পাঁচ বছর বয়সেই মেয়েটা ঠিক করে রেখেছিল, বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে। ফারজানা হুসেইন নামের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সেই নারী এখন বৃটেনের সেরা জেনারেল প্র‍্যাকটিশনার নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানকার পিকাডেলি বিলবোর্ডে ঠাঁই পেয়েছে তার ছবি!

বাবা ছিলেন অ্যানেস্থেশিয়া স্পেশালিস্ট, ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার-নার্সদের সঙ্গে তার বসবাস। পাঁচ বছর বয়সে যখন বাবার সঙ্গে হাসপাতালে যেতেন, তখন নার্স আন্টিরা তাকে চকলেট খেতে দিতেন, সবাই ভীষণ আদর করতেন তাকে। বছর পাঁচেকের ছোট্ট মেয়েটা তখনই নিজের জীবনের গতিপথ ঠিক করে নিয়েছিল- বড় হয়ে ডাক্তার হবে সে। মধ্যচল্লিশে দাঁড়িয়ে ফারজানা হুসেইন নামের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সেই নারী এখন চিকিৎসক, যেন তেন ডাক্তার নন, বৃটেনের সেরা জেনারেল প্র‍্যাকটিশনার নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানকার পিকাডেলি বিলবোর্ডে ঠাঁই পেয়েছে তার ছবি! 

যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর চিকিৎসা সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে সেরাদের সেরা নির্বাচন করা হয়। মূলত এই পেশাজীবিদের উৎসাহ দএয়ার জন্যেই এই আয়োজনটা করা হয়। কর্মক্ষেত্রে সারা বছরের কাজের ভিত্তিতে করা হয় এই মূল্যায়ন। সেখানেই বাজীমাত করেছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফারজানা হুসেইন। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের অজস্র কর্মীকে (ডাক্তার-নার্স) পেছনে ফেলে নিজের কর্মদক্ষতায় গত বছরের সেরা জেনারেল প্র‍্যাকটিশনার নির্বাচিত হয়েছেন ফারজানা। 

বাবা-মা দুজনেই ছিলেন বাংলাদেশী। বাবা ১৯৭০ সালে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে, পরে সেখানেই থিতু হয়েছেন। ভদ্রলোক ডাক্তার ছিলেন, সেটা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। ডাক্তার হবার বাসনা নিয়ে ফারজানা নিজেও ভর্তি হয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলসের স্কুল অফ মেডিসিনে। তবে ডাক্তারী পেশাটার প্রতি ফারজানার অন্যরকম ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল মায়ের কারণে। তিনি যখন মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, তার মা তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। সারা সপ্তাহ ক্লাস করে উইকেন্ডে ফারজানা ছুটে যেতেন আড়াইশো কিলোমিটার দূরে, যে হাসপাতালে মা ভর্যি আছেন। রুটিনের মতো হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। 

একবার মা প্রচণ্ড অসুস্থ, শরীর খারাপের দিকে যাচ্ছে ক্রমশ, ফারজানার পরদিন গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস। মাকে রেখে ক্যাম্পাসে ফিরে যাবেন কি যাবেন না- এই দোটানায় যখন ভুগছেন, তখন মা-ই তাকে জোর করে ফেরত পাঠালেন, বললেন, তুমি কলেজে ফিরে যাও। আমি চাই আমার মেয়ে অনেক বড় ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, আমি ঠিক হয়ে যাব।" তার পাঁচদিন বাদে মা মারা গিয়েছিলেন, জীবিত অবস্থায় মাকে আর দেখতে পাননি ফারজানা। 

ডা. ফারজানা হুসেইন

তবে মায়ের শেষ কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল তার। বড় ডাক্তার হতে হবে, মানুষের সেবা করতে হবে। গত দুই যুগ ধরে সেই মিশনেই ছুটে চলেছেন ফারজানা হুসেইন। পথচলাটা বন্ধুর ছিল, অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। কিন্ত ফারজানা হার মানেননি কখনও, হাল ছাড়ার চিন্তাও করেননি। যখনই হতাশা আঁকড়ে ধরেছে, তখন মায়ের কথা স্মরণ করেছেন, ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে, অদ্ভুত একটা শক্তি এসে জড়ো হয়েছে মনের ভেতর। 

প্রায় আঠারো বছর ধরে ইংল্যান্ডের নিউহ্যাম শহরে প্রোজেক্ট সার্জারী নামের একটা মিশন চালাচ্ছেন ফারজানা হুসেইন এবং তার টিম। ২০০৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে এপর্যন্ত প্রায় ৪৫০০ রোগীকে সেবা দিয়েছেন তারা, সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। পিটার জোনাস নামের এক সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে মিলে প্রোজেক্ট সার্জারির যাত্রা শুরু করেছিলেন ফারজানা হুসেইন, পিটার ছিলেন তার সবচেয়ে বড় মেন্টর। ছয় বছর আগে পিটার মারা যাওয়ার পরে পুরো কাজের ভার এসে পড়েছিল ফারজানার কাঁধে, দমে না গিয়ে গোটা প্রোজেক্টটাকে চালিয়ে গেছেন তিনি। নিউহ্যাম শহরের চিকিৎসার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দিগ্বিদিক, সেটার পেছনে ডা. ফারজানা হুসেইনের বড়সড় অবদান আছে।

নিজে বাংলাদেশী হওয়ায় মাইগ্রেন্ট পেশেন্টদের সঙ্গে আন্তরিক হয়ে মিশতে পারেন ফারজানা, যেটা স্থানীয় অনেক চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব হয় না। নিজের কাজটাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন ফারজানা, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়ার সামর্থ্য তাকে দেয়া হয়েছে, সেই দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা তিনি করেন। রোগীদের তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের মতোই ট্রিট করেন, কারণ তিনি জানেন, এই মানুষগুলোও কারো না কারো আপনজন। 

লন্ডনের পিকাডেলি লাইটস নামের জায়গাটায় পিকাডেলি বিলবোর্ডে এখন ফারজানার বড়সড় একটা ছবি ঝুলছে, গত বছরের সেরা জেনারেল প্র‍্যাকটিশনার নির্বাচিত হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে সেখানে। বৃটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের তাবৎ কর্মীদের পেছনে ফেলে যিনি এই খেতাব জিতেছেন, সেই ফারজানা হুসেইনের শরীরে মিশে আছে বাংলাদেশী রক্ত। তার এই অর্জনে খানিকটা হলেও গর্ববোধ তো আমরা করতেই পারি।

বিলবোর্ডে ডা. ফারজানার ছবি

আসলেই কি পারি? একটা ঘটনা উল্লেখ করি তালে। এই লেখার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, তবুও বলছি। ডা. সেঁওতি, বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া সরকারী চিকিৎসক, করোনাযোদ্ধাদের একজন। ময়মনসিংহ শহরের নয়াপাড়ার চড়পাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। করোনাকালীন সময়ে রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নিজে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার আক্রান্ত হবার কথা শুনে পাড়া-প্রতিবেশী নামধারী অমানুষের দল তাকে জোরপূর্বক বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। উনি জিনিসপত্র গোছানোর জন্য একটু সময় চেয়েছিলেন, দেয়া হয়নি সেটাও।

দুই মাস পর ৩৮তম বিসিএসের ফলাফলে দেখা গেল, ডা. সেঁওতি প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশকৃত হয়েছেন। এখন কারো সাহস হবে, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মমর্তা ডা. সেঁওতীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার? আমরা ফেসবুকে বিপ্লব করি, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা কেন প্রশাসন ক্যাডারে আসবেন, কেন তারা ফরেন ক্যাডারের জায়গা দখল করবেন, একজন ডাক্তার কূটনীতির কি বোঝেন- অথচ এটা দেখি না, ডাক্তারদের প্রাপ্য সম্মান দেয়ার বেলায় আমরা বাকি দুনিয়ার চেয়ে কতটা পিছিয়ে আছি। 

রোগীর সেবা করে বৃটেনে ডা. ফারজানা হুসেইন পুরস্কৃত হন, তার ছবি ঠাঁই পায় বিলবোর্ডে, আর ডা. সেঁওতিরা অপমানিত হয়ে ডাক্তারির পেশাই ছেড়ে দেন। এদেশে তাহলে ফারজানা হুসেইনদের মতো ডাক্তার তৈরি হবেন কি করে, বলতে পারেন? ডা. ফারজানার কৃতিত্বে আমাদের গর্ব হয়, আবার ডা. সেঁওতীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনার কথা কল্পনা করলে ঘৃণাও জন্মে, এই দুইয়ের মাঝখানে আফসোসের অদ্ভুত এক দোলাচালে টিকে থাকতে হয় আমাদের... 

তথ্যসূত্র: ইস্টার্ন আই ডট বিজ


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা