দেড় শতাধিক ইভটিজারকে ধরিয়ে দেয়া এক সুপারহিরো!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ঘটনাটা চার-পাঁচ বছর আগের, লেখাটাও তিন বছর আগে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তবু মন ভালো করে দেয়া এই গল্পগুলো বারবার বলতে ইচ্ছে হয় আপনাদের...
রাস্তাঘাটে নারীদের ওপর নিপীড়ন ও হয়রানি বর্তমানে যেন একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সকালবেলা খবরের কাগজ খুলে আমরা এক বা একাধিক নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ এমনকি খুনের সংবাদ পর্যন্ত পাই। কিছুদিন পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই ইস্যুতে সরব হয়, হ্যাশট্যাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইভেন্ট পর্যন্ত খোলা হয়। কিন্তু কিছুদিন বাদেই আন্দোলন থিতিয়ে পড়ে। অথচ প্রকৃতপক্ষে কোন সুফলই মেলে না। কিন্তু আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব এমন একজন ব্যক্তিকে, যার কারণে মাত্র ছয় মাসেই মুম্বাই পুলিশ ১৪০ জন যৌন নিপীড়ক ও হয়রানিকারীকে জেলবন্দি করতে সক্ষম হয়েছে।
যার কথা বলছি, তার নাম দীপেশ। জন্ম মুম্বাইয়ের এক বস্তিতে। ছোটবেলা থেকেই সে দেখে এসেছে তার মাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে। যেহেতু তার বাবা ছিলেন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী, তাই তার মাকেই পুরো সংসার একা চালাতে হতো। তার মা একটি ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা চালাতেন, এবং দৈনিক ১২ ঘন্টারও ওপরে কাজ করতেন। রাতে ফিরতে তার প্রায়ই অনেক দেরি হয়ে যেত। এজন্য বস্তির অন্যান্য অধিবাসীরা তাকে নিয়ে বিভিন্ন কুৎসা রটাত, দীপেশের সামনেই তার মায়ের নামে অশ্লীল গালমন্দ করত। কিন্তু এসব শুনেও দীপেশের মনে তার মা সম্পর্কে কখনোই অশ্রদ্ধা জন্মায়নি। কেননা সে খুব কাছ থেকেই তার মায়ের জীবনসংগ্রাম দেখেছে।
তবে তার মায়ের একার পক্ষে পুরো সংসারের ঘানি টানা ক্রমশই মুশকিল হয়ে পড়ছিল। তাই মাত্র ১৬ বছর বয়সেই দীপেশ পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে একটি অফিসে চাকরি নিয়ে নেয়। নিজের কাজের প্রতি দীপেশ ছিল খুবই সচেষ্ট। প্রতিদিন সবার আগে অফিসে উপস্থিত হতো সে। আর অফিস ছাড়ত সবার শেষ। অন্যান্য অধিকাংশ মুম্বাইবাসীর মতই সে যাতায়াতের জন্য মুম্বাইয়ের লোকাল ট্রেন ব্যবহার করত। এবং একদিন ট্রেন স্টেশনেই সে এমন এক ঘটনার সাক্ষী হয়, যা পরবর্তিতে বদলে দেয় তার গোটা জীবন।
একদিন ট্রেন ধরতে স্টেশনে গিয়ে সে দেখতে পায়, লেডিস কম্পার্টমেন্টের সামনে কয়েকজন নারীকে এক দল মানুষরূপী নরপিশাচ খুবই বাজেভাবে উত্যক্ত করছে। দীপেশ বুঝতে পারে তার একার পক্ষে এদের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই সে ছুটে যায় স্টেশনে কর্মরত পুলিশদের কাছে। অভিযোগ জানায় ওই উত্যক্তকারীদের নামে। কিন্তু প্রথমে পুলিশরা তার অভিযোগ আমলেই নেয় না। বারবার তাকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দীপেশ বারবার তাদের কাছে অনুনয় বিনয় করতে থাকলে অবশেষে একজন পুলিশ তার সাথে ঘটনাস্থলে যেতে রাজি হয়। কিন্তু ততক্ষণে অপরাধীরা কেটে পড়েছে।
সেদিনের সেই ঘটনা গভীর দাগ কাটে দীপেশের মনে। সে বুঝতে পারে, কেন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছুতেই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করতে পারছে না। কেননা তারা যে এ বিষয়টিকে খুব একটা আমলেই নেয় না। এই ঘটনা দীপেশ কিছুতেই ভুলতে পারে না। বরং সে তার মায়ের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে। কেননা তিনিও তো রোজ রাত করে বাড়ি ফেরেন। পথিমধ্যে তার সাথেও যদি বাজে কিছু হয়ে যায়! দীপেশ তখন তার বন্ধুদের নিয়ে এক অভিনব কাজ শুরু করে। তারা কয়েকদিন মুম্বাইয়ের বেশ কিছু বাস ও রেল স্টেশন ঘুরে বুঝতে পারে, এই জায়গাগুলোই মূলত অপরাধীদের প্রধান আখড়া। অন্তত ৮৫% নারী প্রতিদিন এসব জায়গাতেই হয়রানির শিকার হয়।
তখন তারা চিন্তা করে, এমন তো বেশিদিন হতে দেয়া যায় না। কিছু একটা করতেই হবে, যাতে অবস্থা পরিবর্তিত হয়। দীপেশ তখন এমন একটি সানগ্লাস কেনে, যার ভিতরে ছিল এইচডি ক্যামেরা বসানো। এই সানগ্লাসটি পরে সে প্রতিদিন ট্রেন স্টেশনের লেডিস কম্পার্টমেন্টগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করে, এবং তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে সবকিছুকে তার ক্যামেরায় রেকর্ড করে রাখতে থাকে। বেশ কয়েকদিন এমন করার পর সে ধরে ফেলে যে কোন চক্রটি নিয়মিত নারীদের হেনস্তা করে আসছে। এবং এবার তার কাছে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণও রয়েছে। সেগুলো নিয়ে সে যায় পুলিশের কাছে।
সবকিছু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পুলিশও ঘটনার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে। এবার তারাও ৪০ সদস্যের একটি দল গঠন করে, যারা দীপেশ ও তার বন্ধুদের সাথে একই কাজ করা শুরু করে। এভাবে মাত্র তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই এই দলটি দেড় শতাধিক অপরাধীকে হাতেনাতে ধরে জেলে পুরতে সক্ষম হয়েছে। এবং দীপেশের এই অভিনব কৌশলের বদৌলতে সাম্প্রতিক সময়ে মুম্বাইয়ের রাস্তাঘাটে নারীদের ওপর হয়রানি ও নিপীড়নের হার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু তারপরও দীপেশ মনে করে, তার কাজ এখনও শেষ হয়নি। সে চায় গোটা সমাজ থেকেই নারী নির্যাতনের মত একটি ন্যাক্কারজনক শব্দকে মুছে ফেলতে। তাই এখন সে সেইসব নারীদের জন্যেও কাজ শুরু করেছে, যারা বাড়িতে তাদের স্বামী, গৃহকর্তা বা অন্যান্য পুরুষদের নিকট নিগ্রহের শিকার হয়।
দীপেশ জানেন, অল্প কিছু বিকৃত মানসিকতার পুরুষের জন্যই সমাজের সকল পুরুষের বদনাম হয়। কিন্তু তারপরও ওই গুটিকতক পুরুষের জন্য সে পুরুষ হিসেবে নিজেকেও দায়ী মনে করে। কেননা সমাজ থেকে এই সমস্যাটি নির্মূল করতে চাইলে শুধু নিজে ভালো থাকলেই চলবে না, যারা এসব কাজ করে তাদের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। আর যতদিন না সেটি সম্ভব হচ্ছে, দীপেশের সংগ্রামও অব্যহত থাকবে...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন