সিনেমার প্রত্যেক অভিনেতা অভিনেত্রীকে রীতিমত খাটিয়ে মেরেছিলেন পরিচালক ফারহান আখতার। বিরক্তির চোটে একটা সময় প্রীতি জিনতা তো 'দিল চাহতা হ্যায়' থেকে সরেই যেতে চেয়েছিলেন!

২০০১ সাল। ফারহান আখতার বলিউড ইন্ড্রাস্ট্রিতে বলতে গেলে সম্পূর্ন নতুন একজন মুখ। না, অভিনেতা হিসেবে নয়। আমরা বর্তমানে যে অভিনেতা ফারখান আখতারকে চিনি, তিনি শুরুতে অভিনেতা হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেননি! ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন পরিচালক হিসেবে! ফারহান আখতারের অভ্যাস হচ্ছে ডায়েরী লেখা। যেখানেই যেতেন তিনি, রোজকার জীবনের নানা কথা লিখতেন ডায়েরীতে। লেখালেখির পাশাপাশি ফারহান আখতারের খান্দানি অভ্যাস ছিল একটা, ঘোরাঘুরি। একটু সময় পেলেই দেশ এবং দেশের বাইরের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। 

১৯৯৬ সালে এরকমই এক ট্রিপে একবার তিনি গিয়েছিলেন নিউইয়র্কের লাস ভেগাসে। স্বভাবতই সাথে ছিল তার প্রিয় ডায়েরীটা। এক সন্ধ্যায় লাস ভেগাসের ব্যস্ত কোন এক সড়কে বন্ধুকে সাথে নিয়ে হাঁটছিলেন তিনি। হঠাৎ তার সেই বন্ধু একটা ছোট্ট গল্প বলে, যে গল্পটা ছিল তিন বন্ধুকে নিয়ে। বন্ধুর মুখে গল্পটা শুনে ফারহান আখতার যেন ভেতরে ভেতরে চমকে যান! দ্রুত সেদিন হোটেলে ফিরে ডায়েরীতে গল্পটার সারসংক্ষেপ লিখে ফেলেন তিনি। সেই গল্পে আকাশ এবং শালিনী নামে দুটো ক্যারেক্টার ছিল, যাদের মধ্যকার ঘটনা ফারহানের কোনো এক ফ্রেন্ডের সাথে বেশ মিলে যায়! 

ফারহান এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করেন, গল্পের বাকি ডালপালা তিনি জোগাড় করেন শেক্সপিয়রের নাটক "Much Ado About Nothing" থেকে। অনেক খেটেখুটে অবশেষে তিনি সিনেমার পান্ডুলিপি লেখার কাজ শেষ করেন। এবার গল্পটাকে চলচ্চিত্রে রূপ দেবার পালা। এই গল্পে তিন বন্ধুর ক্যারেক্টারে ফারহান প্রথমে চেয়েছিলেন হৃতিক রোশান, অভিষেক বচ্চন এবং অক্ষয় খান্নাকে। অক্ষয় খান্না সিনেমায় অভিনয় করার ব্যাপারে সম্মতি দিলেও হৃত্তিক এবং অভিষেক শিডিউল জনিত ব্যস্ততার কারণে সিনেমায় কাজ করার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন। 

এরপর বাকি দুটো ক্যারেক্টার এর জন্য অভিনেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে থাকেন তিনি। শেষ পর্যন্ত দুই খান- আমির খান এবং সাইফ আলি খান বাকি দুটো চরিত্রে অভিনয়ের ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেন। একে একে প্রীতি জিনতা, সোনালী কুলকার্নি এবং ডিম্পল কাপাডিয়াকেও সিনেমায় অভিনয়ের জন্য রাজী করিয়ে ফেলেন ফারহান। এবার শুধু এগিয়ে যাবার পালা। ফারহান আখতারের সঙ্গে প্রীতি জিনতার দেখা হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে। প্রীতি মুম্বাই এসেছিল ক্যায়া কেহনা নামের একটি ছবির জন্য স্ক্রিন টেস্ট দিতে। ফারহানকে সে জানায়, ফারহান আখতার যে ছবিই বানাক, সে তাতে কাজ করবে।

তিন বন্ধু- আকাশ, সিড, সমীর

প্রায় দেড় বছর ধরে এই সিনেমার শুটিং হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও সিনেমার অনেক অংশের শুটিং হয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সিনেমার প্রত্যেক অভিনেতা অভিনেত্রীকে রীতিমত খাটিয়ে মারেন ফারহান। বিরক্তির চোটে একটা সময় প্রীতি জিনতা সিনেমার অভিনয় থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করতে চেয়েছিলেন। সাইফ আলি খান অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরে প্রীতিকে ঠান্ডা করেন। সিনেমার শুটিং শেষ হওয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সবাই! সিনেমা রিলিজের পর সেই কষ্টের ফলাফল স্বচক্ষে দেখে দর্শক। হল এক্সপেরিয়েন্স করে এসে প্রত্যেক দর্শক প্রশংসার বাক্যবাণে ভাসিয়ে দিচ্ছিল ফারহান আখতার এবং সিনেমার কলাকুশলীদের।

তবে চলচ্চিত্রটি ভারতের শহুরে মানুষদের জীবন কাহিনী দেখানোর কারণে ভারতের শহরগুলোতে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো, চরিত্রগুলো ছিলো উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের। চলচ্চিত্রটি ধীরে ধীরে কাল্ট মর্যাদা অর্জন করে নেয়। যারা এখনও সিনেমাটি দেখেননি তাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, এমন কী আছে মুভিতে যার জন্য এই সিনেমার প্রশংসা স্তুতিতে ফেটে পড়েছিল সেই সময়ের ভারতের দর্শকেরা? 

সিনেমার প্লট ছিল বন্ধুত্ব নিয়ে। বন্ধুত্বকে এরকম অসাধারণ মুনশিয়ানার সাথে স্ক্রিনে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে খুব কম সিনেমাতেই। ফিল্মটি ছিল এক অর্থে তরুণ বয়সের ছেলে মেয়েদের মনোজগতকে নিয়ে। তারা কীভাবে চিন্তা করে, জীবন থেকে তাদের প্রত্যাশা কেমন, লাইফের জার্নিটা হঠাৎ করে কীভাবে এক লহমায় বদলে যেতে পারে সবকিছুর আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছিল এই সিনেমায়। সিনেমার গল্পটি গড়ে উঠেছে ওই সময়ের ধ্যানধারণাকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠা তিন বন্ধুকে নিয়ে। তিন যুবক, তিন বন্ধু, একে ওপরের হরিহর আত্মা বলা চলে। আকাশ (আমির খান), সামীর (সাইফ আলী খান), সিদ্ধার্থ (অক্ষয় খান্না)। সিদ্ধার্থকে আকাশ এবং সমীর 'সিড' বলে ডাকে। আকাশের এটিচিউড এরকম, সে প্রেম ভালোবাসাতে মোটেও বিশ্বাস করে না। প্রেম ভালোবাসা তার কাছে মেকি অনুভূতি যা শুধুমাত্র সময় নষ্ট করে। সে হচ্ছে দুষ্টুর ক্যাটাগরিতে পড়ে, সারাক্ষণ শুধু বন্ধুদের নিয়ে মজা করার ধান্দায় থাকে এই ক্যাটাগরির পার্সনরা। 

সমীর আকাশের বিপরীত, সে ভালোবাসার সঠিক মানে বুঝে না এবং নিয়মিত প্রেমিকা পরিবর্তন করে। এ হচ্ছে রোমিও ক্যাটাগরির। এদিকে সিদ্ধার্থ একজন নির্জঞ্ঝাট মানুষ, কারোও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। ছবি আঁকার বড্ড শখ তার, বলা যায় সে একজন সৌখিন চিত্রশিল্পী। মোটামুটি এ হচ্ছে ফ্রেন্ড সার্কেলের সেই শিল্পী মনমাসিকতার পার্সন যে আর্টিস্ট ক্যাটাগরিতে পড়ে। 

ভারতে ফ্রেন্ড সার্কেলেরা ট্রিপে গেলে প্রথম পছন্দ হিসেবে গোয়াকেই বেছে নেয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় না, তিন বন্ধু যায় গোয়াতে বিন্দাস ঘুরতে। আকাশ আর সিড ঘুরে চলে আসলেও সমীর আসে না। এই রোমিওর মনে তখন ক্রমাগত লাড্ডু ফুটে চলেছে! এক বিদেশিনীর প্রেমে পড়ে গেছে সে! ওদিকে সিডের প্রতিবেশী হিসেবে থাকতে আসে তারা (ডিম্পল কাপাডিয়া), যে একজন ডিভোর্সি নারী। কথায় কথা বাড়ে, সিড তার ছবি আঁকে। আঁকিবুঁকি করতে করতে কখন যে সে তারার প্রেমে পড়ে যায় টেরই পায় না! একদা আকাশ দুষ্টামি করে শালিনী নামের এক মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু শালিনীর সঙ্গে যার বাগদান হয়েছে যার নাম রোহিত সে আকাশকে একটা ঘুষি মারে। তারপর... না থাক! এই বন্ধুত্বের গল্পটা এতোটা মাইন্ডব্লোয়িং, গল্প বলে দিলে যারা এখনও সিনেমাটা দেখেনি স্পয়লার হয়ে যেতে পারে তাদের কাছে। কাহিনী কিছুটা সাদামাটা হলেও এর নির্মাণশৈলী আপনাকে চোখ ফেরাতে দেবে না।

এই সিনেমাটায় মারমার কাটকাট কোনো অ্যাকশন নেই। এক প্রজন্মের তিন তরুণের জীবনযুদ্ধের কাহিনী, তাদের সংগ্রাম ও প্রেমের মিশেলে ছবিটি যে কী পরিমাণ দর্শক-প্রিয়তা পেয়েছিল তা বোঝা যায়, এখনো যখন এ ছবিটি এই ১৭ বছর পরও দর্শক নস্টালজিয়া নিয়ে বারবার দেখে। চোখ জুড়ানো সিনেমাটোগ্রাফির পাশাপাশি এই সিনেমায় মনোমুগ্ধকর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, মুভির বিভিন্ন মুহূর্তকে উপজীব্য করে তৈরী গানগুলো এখনও অনেকের প্লে লিস্টে থাকে। বিশেষ করে, আমির আর প্রীতির চমৎকার কেমিস্ট্রিসম্পন্ন "জানে কিউ" গানটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে সবার কাছে। 

জানে কিঁউ গানের একটি দৃশ্যে আমির খান ও প্রীতি জিনতা

ছবির টাইটেল সং লেখা হয় চারদিনে। ফারহান আখতার, জাভেদ আখতার ও শঙ্কর-এহসান-লয় এ গানের জন্য লোনাভালা ভ্রমণ করেন একসঙ্গে। ওখানেই গান রচিত হয়, সুর হয় চারদিনেই। কেউ যদি প্রশ্ন করেন সিনেমাটা কেন দেখা উচিত, সেই প্রশ্নের উত্তরে ৫ টি কারণ বলবো আমি। 

  • ১/ এই ছবিটি বন্ধুত্ব এবং প্রেম-ভালোবাসা দুই প্রকার অনুভূতির সাথে জমকালো ভাবে পরিচয় করিয়ে দেবে আপনাকে। সিনেমাটি দেখে আপনি যেমন বন্ধুত্বের মানে বুঝতে পারবেন, একই সাথে প্রেম-ভালোবাসার প্রতি নাক সিটকানো ভাব থাকলে সেটাও ঝেড়ে ফেলতে বাধ্য হবেন। 
  • ২/ এই ছবির ডায়ালগগুলো বেশ চমৎকৃত করবে আপনাকে। যেমন- - "আমাদের দেহ অত্যন্ত প্রজ্ঞার সাথে বানানো হয়েছে। আমরা নিজেদের পেছনে লাথি মারতে পারি না। তাই ঈশ্বর আমাদের জন্য বন্ধু বানিয়েছেন।" - "চোখ যায় তার দেখা পেতে, মন চায় তাকে ভালোবাসতে। কিন্তু মগজ তখন বলে দেয়, তার দেখা পেতে হলে এবং ভালোবাসা পেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।" - "আজ নয়তো কাল, আমরা তিনজন আমাদের মঞ্জিল খুঁজে বের করবো। হতে পারে, আমাদের সেই মঞ্জিল হবে আলাদা আলাদা" 
  • ৩/ মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে রিয়েলিস্টিক ভাবে দেখানো হয়েছে, সিক্স প্যাক দেখিয়ে মেয়েদের মনোরঞ্জন দেখানো হয়নি। 
  • ৪/ মানব মনের বেশ কিছু সংবেদনশীল ব্যাপার, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দেখানো হয়েছে মুভিতে। 
  • ৫/ ছবির কমেডি চিত্রনাট্য, কিছু স্ল্যাং টাইপের শব্দ, ডেটিং করার স্মার্ট পদ্ধতি সব কিছুই মনে রাখার মতো।

আইএমডিবিতে ৮.২ এবং রোটেন টমেটোজে ৯৫% ফ্রেশ রেটিং পাওয়া ১৮৫ মিনিট ব্যাপ্তিকালের এই ফিল্মটি ২০০১ সালে সেরা হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা