ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়রদের মৃত্যু ও আমাদের অপূরণীয় শূন্যতা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নিজের হাতে গড়া ডাক্তার ছাত্রের হাত ধরে ডাঃ এহসানুল করিম আকুতি জানিয়েছিলেন, "প্লিজ আপনি আমার পাশ থেকে সরবেন না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আপনি পাশে থেকে আমার পেইনলেস ডেথ এনশিওর করেন।"
ছবির মানুষটির নাম ডাঃ এহসানুল করিম। মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নিজের হাতে গড়া ডাক্তার ছাত্রের হাত ধরে তিনি আকুতি জানিয়েছিলেন, "প্লিজ আপনি আমার পাশ থেকে সরবেন না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আপনি পাশে থেকে আমার পেইনলেস ডেথ এনশিওর করেন।"
ডাঃ এহসানুল করিমের আকুতিকে আমরা চাইলেই উপেক্ষা করতে পারি, কারণ একজন মানুষের জীবনে মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী, মৃত্যুতে পেইন হওয়া তেমনই নিয়তি। প্রতিটা মানুষই সম্ভবত মৃত্যুকে এভাবেই ফেইস করেন, এমন আকুতি আর কষ্ট নিয়ে। তাহলে একজন ডাঃ এহসান নিয়ে আমি কেন লিখছি? কেন উপেক্ষা করলাম না?

কারণ গত ৪৮ ঘন্টা এমন আকুতি নিয়ে মারা গেছেন ৫ জন ডাক্তার। ডাঃ মঈন থেকে তালিকার ক্রম নাম্বার যে ২১ পর্যন্ত উঠে গেছে এটা অনেকেই জানেন না। হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস হয়তো আপনিও জানেন না। ২১ জন ডাক্তার মারা গেছেন- এই লাইনটা আসলে ভয়াবহতাকে ঠিক প্রকাশ করে না। এই ২১ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেক হচ্ছেন ফুল প্রফেসর, বাকিরাও যথেষ্ট সিনিয়র। কেউ কেউ তো তাঁদের ফিল্ডে আইডল।
না, এখনো ভয়াবহতাকে বোধহয় ঠিকমতো বোঝানো গেল না। ওয়েল, লেট সাম এক্সপ্লেনেশন। অন্যান্য ফিল্ডের কথা বলতে পারব না, তবে মেডিকেল ফিল্ডটা হচ্ছে অনেকটা মিলিটারি সিস্টেমের মতো। একটা যুদ্ধে আমরা কী দেখি, বন্দুক হাতে নিয়ে যুদ্ধ মূলত করে সৈনিকরা, একজন জেনারেল বন্দুক হাতে নিয়ে ফ্রন্টলাইনে গিয়ে গোলাগুলি করেন না। বা উনি যদি গোলাগুলি করতেও নামেন, নায়কের মতো একাই প্রতিপক্ষের সব সৈন্য মেরে ছারখার করে দেবেন তাও না। হয়তো একজন সাধারণ সৈনিক যতটা গুলি করে তিনিও ততটাই করবেন।
তাহলে একটা যুদ্ধে হার জিত কেন সৈন্য মরার ওপর নির্ভর না করে অফিসার বা জেনারেল মারা যাবার ওপর বেশি নির্ভর করে? কেন সেনাপতি মারা যাবার সাথে সাথে অর্ধেক যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়? কারণ আপনি জানেন। একেকজন জেনারেলের অস্ত্র বন্দুক না, ব্রেইন। একজন জেনারেলের মগজ থেকে বের হওয়া একটা প্ল্যান আমূল বদলে দিতে পারে যুদ্ধক্ষেত্র। সৈনিক যখনই জেনে যায় তার কমান্ডিং অফিসার ডেড, হাতে যতই গোলাবারুদ থাকুক, তার যুদ্ধ মূলত তখনই শেষ হয়ে যায়। ট্রিগার চাপার বদলে হাত এমনি এমনি উঠে যায় উপরে, স্যারেন্ডার করার জন্য।
মেডিকেল সেক্টরটাও প্রায় এমনই। এই যে সব অধ্যাপক মারা যাচ্ছেন তারা এই ফিল্ডের জেনারেলসম। একটা ইউনিটে প্রফেসরহীন যদি ২০ জন ইন্টার্ন থাকে, নিবেদিতপ্রাণ মিড লেভেল থাকেন, সেখানে যে পরিমাণ কাজ হবে...জাস্ট একজন ডায়নামিক অধ্যাপক যোগ দিলেই কাজের পরিমাণ ও মান বেড়ে যায় অনেক গুন। একজন অধ্যাপক মানে সাহস, একজন অধ্যাপক মানে ইনোভেশন, একজন অধ্যাপক মানে ভরসা। আপনি সেই অধ্যাপককে রাউন্ডে আপনার রোগীর পাশে মাত্র ৩০ সেকেন্ড দেখে তাঁর গুরুত্ব ঠিক বুঝবেন না।
একজন সিনিয়র ডাক্তার মানুষ হিসেবে কেমন, অমায়িক বাকি বদরাগী, সৎ নাকি কমিশনখোর, তিনি সোসাইটির প্রতি নিবেদিত প্রাণ নাকি আত্মকেন্দ্রিক এসব প্রশ্ন বা বিতর্কের চেয়ে বড়ো কথা, একজন প্রফেসর মানে একজন প্রফেসর। প্রফেসর ব্রেইন তৈরির পথ দীর্ঘ, ব্রেইনের মূল্য অপরিসীম।
একটু খটকা লাগছে তাই না? কেন মানবিক গুণাবলীকে বিবেচনায় নিচ্ছি না? মানবিক গুণাবলী কি উপেক্ষণীয় কিছু? মানবিক গুণাবলী অবশ্যই বড়ো একটা ব্যাপার। কিন্তু এই যে একটা যুদ্ধকালীন সময়, এখন এসব আলোচনাকে ফাইলবন্দী করে রাখতে হবে। আপনার দেশে যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে, তবে আপনি সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট জেনারেলকে রণক্ষেত্রে নেতা হিসেবে চাইবেন। সে মানুষ হিসেবে কেমন সেটা বিবেচনা করবেন না। আগে তো দেশ বাঁচুক, আগে তো প্রাণ বাঁচুক।
এসব অধ্যাপকদের মানুষ কোন চোখে দেখে আমার ধারণা আছে। টাকার কুমির, কসাই, কমিশনখোর...কত কী! সত্যি বলতে অনেক জুনিয়র ডাক্তারও সিনিয়রদের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়, অভিমান করে। যৌক্তিক কারণ যে একেবারে নেই তাও না। কিন্তু প্লিজ, এখন এসব ভুলে যান। ডাক্তারের মৃত্যুর খবরকে পজেটিভ হিসেবে নিয়েন না। টাকার কুমির কসাইয়ের মৃত্যুতে খুশি হইয়েন না।
এই করোনা যুদ্ধে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের দরকার এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি। লীডারশীপ দরকার এখন, ইনোভেটিভ ডিশিশন দরকার, জুনিয়রের পেছনে ছায়া হয়ে সাহস দেয়ার জন্য দরকার। কিন্তু তাঁরাই চলে যাচ্ছেন একে একে। সংখ্যাটা খুব সম্ভবত একুশ। নতুন কেউ যোগ হলেন কিনা জানি না। একুশ জন মারা গেছেন, তারচেয়ে বড়ো ভয় আর কত জন একই পথ ধরবেন।
করোনায় আমাদের হার প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে আগেই। তবু যুদ্ধটাকে টেনে নেবার জন্য যাদের বেঁচে থাকার কথা, তারাও বিদায় নিচ্ছেন নীরবে। মিডিয়ায় খুব বেশি হই হট্টগোল নেই। কেউ সদয় হলে একটা ছোট্ট নিউজ করছে, নইলে তাও না। কারণ ডাক্তারের মৃত্যুতে মানুষের আগ্রহ নেই। যেখানে জনতার আগ্রহ নেই, সেটা খবরে আসে না। মিডিয়া একটা ব্যবসা, টিআরপি দিয়ে মিডিয়া চলে, টিআরপি নির্ভর করে জনতার আগ্রহে। জনতার আগ্রহ নোবেলের বিয়েতে, জয়া আহসানের কুকুরে, সৃজিতের চুমুতে, কোনো এক ফেসবুকারের ব্রা-প্যান্টিতে, কেরালার হাতিতে।
মিডিয়ার কাছে স্বভাবিকভাবেই তাই একজন অধ্যাপকের চেয়ে কভার সিংগার নোবেল বা কেরালার হাতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আজকে নোবেলের করোনা পজেটিভ আসলে মিডিয়া যে ফুটেজ পাবে, দশজন অধ্যাপকের মৃত্যু ততটা ফুটেজ দেবে না। লেট মি ক্লিয়ার এগেইন, করোনায় প্রতিটা মৃত্যুই সমান অপ্রত্যাশিত। পুলিশ, ব্যাংকার, অফিসার, দোকানদার, ডাক্তার... সার্ভিসে থাকা প্রতিটা মানুষের মৃত্যু সমান বীরত্বের। তবুও আমি এই মানুষগুলোর কথা আলাদাভাবে বলছি, কারণ এদের রিপ্লেসমেন্ট পাওয়া খুবই কঠিন।
এভাবে যদি মৃত্যুর মিছিল এগোয়, এভাবে যদি দিনে এখনকার নিয়মে "মাত্র" তিনজন করেও লিজেন্ড হারাতে হয়, এক মাসে মারা যাবেন ১০০ জন লিজেন্ড। দিনে একজন করে হারালে তিন মাসে মারা যাবেন একশজন। করোনা তিন মাসের আগে দেশ ছাড়বে এটা বোধহয় কেউই বিশ্বাস করতে চাইবেন না।

একশ বা তার অধিক প্রফেসর লেভেলের ডাক্তার হারানো মানে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ধ্বসে যাওয়া। চেম্বার বা হসপিটাল এরিয়াগুলোতে গেলে ভ্রম হয়, মনে হয় দেশে বোধহয় লাখ লাখ প্রফেসর আছেন। আসলে কিন্তু এমন না। সবাই সার্ভিসে থাকেনও না। প্রফেসরদের অনেকে হয়ে যান রাজনীতিবীদ, অনেকে হোন ব্যবসায়ী, কেউ কেউ ছাড়েন দেশ। সার্ভিসে যতজন আছেন, তাঁদের সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম।
মৃত্যুর স্রোত কীভাবে থামানো যাবে, আমি জানি না। আমার কোনো ধারণা নেই। আমি আশা দেখতে পাচ্ছি না। জানি না যারা নীতি তৈরি করেন, উনাদের হাতে টেক্কা টাইপ কোনো তাস আছে কিনা। আমি কেবল দেখছি ঘোরতর অন্ধকার। এমন লিজেন্ডদের একেকটা মৃত্যুতে ধ্বসে পড়া ভীত দেখছি। আমি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই সন্দিহান।
করোনা দেশে আসার আগেই যারা খুব শক্ত ভাষায় লেখালেখি করেছেন, তাদের মধ্যে আমিও বোধহয় একজন। হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করছি না যতটা ডেডলি মনে হয়েছিল করোনাকে, এখনো আমাদের দেশে ততটা ভয়ানক রূপ দেখা যাচ্ছে না। করোনা আগমনের কিছুদিন পরেই ইউরোপের তুলনায় তার নিরীহ রূপ ধরা পড়ে গেল...দেখলাম এ নিয়ে যারা বেশি লেখালেখি করেছিল তাদেরকে আতংকজীবি হিসেবে ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। কিছু সেলিব্রেটি পর্যায়ের মানুষও লিখলেন, "যারা এতদিন আমাদের ভয় দেখিয়েছে, করোনা যাবার পর তাদেরকে আনফ্রেন্ড করে দেব।"
আমি এই অবস্থাতেও ভয় দেখানোর জন্যই এই পোস্ট দিলাম। তবে ব্যবধান হচ্ছে এখন আর বলব না "এটা করা উচিত", " সেটা করা উচিত না"। কারণ এই অধ্যায় আমরা পার করে এসেছি। সকল তরফ থেকে একের পর এক ভুলের পর এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি রেজাল্ট দেখার অপেক্ষায়।
করোনা বাংলাদেশে কেন চূড়ান্ত ডেডলি হয়ে ওঠেনি এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউই দিতে পারবেন না। পাশাপাশি করোনা কখনো ডেডলি হবে না এই নিশ্চয়তা দেয়াও কারো পক্ষে না। এখন অফিশিয়াল মৃত্যু রেট এক পার্সেন্টের কিছুটা উপরে। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি প্রকৃত মৃত্যু আরো বেশি। আবার প্রকৃত করোনা আক্রান্তও আরো বেশি হবার সাথে। দুইটা হিসেবকে ব্যালেন্স করে যদি ডেট রেটকে এই দেড় পার্সেন্টেই ফিক্সড করি, তাহলে বাংলাদেশে যদি এক কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়, মৃত্যু হবে দেড় লাখ মানুষের।
ধীরে হোক, দুই বছর সময় নিয়ে হলেও হোক...এক কোটি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং এক লাখ মানুষ মারা যায়...তাতে চিকিৎসক কতজন হবেন? এখনকার ডাটা বলছে মোট মৃত্যুর ২.৬৮% হচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তার মানে এক লাখ মানুষ মারা গেলে বিশেষজ্ঞ মারা যাবেন ২৬০০ জনের চেয়েও বেশি। হিসাবটাকে সোজা অর্ধেক কমিয়ে দিলে, অর্ধেকের অর্ধেক করে দিলেও ৭০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হারাতে হবে। এক বছর না, দুই বছর না...পাঁচ বছরেও বাংলাদেশ ২০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হারানো এফোর্ট করতে পারবে না।
ভয়ের আরো আরেকটা পয়েন্ট বলিনি। যতদূর জানি মারা যাওয়া চিকিৎসকদের অধিকাংশই মেডিসিন ফিল্ডের। একটা নির্দিষ্ট ফিল্ড বিশেষজ্ঞ শুন্য বা আইডল শুন্য হলে ব্যাপারটা হবে চূড়ান্ত ভীতিকর।
সমাধান খোঁজা উচিত। করোনার যুদ্ধে ট্যাক্টিস বের করা দরকার। করোনার কাছে হার নিশ্চিত হয়েই গেছে, করোনা পরবর্তী সময়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা যেন ধ্বসে না পড়ে সেটাও ভাবা উচিত এখুনি। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ দিলেই পাওয়া যায় না। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রনোদনায় তৈরি হয় না। একজন বিশেষজ্ঞ তৈরির প্রক্রিয়া অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের এক্ষেত্রে করণীয় কিছুই নেই জানি। আসুন, যে ডাক্তার তাঁর ছাত্রের হাতে হাত রেখে পেইনলেস মৃত্যু কামনা করছেন, উনার জন্য একটু মন খারাপ করি। ফেসবুকে ব্রা-প্যান্টির যুদ্ধকালীন সময়ে একটু বিরতি নিয়ে যারা আইসিইউতে লড়ছেন, তাদের জন্য প্রার্থনা করি। আসুন, খানিকটা সমব্যাথী হই, একটু উদ্বেগ জমাই মনে। বিশ্বাসীরা তো জানেন, প্রেয়ার ডাজ মেটার। অবিশ্বাসী হলেও তো বুঝেন, সহানুভূতি জানানোতে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়।
সবচেয়ে বড়ো কথা, এই খবরগুলোতে যদি দেশের বেশিরভাগ মানুষ সত্যিই মন খারাপ করা শুরু করে দেয়...এমন খবর তৈরি কমে যাবে। কীভাবে কমবে, কোন সে প্রক্রিয়া এটা নিয়ে কথা বাড়াব না। মন খারাপ করলে এমনিতেও বুঝে যাবেন।
করোনায় মৃত সকল পেশার সকল শহীদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা...