ভদ্রলোকের নাম শাহ আলম, তিনি থাকতেন সৌদি আরবে। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের জীবন কাটিয়েছেন সৌদি ভূমিতে৷ সৌদির মদিনা হাসপাতালে শিশু বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ডাক্তার শাহ আলম। চট্টগ্রামের মানুষ ছিলেন তিনি, ডাক্তারি পাশ করেছিলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে। তারপর সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন। সেখানে মদিনা শহরের মদিনা হাসপাতালে সেবা দিয়েছেন বছরের পর বছর। যদিও মনের জমিনে সবসময়ই থাকত বাংলাদেশ, নিজের জন্মভূমি। তাই, ঠিক করলেন ফিরে আসবেন দেশে। এবার দেশের মানুষকে সেবা দিবেন।

ডাক্তাররা নাকি গ্রামে ফেরে না, ডাক্তাররা নাকি খুব লোভী কিন্তু ডাক্তার শাহ আলম তো ফিরেছিলেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ফিরে মানুষকে সেবা দিয়ে গরীবের ডাক্তার বলে সুনাম কুড়িয়েছেন, যদিও টিকতে পারেন নি খুব বেশি দিন। গরীবের এই ডাক্তার শাহ আলমকে খুন হতে হয়েছে, যদিও তার জন্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় তেমন কেউ বাক্য খরচ করেন নি।

ডাক্তার শাহ আলম সৌদি আরবের নিশ্চিন্তের জীবন, স্বচ্ছল, নিরাপদ জীবনকে পেছনে ফেলে দেশে ফিরেছেন কেবল দেশের মানুষকে নিজের অর্জিত বিদ্যা আর অভিজ্ঞতায় সেবা দেবেন বলে। তিনি অনেক উদ্যম নিয়ে কাজও শুরু করেছিলেন। চট্টগ্রামের ছোট কুমিরায় বেবি কেয়ার নামে ক্লিনিক করেছিলেন। গরীব অসহায় শিশুদের তিনি একদম নামমাত্র কিংবা অনেক সময় বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতেন। কারো ঔষধ কেনার টাকা না থাকলে ডাক্তার শাহ আলম ঔষধ কেনার টাকা দিয়ে দিতেন। এজন্যে তাকে এলাকাবাসী গরীবের ডাক্তার বলে ডাকত।

সম্প্রতি ডাক্তার ভাই এড্রিন বেকারের গল্পটি ইত্যাদির বদৌলতে তুমুল আলোচিত হয়েছে। যিনি ৩২ বছর টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় কাইলাকুড়ি গ্রামে দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা দিয়ে 'ডাক্তার ভাই' নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি চেয়েছিলেন কেউ এসে যেন গ্রামে তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের হাল ধরে। এই হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে পরবর্তীতে আমেরিকা থেকে এসেছেন জেসিন ও মেরিন্ডি দম্পতি। ডাক্তার ভাই যা করেছেন, এরকম মহানুভবতাকে সম্মান জানানোর কোনো ভাষা হয় না। তাকে স্যালুট!

কিন্তু, এই ঘটনা নিয়ে একটা বয়ান খুব চর্চার চেষ্টা হয়েছে যে - বাংলাদেশের ডাক্তারদের লজ্জিত হওয়া উচিত, বাংলাদেশের ডাক্তাররা কেউ গ্রামে ফেরে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনিতেই ডাক্তারদের আদর করে 'কসাই' ডাকার চল আছে, তার উপর ডাক্তার ভাইয়ের মহানুভবতার গল্পকে ব্যবহার করে দেশি ডাক্তারদের ছোট করার চেষ্টাটা দুঃখজনক। বাংলাদেশের ডাক্তারদের অনেক দোষ আছে, ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে নন কেউ। কিন্তু ডাক্তারদের মানবিক বোধ বিবেচনা একেবারেই নেই এই কথা যদি কেউ দাবি করেন, এর চেয়ে লজ্জা আর কি আছে? কোনো ডাক্তার গ্রামে যেতে চান না, প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালে তাহলে কারা চিকিৎসা দিচ্ছেন?

আচ্ছা, ডাক্তার শাহ আলম তো ফিরেছিলেন। শহর বন্দর বাদ দিয়ে নিজের মফস্বল এলাকায় চিকিৎসা সেবা দিয়ে তিনি গরীবের ডাক্তার বলে পরিচিতি পেয়েছেন।

ডাক্তার শাহ আলম হয়ত দারুণ এক উদাহরণ হতে পারতেন, লোকে বলতে পারত, এই না হলে ডাক্তার, আয়েশি জীবন ছেড়ে নিজের এলাকায় ফিরে দরিদ্র শিশুদের চিকিৎসা দিয়ে বেড়াচ্ছে! কিন্তু তার কথা কজন জানতেন? এমনকি খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন তিনি খুন হলেন তার জন্যেও শোকগাঁথায় দুই একটা বাক্য কজন খরচ করেছি আমরা?

এইতো গত অক্টোবর মাস। ১৭ তারিখ। সেদিনও তিনি সারাদিন মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। কিন্তু শেষটা সুন্দর হলো না। সারাদিনের কাজকর্ম শেষ করে নিজের চেম্বার ছেড়ে বাড়ি ফেরার জন্যে লেগুনায় উঠেছিলেন। পথে তাকে খুন করা হয়। লেগুনার চালক সহ যাত্রীর ছদ্মবেশে থাকা ছিনতাইকারীরা গরীবের ডাক্তারকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে প্রাণ কেড়ে নেয়৷ কি অবলীলায় একজন স্বপ্নবিলাসী মহানুভব ডাক্তার শাহ আলম অপঘাতে মৃত্যুবরণ করলেন কিছু লোভী মানুষের হাতে! কিন্তু লোকে কি শান্তভাবে রায় দিয়ে দেয়, ডাক্তাররাই লোভী...

ডাক্তার শাহ আলমের মধ্যে লোভ থাকলে, আরো টাকা কামানোর ইচ্ছা থাকলে শাহ আলম হয়ত কখনো নাও ফিরতে পারতেন সৌদি আরব থেকে। কিংবা ফিরলেও ডাক্তার শাহ আলম পারতেন চট্টগ্রাম শহরেই জমজমাট করে একটা ক্লিনিক দিতে৷ চেম্বার করতে পারতেন বিরাট করে। কিন্তু, তিনি সত্যিই মানুষকে সেবা দেয়ার কথা ভেবেই একদম নিজের শেকড়ের কাছে ফিরেছেন, নিজ এলাকার মানুষকে সাহায্য সেবা করতে শুরু করেছিলেন।

তাই কেউ ফিরে আসে না, কেউ গ্রামে যেতে চায় না, কেউ মানুষের কথা ভাবে না, সবাই টাকার কথা ভাবে - এরকম সরলীকরণ আমরা না করি। আমরা যখন এসব বলে ফেলছি ঢালাওভাবে, তখন কেউ কেউ হয়ত ডাক্তার শাহ আলমের মতো গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে, কেউ কেউ হয়ত নিভৃতে কাজও করে যাচ্ছে। আমরা তার কতটুকুই বা আর জানি...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা