ডা. বিজন দেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছিলেন, সেটাকে ইস্যু বানিয়ে তাকে বিতর্কিত করার অযথা একটা চেষ্টা চলছে। আমরা বরং গ্লাসের ভরাট অংশটুকু দেখি, যেখানে একজন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিকের দেখা মেলে, যিনি জীবনের সুযোগ-সুবিধা-বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে জন্মভূমির ঋণ শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করেন...

করোনার টেস্ট কিট এবং রিএজেন্ট নিয়ে কিছুদিন আগেও সংবাদমাধ্যমে আলোচিত চরিত্র ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী এবং করোনা শনাক্ত ‌কিটের আবিস্কারক ড. বিজন কুমার শীল। গত দুই/তিনদিন ধরে আবারও আলোচনার বিষয়বস্তু তিনি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সব ধরণের কাজ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, তাকে দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে ফিরে যেতে হবে- এমনটাই হচ্ছে সংবাদের বিষয়বস্তু। তবে সবকিছু ছাপিয়ে কিছু গণমাধ্যম যে ব্যাপারটাকে হাইলাইট করার চেষ্টা করছে, সেটা হচ্ছে ডা. বিজনের নাগরিকত্ব। ডা. বিজন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন আঠারো বছর আগে, সেটাকে শিরোনামে এনে তাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা দেখে খুবই বিরক্ত হলাম। 

ড. বিজন জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক।২০০২ সালে সিঙ্গাপুর সরকার ডা. বিজন কুমার শীলকে সেদেশের সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার আহবান জানায়। চাকরির নিয়ম অনুযায়ী সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল তাকে। আর সিঙ্গাপুরে যেহেতু দ্বৈত নাগরিকত্বের বিধান নেই, তাই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বিসর্জন দিতে হয়েছিল তাকে। কিন্ত বাংলাদেশকে কখনও হৃদয় থেকে মুছে ফেলেননি ডা. বিজন। তাই লাখ লাখ টাকার লোভ বিসর্জন দিয়ে যখনই সুযোগ পেয়েছেন, এদেশে ছুটে এসেছেন। যে দেশ তাকে লালন-পালন করেছে, বিজ্ঞানী বানিয়েছে, সেই দেশের ঋণ শোধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা ডা. বিজন করেছেন, এখনও করছেন। 

বিজন কুমার শীলের জন্ম ১৯৬১ সালে, নাটোরের বনপাড়ায়৷ তিনি বনপাড়া সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে এসএসসি ও পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন৷ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভেটেরেনারি মেডিসিনে মাস্টার্স করা বিজন কুমার ডক্টরেট করেছেন ইংল্যান্ডের সারে ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯১ সালে৷ সেখানে তিনি ১০ বছর কাজ করেন৷ ২০০২ সালে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা করেন। তারপর কিছু দিন কাজ করেন সাভারের প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে। সেখানে তিনি একটি নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। প্রচলিত পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের ওপর করা হতো। বিজন সেটা কাঁচের ওপর করেন এবং সফল হন। কাঁচের ওপর করার সুবিধা হলো ধুয়ে আবার ব্যবহার করা যায়। 

বিষয়টি নিয়ে ফ্রান্সের একটি জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ লেখেন ড. বিজন। সেই লেখার সূত্র ধরে সিঙ্গাপুর সরকারের থেকে প্রস্তাব আসে সে দেশের সিভিল সার্ভিসে যোগদানের। সিঙ্গাপুর সরকার সারা পৃথিবী থেকে দেশ গঠনে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ বাছাই করে নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে। সেদেশে এটা খুবই কমন একটা ব্যাপার। সিঙ্গাপুরে কর্মজীবনের শুরুতে তাকে ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর  এলো সার্স ভাইরাস, এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয় বিজনকে। অত্যাধুনিক ল্যাবে তিনি শুরু করেন গবেষণা। সফলভাবে ২০০৩ সালে উদ্ভাবন করেন সার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট, যা দিয়ে সিঙ্গাপুর, চীনসহ আরও কয়েকটি দেশ সার্স ভাইরাস মোকাবিলা করে। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নাম ছড়িয়ে পড়ে ড. বিজন কুমার শীলের।

ডা. বিজন সরাসরি সিঙ্গাপুরের সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ২০০৬ সাল পর্যন্ত। এরপর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান ‘এমপি বায়োকেমিক্যালস  এশিয়া প্যাসিফিক প্রাইভেট লিমিটেড’ থেকে তার কাছে চাকরির প্রস্তাব আসে, আরও বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা ও বিপুল আর্থিক সুযোগ-সুবিধা করতে পারবেন- এটা ভেবেই তিনি ‘গবেষণা পরিচালক’ হিসেবে সেখানে যোগ দেন। সেই প্রতিষ্ঠানেরই সিঙ্গাপুর অফিসে তিনি কর্মরত ছিলেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এই সময় তিনি ‘মাল্টিশিয়র হেপাটাইটিস-সি র‌্যাপিড টেস্ট পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করেন। প্রচলিত পদ্ধতির পরীক্ষায় হেপাটাইটিস-সি নেগেটিভ বা পজিটিভ শনাক্ত করা যায়। 

এরপর ভারতে চাকরি করেছেন কিছুদিন, তারপর আবার ফিরে গেছেন সিঙ্গাপুরে। ১৪টির বেশি ইন্টারন্যাশনাল পেটেন্ট এবং পাঁচটি কিট আছে তার নামের পাশে, যেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে পাওয়া যায়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে তার পরিচয় দীর্ঘদিনের, সেই সূত্রেই এবছরের শুরুতে যখন করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে, তখন তিনি ডা. জাফরউল্লাহকে বলেছিলেন, সুযোগ পেলে তিনি গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে কাজ করতে চান। ডা. বিজনের কিট উদ্ভাবন এবং সার্স ভাইরাস নিয়ে গবেষণার কথা জাফরউল্লাহ জানতেন, এত বড় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন বিজ্ঞানী বাংলাদেশের একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন, তার তো আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। শুরু হলো গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে ডা. বিজনের জার্নি। 

করোনা শনাক্তকারী কিট হাতে ডা. বিজন

গণস্বাস্থ্যের হয়ে করোনার টেস্ট কিট উদ্ভাবন করেছিলেন ডা. বিজন এবং তার দল। তবে কিট মানসম্মত না হওয়ায় সরকার সেটির অনুমোদন দেয়নি। আগের ভুলত্রুটি সারিয়ে নতুন কিট তৈরী এবং গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ডা. বিজন। কিন্ত এরইমধ্যে এসেছে দুঃসংবাদ, বাংলাদেশে তার ওয়ার্কিং ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যদিও ট্যুরিস্ট ভিসার মেয়াদ আছে, বাংলাদেশে থাকতে তার কোন সমস্যা নেই, কিন্ত কাজ করতে পারবেন না ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন না করা পর্যন্ত। জুলাইয়ে ইমিগ্রেশন বিভাগ তাকে বলে দিয়েছে, বিদেশি নাগরিক হিসেবে কাজের অনুমতি না নিয়ে তিনি কাজ করতে পারবেন না৷ একারণে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের হয়ে গবেষণা এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালন থেকে আপাতত বিরত আছেন তিনি। 

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ডা. বিজনের কাগজপত্র সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়া হয়েছে, তবে এখনও অনুমতি পাওয়া যায়নি। প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজারেরও বেশি বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজের অনুমতি চেয়ে বিআইডিএ-তে আবেদন করে৷ সাধারণত নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষই এই আবেদন করে থাকে, বিজনের ক্ষেত্রে যেমন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আবেদন করেছে৷ মোট ১০ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয় আবেদনের সঙ্গে৷ কাগজপত্র ঠিক থাকলে এক-দুই দিনের মধ্যেই অনুমোদন পাওয়া যায়৷ কিন্তু ড. বিজন কুমার শীলের পক্ষে আবেদন করা হয়েছে গত মার্চ মাসে৷ অথচ এখনো অনুমোদন মেলেনি! এই বিলম্বের কারন কি, সেটাও জানা যায়নি। 

এখানে।একটু জাফরউল্লাহ চৌধুরীকে কোট করি। ডা. বিজনের এই ওয়ার্কপারমিট ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশী দৈনিক ডেইলি স্টারকে তিনি বলেছেন- ‘বাংলাদেশের বিজ্ঞানীকে সিঙ্গাপুর ডেকে নিয়ে নাগরিকত্ব দিল। তার মেধা কাজে লাগিয়ে সিঙ্গাপুর, চীন সার্স ভাইরাস প্রতিরোধ করলো। আর এখন তিনি নিজে থেকে বাংলাদেশে আসলেন। তার মেধাকে আমরা কাজে লাগাব না? তার উদ্ভাবিত কিটের অনুমোদন দেব না? তাকে আমরা এ দেশে রাখতে পারবো না? আজ তিনি চলে গেলে কার ক্ষতি? আমাদের ক্ষতি, বাংলাদেশের ক্ষতি। ড. বিজনের তো কোনো ক্ষতি নেই। সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বহু দেশে এখানকার চেয়ে দশগুণ বেশি বেতনে তিনি কাজ করতে পারবেন। প্রয়োজনহীন লাখ লাখ বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করছে। তাদের কতোজনের ওয়ার্ক পারমিট আছে? আমরা তো ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করতে দেওয়ার কথা বলছি না। ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করেছি। নিশ্চয়ই ওয়ার্ক পারমিট পাবো।’

ডা. বিজন মাতৃভূমির প্রতি ঋণ শোধ করতে চান, সেজন্যেই তিনি বাংলার গণমানুষের জন্য কাজ করার নেশায় কোটি টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে ছুটে এসেছেন এদেশে। এই দেশের কাদা মাটিতে তিনি বেড়ে উঠেছেন। কলেজে পড়ার সময় বাবার সঙ্গে মাঠে কৃষি কাজ করেছেন। এক জীবনে বেঁচে থাকার জন্যে যা দরকার, এখন তার সবই হয়েছে। অর্থের পেছনে ছোটার মানসিকতা তার কখনো ছিল না। যা আছে, তা হচ্ছে দায়বদ্ধতা। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই তিনি সিঙ্গাপুরেত আলিশান জীবন রেখে বাংলাদেশে ছুটে আসেন। দশভাগের এক ভাগ বেতন বা গবেষণার সুবিধা পাবেন না জেনেও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেন, সিঙ্গাপুরের আকাশচুম্বী ভবন ছেড়ে সাভারের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে বসর গড়েন, কারণ এখানে থাকলে তিনি নিজের দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে পারবেন, দেশের জন্য অবদান রাখতে পারবেন। 

কিছু লোক গ্লাসের খালি অংশটা দেখে, তাদের চোখে বিজন দেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন, সেটাকে ইস্যু বানিয়ে তাকে বিতর্কিত করার অযথা একটা চেষ্টা চলছে। আমরা গ্লাসের ভরাট অংশটুকু দেখি, যেখানে একজন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিকের দেখা মেলে, যিনি জীবনের সুযোগ-সুবিধা-বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে জন্মভূমির ঋণ শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করেন। ডা. বিজন যদি বাংলাদেশের জন্য কাজ না করতে পারেন, তাহলে বিজনের ক্ষতি হবে না তেমন কিছুই, ক্ষতি হবে এদেশের মানুষের, তার মেধার মূল্যায়নটা করতে না পারলে ভুক্তভোগী আমরা হবো। দেশের জন্য যিনি কাজ করছেন, তার ভুলত্রুটি থাকলে অবশ্যই সমালোচনা হবে, কিন্ত অহেতুক নিন্দা করে তাকে কাজের সু্যোগটাই যদি দেয়া না হয়, সেটা হবে তার মেধাকে অবমূল্যায়ন করা। সেই ভুলটা আমরা যেন না করি...

বিশেষ কৃতজ্ঞতা- দ্য ডেইলি স্টার ও সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা