আজ থেকে প্রায় এক মাস আগে রাজধানীর পল্টন থানায় একটি জিডি ফাইল হয়েছিলো। সুমন নামের ২৮ বছরের তরতাজা এক যুবক মোটর সাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি।

উদ্বিগ্ন পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনেরা সম্ভাব্য সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকেন, কিন্তু সুমনেরও দেখা নাই, বাইকেরও খোঁজ নাই। উপায়ান্তর না পেয়ে নিখোঁজের ১৩ তম দিনে পুলিশের শরণাপন্ন হন সুমনের পরিবার।

নিখোঁজ জিডিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আমলে নেন পল্টন থানা পুলিশ। সন্দেহভাজনদের একে একে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয় সম্ভাব্য ঘটনা কী হতে পারে তার উপর। কিন্তু সরল অংকের উত্তরের ধারেকাছেও যেতে পারছে না পুলিশ।

সোনার খনিতে আস্ত সোনার খন্ড পাওয়া যায় না। টনকে টন মাটি সরিয়ে সোনার বিন্দু বিন্দু আকর সংগ্রহ করা হয়। যে কোনো অপরাধ তদন্তের ধরণও মাটি সরিয়ে সোনার আকর সংগ্রহের মতোই জটিল ও সময়সাপেক্ষ। গন্ডায় গন্ডায় সন্দেহভাজনদের মধ্যে থেকে যাচাই বাছাই করে সর্বোচ্চ সংখ্যককে বাদ দেওয়া হয়। এই ঘটনায় পুলিশ সেটাই করলেন। সবাইকে বাদ দিয়ে রাখলেন মাত্র দুজন সন্ধিগ্ধকে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, আপনার ক্ষতি করার জন্য খুব অল্পক্ষেত্রেই দূরের মানুষ আসবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচিত ও কাছের লোকজনই আপনার ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। মিলিয়ে নিন ব্যক্তিজীবনের সাথে। এই অপ্তবাক্যটি মাথায় রেখে পুলিশের তদন্তকারী দল নিখোঁজ সুমনের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সন্দেহের তালিকায় রাখেন। 

সন্ধিগ্ধ দুজনও ভিকটিমের বন্ধুবান্ধব। শাহিন ও আসলাম। পুলিশের টার্গেট ফিক্সড। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে পড়ে।

কিন্তু সমস্যা হলো এই দুজনের ট্রেস পাওয়া যাচ্ছিলো না। শাহিন ও আসলামকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও থানায় আনতে পারছিলেন না পুলিশ।

তদন্ত দল বুঝে ফেললেন এখানে গরমে কাজ হবে না। সামান্য এদিক ওদিক হলেই গা ঢাকা দিয়ে বসতে পারেন সন্দেহভাজন। পুলিশ এত দিনের পরিশ্রম ভেস্তে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। ভিন্ন পথে এগুতে হলো।

মাছ ধরার জন্য পানিতে বরশী ফেলতে হয়, বাঘ ধরার জন্য টোপ দিতে হয়, আপনারা ভাবতে থাকুন দুজন যুবককে ধরার জন্য কী টোপ দিতে হতে পারে পুলিশকে। এই সুযোগে ঘটনার বাকিটা বলতে থাকি। 

দুদিন আগের ঘটনা। পুলিশের টোপে আটকা পড়েন সন্দেহভাজন টার্গেট। আগেই বলেছিলাম এরা দুজন নিখোঁজ সুমনের পরিচিত বন্ধুবান্ধব। পুলিশ বলছে শাহিনের সাথে ভিকটিমের পরিচয় চুরি মামলায় জেল খাটতে গিয়ে। জেল থেকে বাইরে এসেও বন্ধুত্ব বজায় ছিলো! 

টনকে টন মাটি সরিয়ে স্বর্নের যে আকর পাওয়া যায়, সেগুলো যন্ত্রের সাহায্যে গলিয়ে দলা বানানো হয়। বহু সংখ্যক সন্দেহভাজনদের মধ্যে থেকে পুলিশ শেষমেশ যে দুজনকে আটক করতে পারলেন তাদেরও 'স্বর্নের মতো' পুলিশী জেরার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেই বের হয়ে আসে ঘটনার আসল রহস্য! 

সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদে সব তথ্য বের হয়ে আসে

জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান কবুতর ব্যবসার জের ধরে ১৪ হাজার টাকাকে কেন্দ্র করে সুমনের সাথে শাহিনের অন্তঃকোন্দল চলে আসছিলো।

ঘটনার দিন শাহিন ফোন করে সুমনকে হাসের মাংস খাওয়ার দাওয়াত দেন। বন্ধুর নিমন্ত্রণে সরল বিশ্বাসে সুমন ছুটে যান শহিনের বাসা নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও। কিন্তু এই খাওয়া তার শেষ খাওয়া হবে সুমন কি কোনদিন জানতে পেরেছিলেন?

ভাত, হাসের মাংস খেয়ে রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনজন সাদিপুর ইউনিয়নের বারগাও মৌজার নয়াগাঁও নামক একটা নির্জন বিলের মধ্যে গেলেন হাওয়া খেতে। কথাটা একটু ভুল বললাম না? সুমন গেলেন হাওয়া খেতে আর বাকি দুজন শাহিন ও আসলাম গেলেন বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বন্ধুর রক্ত পান করতে!

যেদিন সুমন নিখোঁজ হন, ঘটনা সেদিনেরই। পরিকল্পনামাফিক আসলাম ও শাহিন মিলে সুমনকে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। সুমন অতর্কিত মাথায় আঘাত পেয়ে আন্দাজ করলেন কী হতে যাচ্ছে, কিন্তু নির্জন বিলের মধ্যে শত চিৎকার করলেও কেউ আপনার ডাক শুনে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করার আগে আবার মাথায় হাতুড়ির বাড়ি! এবার সহ্য করতে পারেননি সুমন। এরপর সুমনের গলা টিপে ধরে ওরা। শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে সুমন তার বন্ধুর ক্রুর হাসি দেখে নিলেন একপলক। 

পরিচিত জনকে হত্যা করা সহজ হলেও হত্যার ভার বয়ে বেড়ানো কঠিন। তাছাড়া, যে মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও জীবিতদের অংশ ছিলেন, হত্যার পরে সে একটা জীবন্ত লাশে পরিনত হন। এই লাশ গোপন করা হত্যার চেয়েও বেশি কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজকে সহজ করার জন্য লাশ নিয়ে পাশের একটি গভীর ডোবার মধ্যে কচুরিপানার নিচে লাশ লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যান খুনের দায়ে অভিযুক্তরা।

মনে আছে সুমন একটি মোটরসাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন? সুমনকে হত্যা করার পরে বদলে যায় মোটরসাইকেলের মালিকানাও। এটি লুকিয়ে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় গোপালগঞ্জে আসলামের বোনের বাড়িতে। 

কী ভাবছেন? এমনও বন্ধুত্ব হয়? আপনি জেলের মধ্যে একজন অপরাধীর সাথে বন্ধুত্ব করবেন, আর ভালো ফলাফল আশা করবেন সেটা সবসময় নাও হতে পারে। সবার কাছে বন্ধুত্বের দাবী সমান নয়।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহিদুল ইসলাম সোহাগ পিপিএম-সেবা। লাশ উদ্ধারে নিজে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের এই তরুণ কর্মকর্তা। সাথে ছিলেন পল্টন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ সেন্টু মিয়া এবং উক্ত জিডির আইও এসআই মোঃ কামাল হোসেন ও পুলিশের কয়েকজন কনস্টবল। 

সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহিদুল ইসলাম সোহাগ পিপিএম-সেবা জানান, মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হাসান জামিল বিপিএম-সেবা মহোদয়ের অনুমতি সাপেক্ষে আসামীদের দেখানো পথে গভীর রাতেই পুলিশের গাড়ি ছুটতে থাকে নারায়ণগঞ্জের দিকে।

এক পর্যায়ে থেমে যায় পুলিশের গাড়ি। গাড়ি থেকে বিলের পথ ধরেন পুলিশের দলটি। সাথে সেই দুজন। মাত্র একমাস আগে ঠিক এখানেই বন্ধুর রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত হয়েছিলো। 

কথায় বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! ফোর্সের সহায়তায় আসামিদের বর্ণনা মোতাবেক নিহত সুমনের প্রায় গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সকলের নিরলস প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ একটি মিসিং জিডি থেকে হত্যার রহস্য উৎঘাটন সম্ভব হয়, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। এই ঘটনায় হত্যা মামলা রুজু হয়েছে এবং আসামীদের আদালতে প্রেরণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

প্রত্যেক ঘটনা একটা শিক্ষা রেখে যায়। এই ঘটনার শিক্ষা কী? কথায় বলে বিপদে বন্ধুর পরিচয়, কিন্তু যারা বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে হত্যার মতো মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে, তাদের কি আদৌ বন্ধু বলা যায়? আশা করবো আদালতে অভিযোগ প্রমানিত হোক ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক বন্ধু নামের নরপশুদের। 

দুই বন্ধু ও ভাল্লুকের গল্পের কথা মনে আছে? ভাল্লুক চলে গেলে গাছ থেকে আরেক বন্ধু নেমে এসে জানতে চাইলো, "ভাল্লুকটি তোমার কানে কানে কী বলে গেছে?"

বন্ধু বললো, "ভাল্লুক বলে গেছে- যে বন্ধু আরেক বন্ধুর বিপদে পালিয়ে যায়, তার সাথে বন্ধুত্ব রেখো না।"

তথ্যসূত্র: ডিএমপি


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা