বারো বছর বয়সে বাল্যবিবাহের শিকার হতে পারতো দোলা নিজেও। সেই মেয়েটাই রুখে দাঁড়িয়েছে এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে ছয়শোর বেশি বাল্যবিবাহ ঠেকানোতে অবদান রেখেছে সে, অথচ মেয়েটার বয়স মোটে ১৬ বছর!

বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের প্রধানতম সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা, লিঙ্গ বৈষম্য ইত্যাদির পাশাপাশি নানানরকম কুপ্রভাব, প্রচলিত কুপ্রথা বা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। শুধু অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী অথবা গ্রামীণ সমাজে নয়, বরং শিক্ষিত পরিবার ও শহুরে সমাজেও বাল্যবিবাহের প্রবণতা এখনো বেশ উল্লেখযোগ্য হারেই আছে৷ পাশাপাশি বাল্যবিবাহের মধ্য দিয়ে শিশুদের ওপর ক্রমাগত শারীরিক ও যৌন নির্যাতন বৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে এর ফলে বাল্যবিবাহে আবদ্ধ নারীদের শিক্ষার হার ও অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ তথা আত্মনির্ভরশীলতার হারও ক্ষীণ হয়ে আসছে। গর্ভপাতের মতো ঘটনার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে শারীরিক জটিলতা ও ঝুঁকিও।

এদিকে বছর পাঁচেক আগে ওয়াশিংটন ভিত্তিক আইএফপিআরআই এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে গত দুই দশকে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার কমেছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল অবধি এই হার ৬২ দশমিক ৩ ভাগ হলেও, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালে কমে ৪৩ ভাগ হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার শতকরা ৫ দশমিক ৪ ভাগ, আর ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের শতকরা ৩৭ ভাগ৷ সুতরাং বলতেই হবে, হার কমলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। ড. প্রফেসর মিজানুর রহমানের মতে, পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের পরিমাণ বেশি। 

এমতাবস্থায় সকলপ্রকার সামাজিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে যাচ্ছেন মাত্র ১৬ বছর বয়সী দোলা আক্তার রেবা নামক এক তরুণী। ইতিমধ্যেই প্রায় ছয় শতাধিক বাল্যবিবাহ রোধ করতে মোটাদাগে ভূমিকা রেখেছেন তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা। আলোড়ন তুলেছেন শিশু মানবাধিকার কর্মী হিসেবে। কিন্তু কিভাবে ও কেন এতো অল্পবয়সে এমন সংগ্রামে সোচ্চার হলেন দোলা তা খানিকটা জেনে নেয়া যাক৷ 

দোলার বয়স যখন বারো তখন প্রতিবেশীরা তাকে বিয়ে দেয়ার প্ররোচনায় মাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বলে রাখা ভালো, দোলার ভাষায় তাঁর মায়েরও বিয়ে হয়েছিলো মাত্র ১৩ বছর বয়সে। এদিকে কোনোভাবে সেই যাত্রায় বাল্যবিবাহের অভিশাপ গায়ে মাখতে হয়নি দোলার, তিনি রক্ষা পান। তাছাড়া নিজের মায়ের এতো অল্প বয়সে বিয়ের মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর শৈশব থেকে বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারটা দোলা কখনো মেনে নিতে পারেননি। তাই নিজেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা ভাবলেন।

দোলা আক্তার রেবা, ছবি- সমকাল

সেই বোধদয়ের ধারাবাহিকতায় ওয়ার্ল্ড ভিশন নামক একটি মানবিক সাহায্য সংস্থায় দোলা মাত্র দশ বছর বয়সে যোগ দেয়৷ এই সংস্থাটি শুধু বাংলাদেশ নয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, নেপাল সহ সারা বিশ্বের যেসকল দেশে মেয়েদের নানামুখী ঝুঁকি অত্যাধিক, সেসব দেশেই তারা মূলত কাজ করে। গৃহীত দান দেয়ার পাশাপাশি, অসচেতন পরিবারগুলোকে নিজস্ব প্রশিক্ষণ আয়োজনের সাথেও তারা যুক্ত করে এবং নারীশিক্ষার পক্ষে জনমত তৈরিতে সহায়তা করে। দোলা সংস্থাটিতে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে খুব দ্রুতই নিজেকে শিশু অধিকার কর্মী হিসেবে গড়ে তোলেন। প্রশিক্ষণের মধ্যেই বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতনসহ বাংলাদেশের মেয়েদের নানান সমস্যা এবং এর কুফল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পান তিনি। 

এরপর ধীরে ধীরে ওয়ার্ল্ড ভিশন চাইল্ড ফোরামের অংশ হয়ে উঠেন, যারা মূলত বাল্যবিবাহ রোধ ও শিশু নির্যাতন বন্ধে প্রত্যক্ষভাবে জনসচেতনতামূলক কাজ করে থাকে। এতে সহকর্মী হিসেবে পান কিছু আইনজীবীসহ তার মতোই একদল তরুণকে। এভাবে দোলা ও তাঁর দল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশুদের ওপর সহিংসতা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিবাহ রোধে ব্যাপক জনমত তৈরি করার প্রচেষ্টা করে যায়। প্রায় দুই বছর নিরলসভাবে কাজ করার মধ্য দিয়ে দোলা ও তার সহকর্মীরা দেশব্যাপী প্রায় ছয়শত বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। এখন নিজেই চাইল্ড ফোরামের লিডারশীপ দলেরও অন্যতম সদস্য হয়ে উঠেছেন।

তবে দোলার সংগ্রাম কোনোভাবেই এতো সহজ নয়। বাল্যবিবাহ রুখতে ও পরিবারগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কখনো কখনো পুলিশি সহায়তাও নিতে হয়েছে তাকে। এমনকি নিজের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। 

একবার এক বোনের বিয়ে দোলা আটকে দিয়েছিলো সৎসাহসের সাথেই। বোনের বয়স ১৫ হলেও, ১৮ দেখিয়ে পরিবারটি জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলো। দোলা সন্দেহপ্রবণ হয়ে পরিবারটির নিকট মেয়ের জন্মসনদ খুঁজলে তাতো দেয়াই হয়নি, বরং তাকে পেটানো হয়, নির্যাতন করা হয়৷ পরে দোলা অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ একজন জেলা কর্মকর্তার সাহায্যে বিয়ে বন্ধ করেন। সুতরাং অবিচল লড়াইয়ের মধ্যে অসংখ্য নাটকীয় মোড় আছে, আছে দমে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প। আর এতে কখনো কখনো নিজেকে হুমকির মুখে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেন না দোলা। 

ছয়শোর বেশি বাল্যবিবাহ ঠেকানোয় ভূমিকা রেখেছে দোলা, ছবি- sbs.au

অবশ্য দোলার পদচারণা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহলেও তিনি জয়গান তুলেছেন। ইতিমধ্যেই জেনেভায় জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং বাংলাদেশের মেয়েদের মুখোমুখি নানান সমস্যার ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি এসব হ্রাস ও সমাধানের লক্ষ্যে কিধরনের কার্যক্রম পরিচালনা তারা করছে সেটির চিত্রও তুলে ধরেন। 

বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নিকট বারংবার দাবী জানিয়ে আসছেন দোলা আক্তার রেবা। তার মতে, শিশুদের অভিযোগ শোনার জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করতে হবে। তিনি মনে করেন, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে শিশুবান্ধব পরিবেশ নেই৷ শিশুদের জন্য কোনো কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পরিকল্পনায় শিশুদের মতামত প্রদান বা অংশগ্রহণের সুযোগ নেই যা খুবই দরকার। এভাবে শিশুদের অধিকার আদায়ে শিশুদের মতের অংশগ্রহণকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন দোলা। 

বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারীতে কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই সংকটে বাল্যবিবাহের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বিশেষভাবে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও আর্থিক অনটনের ভোগা পরিবারগুলো নিজেদের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিবাহের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাই দোলা আক্তার রেবার দলটি এখন পূর্বের তুলনায় আরো বেশি তৎপর। 

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু বাল্যবিবাহ আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে সুন্দর আগামীর সন্ধানে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছেন একজন দোলা আক্তার রেবা। অনেকটাই সুকান্তের তেজদীপ্ত কবিতার আলোকে, নবজাতকের কাছে পৃথিবী বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকারই যেন ফুটে উঠছে দোলার কর্মে। বয়স আঠারো পেরোনোর আগেই যেভাবে তিনি লড়াইটা করছেন, তা রীতিমতো বাংলাদেশের বড় একটি অংশের পশ্চাৎপদ মানসিকতায় বিশাল চপেটাঘাতই বলতে হবে। আমরা চাইবো, এই সমাজে প্রতি পদক্ষেপে, চেতনায় যেন একজন দোলা আক্তারের জন্ম হয়। এভাবেই তারা রুখে দাঁড়াক, আদায় করুক নিজের অধিকার।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা