ভিন্ন ভিন্ন দুইজোড়া দম্পতি, পাঁচ আর দশ বছরের সংসার। কেমন চলছে? জিজ্ঞেস করতেই নিচের কথাটা বললেন একজন...

'কী আর বলব! সম্পর্কটা আর স্বামী স্ত্রীর নাই, ভাই-বোনের হয়ে গেছে!'

শুনে প্রথমে হোঁচট খেলেও পরে বুঝলাম, তারা আসলে কী বলতে চেয়েছেন। অন্য জুটি বললেন আরও অদ্ভুত কথা, সে কথা আর নাই বা বলি!

সম্পর্ক নিয়ে আমার তুমুল আগ্রহ। আমি নানানভাবে সম্পর্ক বুঝতে চেষ্টা করি। সেই আগ্রহ থেকেই বিষয়টা মাথায় ঢুকে গেল। আরও কয়েকজোড়া দম্পতির সাথে কারণে-অকারণে কথা হল, সেই কথার সবটাজুড়ে দাম্পত্যের জীবন মানেই নিরস দিন, রোজগারের হিসেব, ব্যয়ের লিস্ট, সঞ্চয়ের প্ল্যান, একটা নিজের গাড়ি বা ফ্ল্যাট... এইসব কত কী!

সেখানে দীর্ঘ সময় জুড়ে ভালোবাসাবাসি করে পালিয়ে বিয়ে করা দম্পতি যেমন আছেন, আছেন এরেঞ্জড ম্যারেজওয়ালারাও। কিন্তু ঘুরেফিরে হিসেব-নিকেশ আর ভাবনার চালচিত্র মোটামুটি সেই একই।

তাহলে? বৃষ্টি নামলেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আধো অন্ধকারে কফির কাপ? ফিসফিস গল্প? রিকশায় হুড তুলে উড়ে চলা সেইসব দিন? বরষার প্রথম দিনের কদম? নীল শাড়ি কিংবা নুপুরের রিনিঝিনি শব্দে জল ও জোছনার কথকতা? কই? কই হাতের মুঠোয় হাত? চোখের ভেতর চোখ? কই?

প্রশ্ন করতেই চাঁছাছোলা উত্তর- আরে ধুর! বাচ্চা-কাচ্চা আছে না? ওদের সামলাতেই যা হিমশিম খেতে হয়! তোর মাথা কী গ্যাছে না কি রে? ৫-৭ বছরেই বুড়ো হয়ে গেছি, বুঝেছিস! এখনোতো জীবন রঙিন, আরেকটু বড় হ, তখন বুঝবি! তোর যত পাকাপাকা কথা। জীবনে অতো সহজ না, সিনেমা, কবিতা বা উপন্যাসের মতো না, জীবন জীবনের মত। সময় যেতে দে, সবই বুঝবি!

আমি জানি বুঝব। সকলই বুঝব। জীবন সময়ে আদল পাল্টায়, সময় অনুভুতি পাল্টায়, মানুষ পাল্টায়, মন পাল্টায়। কিন্তু কিছুই কি বাকী থাকে না?
কিছুই না? মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে কি হঠাৎ মনে হয় না, পাশের বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকা এই মানুষটিকেই চেয়েছিলাম? একটুকুও ভুল হয়নি সিদ্ধান্তে? একবারও কি মনে হয় না, এই জগতে এর চেয়ে ঢের বেশি ভালোবাসার কেউ আর ছিল না! দশ, পনেরো কিংবা কুড়ি বছরের দাম্পত্য জীবনেও গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে পাশের বালিশে শুয়ে থাকা মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে না? সেই কুড়ি বছর আগের মতন? তারপর হঠাৎ তার অগোচরে, ঘুমের ঘোরে চুপটি করে তার ঠোঁটে, গালে কিংবা কপালে আলতো করে চুমু খেতে ইচ্ছে করে না? করে? না কি আসলেই করে না?

ইঁচড়ে পাকামো হয়ে যাচ্ছে, বুঝি। তারপরও চারপাশ দেখে শুনে বুঝে হঠাৎই মনে হয়, সম্পর্কে কী আসল প্রভাবক? মন? না শরীর? শরীর যত পুরনো হতে থাকে, সম্পর্কও কি তাই? তাহলে মন? মনের দায় কী?

আমার গাঁয়ের পরিচিত এক মধ্যবয়স্ক মানুষ, সম্পর্কে আমার দাদা হন। দাদীর সাথে উঠতে বসতে সে কী তীব্র দুর্ব্যবহার। মা একদিন বললেন, 'এই মানুষটিই নাকি তরুণ বয়সে ছিলেন প্রবল বউ পাগলা, সবাই তাকে খেপাত! তাহলে? কী বদলে দিল? সময়? বাস্তবতা? জীবন? না কি অন্য কিছু? হয়তো এই 'অন্য কিছুই' মেনে নিতাম। কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কিছু দিন বাদেই!

সেই বৃদ্ধ মানুষটা হুট করেই তার চেয়ে ঢের কম বয়সি বয়সে তরুণী বিধবা এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল! সমাজ-সংসার সকল ওলট-পালট হয়ে গেল, কিন্তু সে অনড়! গত ঈদে বাড়ি গিয়ে অবাক। তার সবটা জুড়ে সেই নতুন বউয়ের জন্য অবিশ্বাস্য আহ্লাদ! সবাই বলছেন, এই বয়সেও কেউ বিয়ে করে বউ নিয়ে এমন আদিখ্যেতা করে? লজ্জা শরমের মাথাতো মাথা, হাত-পা, শরীরসুদ্ধ চিবিয়ে খাচ্ছে বুড়ো!

হঠাৎ তার এই যে থৈথৈ উপচে পড়া আবেগের, ভালোবাসার প্রকাশ দেখেছি, তা প্রকৃতই অদ্ভুত! তাহলে? শরীরই কি প্রভাবক? নতুন শরীর, নতুন ভালোবাসা? নাকি রহস্য?

রহস্য! এই সকল সম্পর্কের ভেতর সবচেয়ে তীব্র প্রভাবকের নাম কি তাহলে রহস্য? শরীরের রহস্য, মনের রহস্য? মানুষ রহস্য ভালবাসে, রহস্য আবিস্কার করতে ভালোবাসে। কিন্তু দিন কয় যেতেই সেই রহস্য উন্মোচিত হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি উন্মোচিত হয় শরীরের রহস্য। চেনা গলিঘুঁজি, রোজ আরও চেনা হতে হতে পানসে হয়ে যায়।

কে একজন কখনো আড্ডায় বলেছিলেন, ঐশ্বরিয়া রাই এর স্বামীও তার বউকে সামনে রেখে হঠাৎ আড়চোখে তাকিয়ে জানালার বাইরে পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দায় ভেজা কাপড় শুঁকোতে দিতে আসা সদ্য স্নান সারা পরস্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে! কী খোঁজে সেখানে? অনুদঘাটিত রহস্য? সত্য মিথ্যে জানি না, তবে শরীরের রহস্য ক্রমশই উদ্ঘাটিত হতে হতেই সম্পর্কও যেন কোথায় বেসুরো হয়ে যায়। এ এক ভালো না লাগা সত্য। অস্বীকার করা সত্য? তাহলে মন? মন নিয়ে আমরা কে ভাবি? মনতো আগেই ডুবে যেতে থাকে নানাবিধ হিসেবে। সেখানে রহস্য আর থাকে কই?

যেটুকু থাকে, যেটুকু গভীরতা, তার সবটুকু জুড়ে থাকে রোজকার হিসেব, হিসেবের খাতা, অন্যের জীবন, জমা খরচা, পরচর্চা। আর ক্রমাগত নিজেকে হারিয়ে ফেলা। যে জীবন মন নিজেকেই হারিয়ে ফেলে ক্রমাগত, সে জীবনে কে তাকে খুঁজতে আসবে? ভালোবাসতে আসবে?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা