দিল বেচারা: সুশান্তের মহাকাব্যিক প্রস্থান!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কেউ জানতো না যে সুশান্তের শেষ সিনেমা এটাই হতে যাচ্ছে। 'দিল বেচারা' গান গাইতে যাবার সময় এ আর রহমান জানতেন না। সুশান্তের মৃত্যু দৃশ্য শ্যুট করার সময় জানতেন না পরিচালকও। সুশান্ত নিজেও তো জানতেন না, এত জলদি পৃথিবী ছাড়তে হবে তাকে...
২০১২ সালে জন গ্রিন যখন দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস বইটি প্রকাশ করলেন তখন সুশান্ত সিং রাজপুত পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে বসে তার প্রথম সিনেমা ‘কাই পো ছে’র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হয়তো সুশান্তের পড়া হয়েছিল বইটি তখনই, নাও পড়ে থাকতে পারেন। কিন্তু হ্যাজেল গ্রেস ও অগাস্টাস ওয়াটারসের জীবনের গল্প ঠিকই জানা হয়েছে নিশ্চিত ২০১৪ তে বইয়ের গল্পটি সিনেমা হিসেবে মুক্তি পাবার পর। ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস’ সিনেমা সেসময় ব্যপক ব্যবসাফল ও প্রশংসিত হয়েছিল। পৃথিবীজুড়ে যে মানুষগুলো ভালবাসতে জানতো তাদের হৃদয় নিংড়ে দিয়েছিল যেন এই গল্পটি।
দুই ক্যান্সার আক্রান্ত তরুণ তরুণীর পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলা ও মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও জীবনটাকে যাপন করে নেয়ার গল্পই বলা হয় এই সিনেমায়। এই সিনেমা মুক্তির ৬ বছর পরে সুশান্ত সিং রাজপুত ও সাঞ্জানা সাঙ্ঘি অভিনয় করলেন অফিশিয়াল রিমেক ‘দিল বেচারা’তে। যেটি মুক্তি পাচ্ছে ২৪ শে জুলাই। যে গল্প মৃত্যুর আগে বেঁচে থাকার জয়গান গেয়েছে সে গল্পই কিনা সুশান্তের মৃত্যুকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। শেষবারের মতো পর্দায় দেখতে পাওয়া যাবে সময়ের জনপ্রিয় এই তরুণ তারকাকে, সুশান্তও কি দেখবে তারা হয়ে?
প্রথমে যখন কাস্টিং ডিরেক্টর মুকেশ ছাবড়া এই সিনেমা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন তখন সিনেমার নাম দেয়া হয় ‘কিজি ও মান্নি’। সুশান্ত সিং রাজপুত ও নবাগতা সাঞ্জানা সাঙ্ঘিকে নেয়া হয় মূল চরিত্রে। ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস’ এর মূল শক্তি তার মিউজিক্যাল স্কোরে। তাই মুকেশ ছাবড়া তার সিনেমার ন্যারেশন দিতে চলে যান এ আর রহমানের কাছে। রহমান মুকেশের ন্যারেশন ও তার প্যাশন দেখে পাঁচ মিনিটের মাথায়ই রাজি হয়ে যান এই সিনেমার মিউজিক দিতে। অমিতাভ ভট্টাচার্য দায়িত্ব নেন লিরিকের। কাজ শুরু হয়ে যায় সিনেমার।
তখনো কেউ জানতো না যে সুশান্তের শেষ সিনেমা এটাই হতে যাচ্ছে। দিল বেচারা গান গাইতে যাবার সময় রহমান জানতেন না। সুশান্তের সাথে শেষ সিন করার সময় সাঞ্জানা জানতেন না। সুশান্তের মৃত্যু দৃশ্য শ্যুট করার সময় জানতেন না পরিচালকও। সুশান্ত নিজেও তো জানতেন না। তিনি জানতেন দারুণ একটা সিনেমায় কাজ করছেন তিনি। পরিচালনায় বলিউডের সবচেয়ে সফল কাস্টিং ডিরেক্টর। মিউজিক দিচ্ছেন এ আর রহমান। বক্স অফিসে সফল হবে এই সিনেমাটি তার। তার কাজের প্রশংসা হবে। এসব স্বপ্নই ছিল হয়তো তার মনে। কিন্তু কোন স্বপ্নই পূর্ণতা পেলো না। এতো স্বপ্নবোঝাই সিনেমাটিকে থিয়েটারে রিলিজ করা গেল না।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ভিউ দেখে যদি সিনেমাকে হিট-সুপারহিট বলা যেত তাহলে তো হতোই। সিনেমা বানানোর পথেও তো বারবার বাঁধা এসেছে তাদের সামনে। একাধিকবার পোস্টপোন হয়েছে। মি ঠু এলিগেশনের কারণে, পোস্ট প্রোডাকশনে দেরি হবার কারণে আর শেষমেশ প্যান্ডেমিকের কারণে বারবার রিলিজ ডেট পেছাতে হয়েছে। সুশান্তের ডিপ্রেশনে আরেকটি পালক যোগ করেছিল যেন এই সিনেমাটি। শেষমেশ যখন রিলিজ ডেট ঘোষণা হল তখন সে সিনেমা দেখার জন্য সুশান্তই রইলেন না। ফল্ট ইন আওয়ার স্টারসের অগাস্টাসের মতো, দিল বেচারার মান্নির মতো সুশান্তও বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে কাউকে কিছু না বলেই।
ফল্ট ইন আওয়ার স্টারসের গল্পটা ছিল ক্যান্সার আক্রান্ত দুই চরিত্রকে নিয়ে। এর মাঝে হ্যাজেল গ্রেস থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সাপোর্ট সেন্টারে বন্ধু খুঁজছে অন্যদিকে ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাওয়া অগাস্টাস জীবন যাপন করার শিক্ষা দিচ্ছে। দুজনের দেখা হয়, পরিচয় হয়, বই ভাগাভাগি হয়, গল্প হয় তারপর একদিন প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু মৃত্যু যেখানে নিশ্চিত গন্তব্য সেখানে ভালোবাসা কতোটুকুই বা সফল হতে পারে। তবে হ্যাজেল আর গাসের ভালোবাসা সফল হয়েছিল। কারণ গাস হ্যাজেলকে নিয়ে ভালোবাসার মুহূর্তগুলোকে খুব করে যাপন করে নিয়েছিল। হ্যাজেলকে বুঝিয়েছিল যে ক’টা দিনই বাঁচি না কেন, ভালোবেসে বাঁচতে হবে। হ্যাজেল যেন নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পেলো। কিন্তু মৃত্যু গাসকেই আগে কেড়ে নিলো। আর হ্যাজেলের বাকি ক’টা দিনের জন্য রেখে দিয়ে গেল স্মৃতি।
দিল বেচারা সিনেমাতেও ঠিক একই গল্প, স্রেফ কন্টেক্সট বদলে দিয়ে। কিজি আর মান্নির সাথে আমরা যেন জীবনকে বেঁচে নেয়াই শিখবো। কিজিকে জীবনের মানে শেখানো মান্নি ঠিকই আগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে কিন্তু ভালোবাসা শিখিয়ে দিয়ে যাবে। যেমনটা শিখিয়েছিল মান্নিরুপী সুশান্ত। যেটুকু বেঁচেছেন হাসি ছড়িয়েছেন, আনন্দে রেখেছেন সামনের মানুষটিকে। নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে, নিজের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে শুধু ভালোবাসা বিলিয়ে গেছেন। সেটা ছিছোড়ের আন্নি হোক কিংবা কাই পো ছের ইশান। সুশান্ত সবসময় সম্ভাবনা খুঁজেছেন, জীবনকে নতুন অর্থ দিতে চেয়েছেন। ‘দিল বেচারা’ সিনেমায় সে জীবনকেই আবার যাপন করতে শিখিয়ে যাবেন শেষবারের মতো।
দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারসে হেজেল আকাশের তারারাশির মাঝে অগাস্টাসকে খুঁজে বেড়াতো। দিল বেচারাতেও কিজি হয়তো সে তারার মাঝেই খুঁজবে তার মান্নিকে। আমরাও যদি কখনো রাতের আকাশ দেখি, তাকাতে পারি চাঁদ আর তারারাশির মাঝে। চাঁদে জমি কিনে মহাশূন্যে থাকতে চাওয়া সুশান্তকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে সেখানেই। সদা হাস্যোজ্জল সুশান্তকে শেষবারের মতো দিল বেচারাতে দেখার পর আকাশে খোঁজা ছাড়া তো আর উপায় থাকবে না। এই মন বেচারাকে বুঝ দিতে হবে যে চলে গেছে তাকে এবার চলে যেতে দিতে হবে, তার প্রস্থান মেনে নিতে হবে। দিল বেচারা দিয়েই হতে যাচ্ছে সুশান্তের মহাকাব্যিক প্রস্থান...