সিড বা আকাশের স্ট্রং ইমেজের সামনে সমীরকে হয়তো সেভাবে নজরে পড়বে না। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, এই লোক প্রতিটা সময়ে, প্রতিটা দরকারে শুধু সমীরই বন্ধুদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শালিনীর বিয়ের অনুষ্ঠানে সে আকাশের সঙ্গে গেছে, আবার সিদ্ধার্থের ডাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালেও সে হাজির হয়েছে...

'হেমলক সোসাইটি' দেখেছেন? ওই সিনেমায় পরমব্রতের একটা ডায়লগ আছে, 'আমি হচ্ছি অনেকটা...দিল চাহতা হ্যায় সিনেমার সাইফ আলী খানের মতো, ভালোবাসতে ভালোবাসি।' ছোট্ট দুটো শব্দ, তবে গভীর তার মহিমা। একটা চরিত্রকে বিশ্লেষণ করার মতো যথেষ্ট হয়তো নয়, কিন্ত এই দুই শব্দেই 'সমীর' নামের চরিত্রটা সম্পর্কে যেন অনেক কিছুই বলে দেয়া হয়েছে। আসলেই তো, 'দিল চাহতা হ্যায়' এর সমীর ভালোবাসতেই ভালোবাসে, ভালোবাসা ব্যাপারটা তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসাই হোক, অথবা হোক বন্ধুর প্রতি। 

বেশ অনেকদিন আগে ভারতীয় অভিনেতা এবং স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান বীর দাসের একটা শো দেখছিলাম, বীর দাসকে যারা চেনেন না, তারা গুগল করে নিতে পারেন। সেই শো-তে দিল চাহতা হ্যায় সিনেমাটা নিয়ে কথা বলছিলেন বীর, কিভাবে নতুন শতকের একদম গোড়ার দিকটায় ফারহান আখতার তার পরিচালিত প্রথম সিনেমাটার মাধ্যমে পুরো ভারতের তরুণদের মধ্যে একটা অবস্থান তৈরী করে নিয়েছিলেন, নাইন্টিজ কিডদের কত নস্টালজিয়া জড়িয়ে আছে সিনেমাটার সঙ্গে- সেসব বলছিলেন বীর। 

সিনেমার গল্প বলতে গিয়ে চরিত্রগুলোর পরিচয় দিলেন বীর- 'তিন বন্ধু, একজন বাবার ব্যবসা দেখতে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে, একজন বয়স্ক এক নারীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, হারাধনের তিন ছেলের মধ্যে বাকী আছে একজন- সমীর।' খুবই দুর্ভাগ্যজনক একটা ইন্ট্রো, কিন্ত মিথ্যে তো নয়! কল্পনা করে দেখুন, সিদ্ধার্থের আকাশকে চড় মারার পরে দুজন দুই মেরুতে হারিয়ে গেল, বাকি থাকলো বেচার সমীর, যার কোন ভুল ছিল না, কোন দোষ ছিল না, তবুও তাকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, বান্ধবহীন অবস্থায় একাকী সময় কাটাতে হয়েছে। 

তিনজনের বন্ধুত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আকাশের ভূমিকা

আকাশ আর সিদ্ধার্থ- দুজন সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের মানুষ। এদের মধ্যে বন্ধুত্ব হবার কথাই ছিল না, তিনজনের এই ট্রায়োটা গড়ে ওঠার মূল কৃতিত্ব আমি সমীরকে দিই। সমীর হচ্ছে আলুর মতো, আলু যেমন মাছ-মাংস-সবজি সবকিছুর সঙ্গেই খাওয়া যায়, সমীরও তেমনই আকাশ আর সিদ্ধার্থ, এই দুই বিপরীতমুখী চরিত্রের সঙ্গেই মিশতে পারতো অবলীলায়। হি ওয়াজ দ্য ব্রিজ অফ দ্যাট ফ্রেন্ডশিপ, এবং এই লোক প্রতিটা সময়ে, প্রতিটা দরকারে বন্ধুদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শালিনীর বিয়ের অনুষ্ঠানে সে আকাশের সঙ্গে গেছে, আবার সিদ্ধার্থের ডাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালেও সে হাজির হয়েছে। 

একপাশে আমির খান, অন্যপাশে অক্ষয় খান্না; দুজনের চরিত্র দুটোও যথেষ্ট কন্ট্রাস্টিং পার্সোনালিটিওয়ালা, এদের মাঝে সাইফ আলী খানকে কখনও কমেডিয়ান মনে হতে পারে, কখনও মনে হবে বয়সের তুলনায় ইম্যাচিওর এক তরুণ, যার জীবনের একমাত্র কাজ বাকী দুই বন্ধুর কাছে ইনসাল্ট হওয়া আর প্রেমিকার গালি খাওয়া। কিন্ত সমীরের ক্যারেক্টারটার ডেপথ আরও অনেক বেশি, আমার ধারণা সিড এবং আকাশের চেয়েও বেশি। 

সমীরের রিলেশনশীপ, প্রেমিকা, তার ব্যবহার- এসব নিয়ে আকাশ সবসময় মজা করেছে, সমীর সেসব গায়ে মাখেনি কখনও। কিন্ত একই কাজটা আকাশ যখন সিডের সাথে করতে গেছে, গালে এসে পড়েছে দশাসই এক থাপ্পড়। সঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছে, বন্ধুত্বে একটা সীমারেখা থাকে, যেটা পার করা উচিত নয়। গোটা ঘটনাটায় সমীরের কোন দোষ ছিল না, তবুও সে ভুক্তভোগী হয়েছে বাকী দুজনের কারণে, এবং সেটা নিয়ে তার আফসোসও ছিল না। সে বরং প্রাণপণে চেষ্টা করেছে দুজনের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার, তার বিনিময়ে জুটেছে বাজে ব্যবহার, বন্ধুরা সরে গেছে আরও দূরে। 

সম্পর্ক নষ্ট হওয়া বা মানুষের হারিয়ে যাওয়াটাকে ভয় পেতো সমীর

সমীর যে ব্যাপারটাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতো, সেটা হচ্ছে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে মানুষের হারিয়ে যাওয়া। এজন্যেই প্রিয়ার সাথে টক্সিক রিলেশনশিপ থেকে বের হবার সাহস তার হয়নি, কারণ সে চায়নি প্রিয়াকে হারাতে। হয়তো সে খুশী ছিল না সেই সম্পর্কটায়, কিন্ত সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কষ্টটাও সে নিতে রাজী ছিল না। সমীর নিজে কষ্ট পেতে চায়নি, কারো কষ্টের কারণও হতে চায়নি। সম্পর্ক হারাতে না চাওয়ার ব্যাপারটা পূজার বেলাতেও দেখা গেছে, সমীর পূজাকে ভালোবেসে ফেললেও, তাকে বলতে ভয় পাচ্ছিল। কারণ তাতে করে যদি পূজার সঙ্গে থাকা বন্ধুত্বটাও নষ্ট হয়ে যায়- তাছাড়া তার কাছের বন্ধুরাও কেউ তখন তার পাশে ছিল না, এজন্যেও তার মধ্যে একটা ইনসিকিওরিটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। 

সমীরের যে রুমটা, সেটা বেশ অদ্ভুত। এই বয়সের একটা ছেলের রুম সাজানো-গোছানো থাকার কথা নয়, আকাশ বা সিড, দুজনের তুলনায় সমীরের রুমটা ছিল যথেষ্ট গোছানো। তার রুমে বন্ধুদের ছবির পাশাপাশি মিউজিক সিস্টেম যেমন আছে, তেমনই আছে বইও। এবং সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, সমীরের রুমে ছোট্ট একটা টেলিস্কোপও আছে। ফারহান আখতার নিশ্চয়ই মনের ভুলে টেলিস্কোপটাকে সিনেমায় ফুটেজ দেননি। এই জিনিসগুলোই সমীরের মিক্সড পার্সোনালিটির প্রমাণ দেয়, যে মানুষটা দিনভর বন্ধুদের হাসিঠাট্টার পাত্র হয়, সেটাকে আবার উপভোগও করে, প্রেমিকার হাতে চড় খায়, রাতে মাই টাইমে সেই হয়তো গান শুনতে শুনতে বই পড়ে, কিংবা ঘর অন্ধকার করে শুক্লপক্ষের রাতে তারা দেখে, বন্ধুদের সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হয়- অদ্ভুত না? 

সিড বা আকাশের স্ট্রং ইমেজের সামনে সমীরকে হয়তো সেভাবে নজরে পড়বে না। কারণ সিনেমায় আমরা আকাশ আর সিডের দ্বন্দ্বটাই দেখতে পাই বেশিরভাগ সময় জুড়ে। কিন্ত মাঝখান থেকে একজন যে সর্বক্ষণ পুরো ব্যাপারটাকে জোড়াতালি দেয়ার চেষ্টা করছিল, ঝগড়ার পরদিন আকাশের বাসায় গিয়ে তাকে সিডের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকে শুরু করে শেষদিকে আকাশ আসবে না জেনেও তাকে হাসপাতালে আসার জন্য রিকোয়েস্ট করা- সেগুলো আমরা দেখেও এভয়েড করে যাই। এই লোক হাসিমুখে অপমান মেনে নেয়, তার মধ্যে ইগো বলে কোন বস্তু নেই, যেটা বাকী দুজনের মধ্যেই ছিল। সমীরের চরিত্রটা ঠিক এখানে এসেই আকাশ এবং সিডকে ছাপিয়ে যায়- এবং এই সত্যিটাকে অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই...

ফুটনোট- সিনেমায় সমীরের পুরো নাম যে সমীর মুলচান্দানি- এটা ক'জনে জানতেন? আমি আজই জানলাম। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা