তিনি নিজেকে ভেঙেছেন আর আবার নিজেকে গড়েছেন। শাটার আইল্যান্ডে পুরো সিনেমাতে এক ধরনের অভিনয় করে দর্শকদের শেষে গিয়ে একদম হতভম্ব করে দেয়া, স্বপ্নের মাঝে চিন্তা চুরির মত অসাধারণ কনসেপ্ট এর ইনসেপশন- দর্শক থেকে সমালোচক সবাই শুধু মুগ্ধ- সবার মুখে শুধু কেপ্রিও।
তারান্তিনো নিজের ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস সিনেমার জন্য অনেক আগেই তাকে অফার করেছিলেন, তবে তিনি বিনয়ের সাথে না করে দেন। অথচ তার সেই ছেড়ে দেয়া রোল করে পরে অস্কার বগলদাবা করেন ক্রিস্টোফার ওয়ালটজ। ছেড়েছেন আরও অনেক বিখ্যাত সিনেমা- আমেরিকান সাইকো, স্পাইডারম্যান, বুগি নাইটস, স্টার ওয়ার্স এর একটি পর্ব... থাক, আর না বলি, শেষে আফসোসের তালিকা লম্বাই হবে শুধু। তবে সবচেয়ে বড় আফসোস ছিল- এতদিন ভাল কাজের পরেও অস্কার না পাওয়াটা। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সব জায়গায় এই বিষয় নিয়ে মজা, প্রশ্ন, ট্রল, meme সব চালু ছিল। তার ফ্যান থেকে শুরু করে সিনেমার সবাই এই জিনিসটা নিয়ে কথা বলতেন, তিনি সেখানে চুপ থাকতেন, চুপচাপ কাজ করে যেতেন।
কিন্তু এরকমই চুপিচুপি একদিন তারান্তিনোর সাথে অবশেষে কাজ করলেন Django Unchained সিনেমাতে। খুবই ছোট্ট একটা রোল, কিন্তু বিশেষ একটি সিনেমা নিজের হাত কেটে সত্যি সত্যি রক্ত বের হওয়ার পরেও তিনি নিজের ক্যারেক্টার থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও বের হননি- এর নাম ডেডিকেশন, এর নাম ছিল ডি কেপ্রিও।
জীবনে কখনো মাদককে না ছুঁয়ে এরপরে সম্ভবত জীবনের অন্যতম কঠিন রোলটি করলেন- দ্যা উলফ অফ ওয়াল স্ট্রীট। এই সিনেমার জন্যও তিনি এক বিন্দু মাদক স্পর্শ করেননি, এক্সপার্টদের সাহায্য নিয়েছেন কিন্তু মাদক ছুঁয়ে দেখেননি। অথচ সিনেমা দেখলে এই জিনিসে কেউ বিশ্বাস করবে না। এত অসাধারণ অভিনয়, আবারও অনেকদিন পর অস্কার মনোনয়ন- কিন্তু এবারও ঘুরেফিরে যেই লাউ সেই কদু! অস্কার নামের নিষ্প্রাণ মূর্তি আবারও অধরা এই প্রাণবন্ত অভিনেতার কাছ থেকে।
তারপর করলেন সেই বিখ্যাত সিনেমা- দ্যা রেভেনেন্ট। মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় অভিনয় করলেন (চোখের পাতা ফেলতে পারছিলেন না একটা সময়, ঠাণ্ডায় চোখের পাতা পর্যন্ত জমে গিয়েছিল!), ভাল্লুকের সাথে যুদ্ধ করলেন, বাইসনের কাঁচা কলিজা খেলেন, ঘোড়ার পেটের ভেতরে ঘুমালেন- এরপরে অবশেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি তার হাতে উঠলো সেই কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার- অস্কার!
প্রথমবার মনোনয়ন পাওয়ার ২২ বছর পর আর পাঁচবার মনোনয়নের পর অস্কার আসলো তার হাতের মুঠোয়- অথচ স্পীচ দেয়ার সময় তিনি একদম শান্ত বালক বলা যায়! যেন অস্কার তার হাতেই আসার কথা ছিল এবার। অস্কারের মূর্তি হাতে নিয়ে তিনি আবেগে একদম বিগলিত হয়ে যাননি, লোভের জন্য, নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য যারা প্রকৃতির ক্ষতি করে– তাদের সম্পর্কে হুঁশিয়ারি তিনি অস্কারের মঞ্চেও ঘোষণা করেছেন।
ধন্যবাদ দিতে কখনো ভুলেন না রবার্ট ডি নিরোকে, আর নিজের মাকে- এই মানুষটার জন্যই নাকি আজ তিনি এখানে, এই মানুষটাই ছোটবেলায় তিন ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তাকে অভিনয়ের স্কুলে নিয়ে যেতেন- সেই কৃতজ্ঞতা এখনও তিনি স্বীকার করেন সবার সামনে। অভিনয়ের তালিম নিয়েছিলেন যেই ব্যক্তির কাছ থেকে, সেই Thell reed কেও (যিনি আবার ব্রাড পিট, রাসেল ক্রো, এডওয়ার্ড নরটন এর মত লোকদের গুরু) কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। ঐদিকে তার অস্কার জয়ের ঘটনায় তার ফ্যানরা কিন্তু পাগল ততক্ষণে! টুইটারে প্রায় সাড়ে চার লাখের কাছাকাছি টুইট ততক্ষণে হয়ে গেছে যা একটি রেকর্ড!
প্রকৃতির প্রতি কেপ্রিওর ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার তিনি খরচ করছেন প্রকৃতির কল্যাণে। বাঘ, তিনি, কচ্ছপ- প্রভৃতি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর জন্য সমানে ডলার খরচ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি একজন অতি সচেতন পরিবেশ উন্নয়ন একটিভিস্ট। ১০৪ একরের একটি দ্বীপ তিনি কিনেছেন, সেটাকে ইকো ফ্রেন্ডলি হিসেবে গড়ে তুলবেন বলে, সবার সামনে উদাহরণ তৈরি করতে চান বলে। পরিবেশের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে তিনি সপ্তাহে একদিন গোসল করেন যাতে পানির অপচয় না হয়। পরিবেশ উন্নয়নমূলক যেকোনো সম্মেলনে তিনি ছুটে যান শত ব্যস্ততার মাঝেও। The 11 th hour আর before the flood নামের দুটি পরিবেশ সচেতনতামূলক কাজও তিনি আমাদের সামনে হাজির করেছেন।
নিজের পোষা বিড়াল, কচ্ছপ, গিরগিটি আছে তার, তাদের সাথে বেশ ভাল সময় কাটে তার। প্রাণীদের সাথে সম্পর্ক যতটা ক্লোজ তার, বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে সম্ভবত ততটা ক্লোজ না- এই কারণেই এখনও অবিবাহিত। যদিও একাধিক নারীর সাথে প্রেম করেছেন তিনি। রুপালী পর্দায় রোমিও এর ক্যারেক্টারে অভিনয়ে করলেও- বাস্তবে নাকি তিনি কখনই এমন না বলে নিজেই স্বীকার করেন। এরপরেও শত শত তরুণী এখনও আশায় আছেন- একদিন হয়ত তাদের মাঝ থেকে কাউকে তিনি হ্যাঁ বলেন, পর্দার মানুষটা বাস্তব জীবনেও হয়ত রোমিও হবেন!
অস্কারের মত জিনিস যদি এতদিন পরে হাতে আসতে পারেন, তবে সম্পর্কের ব্যাপারে আশাবাদী হতে ক্ষতি কি? প্রায় ২০০ মিলিয়ন সম্পদের অধিকারী এই মানুষটি এখনও আগের মতই আছেন যেমনটা ছোটবেলায় ছিলেন। ছোটবেলায় যেই লাইব্রেরীতে পড়তেন, সেখানে নিজের খরচে একগাদা কম্পিউটার দান করেছেন। এছাড়া অন্যান্য চ্যারিটেবল ওয়ার্ক তো আছেই!
“স্টার হয়েছি বলে আমাকে নম্র হতে হবে বা জোর করে ভদ্র হতে হবে, এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি যা, আমি তাই। কেউ যদি এসে বলে আমার সিনেমা তার কাছে ভাল লেগেছে, তাহলে যথাসম্ভব বিনয়ী হয়ে তাকে ধন্যবাদ দেই- এই তো। অভিনয় আমার কাছে অসাধারণ লাগে- আপনি আরেকজনের জীবনে বাস করতে পারবেন আবার এর বিনিময়ে আপনাকে টাকা দেয়া হচ্ছে- জিনিসটা বেশ!”
তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ক্যাট উইনস্লেট কেপ্রিওর অভিনয় ক্ষমতা সম্পর্কে বলেছেন- নিঃসন্দেহে আমাদের জেনাশনের সবচেয়ে প্রতিভাবান অভিনেতা। আমাদেরও সবারও আশা করি এটাই মত, নিঃসন্দেহে। দিনদিন নিজেকে তিনি আরও ছাড়িয়ে যান, অভিনয়ের আরও নতুন দিক আমাদের সামনে হাজির করুন- এই কামনায়- শুভ জন্মদিন লিওনার্দো ডি কেপ্রিও! অস্কার ধন্য হয়েছে ২০১৬ সালে, তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন