সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের পেটে তো ভালোবাসা হজম হয় না। তাই তিনি দেশে আসতে না আসতেই তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হলো, তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আত্মীয়। তিনি নাকি কুমিল্লার এমপি হতে এসেছেন...
করোনা তান্ডবে লণ্ডভণ্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কসহ পুরো দেশজুড়ে মারা গেছে ১ লাখেরও বেশি মানুষ, আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই মিছিলে অনেক চিকিৎসক পিছু হটেছিলেন। নিউইয়র্কের মতো মৃত্যুপুরীতে একজন বাংলাদেশি ডাক্তার আবির্ভূত হয়েছিলেন দেবদূত হিসেবে। তার নাম ফেরদৌস খন্দকার।
করোনার এই ক্রান্তিকালে প্রবাসীদের কাছে ভরসার প্রতীক মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। লড়াইটা শুরু করেছিলেন মাথা উঁচু করে করে, বীরের মতোই। করোনা রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিয়েছেন। বিশেষ করে অসুস্থ প্রবাসী বাংলাদেশিদের কারো ফোন পেলেই ছুটছেন গাড়ি নিয়ে, সঙ্গে নিয়েছেন চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং খাদ্য সামগ্রীও।
প্রতিদিনই ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা বিরামহীন সেবা দিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি যা করেছেন, সেই বিরোচিত ভূমিকার কথা আমেরিকার বাংলাদেশি প্রবাসীদের মুখে মুখে। তার এই কর্মকাণ্ড দেশটির প্রভাবশালী বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারও করেছে। তবুও এই মহাদুর্যোগের মাঝেও ভুলে যাননি বাংলাদেশের কথা।
প্রতিদিনই দুই বেলা রুটিনমাফিক ফেসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে এসে করোনা বিষয়ে নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। নিউইয়র্কের করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে, আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপের দিকে।
এমন সময় সিদ্ধান্ত নিলেন নিজ জন্মভূমির মানুষকে করোনা থেকে বাঁচানোর যুদ্ধে শামিল হবেন। শুধু তিনি একা আসেননি, সাথে করে নিয়ে এসেছেন একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল। এনেছেন চিকিৎসা সরঞ্জামও। এই দুঃসময়ে দেশের মানুষের পাশে থাকাটা খুবই জরুরি মনে করেছেন বলেই এমনটা করেছেন।
ঢাকায় এবং কুমিল্লায় সাধারণ রোগীদের জন্য সাময়িকভাবে একটি আর্জেন্ট কেয়ার ক্লিনিক করারও পরিকল্পনা রয়েছে তার। এই মানুষটার ভাবনাটা সুন্দর। তার জন্য যদি একজন মানুষও উপকৃত হন তবে তিনি ভাববেন সেটাই তার স্বার্থকতা। অনেকেই নাকি তাকে প্রশ্ন করেন, কি লাভ এসব করে?
নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন নিজের মতো করে। তিনি সাধারণত এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পছন্দ করেন না। আপন মনে কাজ চালিয়ে যান। তিনি মনে করেন, তারা সত্যিই অভাগা যারা মায়ের প্রতি, দেশের প্রতি এই ভালোবাসার টান অনুভবই করতে পারে না।
আবার অনেকেই তাকে বলেন, যে টাকা তিনি মানুষের সেবায় খরচ করছেন, সেটা দিয়ে ব্যবসা করতে পারতেন, সম্পত্তি কিনতে পারতেন। তিনি সেটা করেননি। তার মতে যারা এমনটা ভাবে, তারা বোকার স্বর্গে আছেন। দুনিয়াতে মায়ের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বা সুযোগ সবার আসে না।
তিনি সেই ভাগ্যবান মানুষদের একজন হতে চেয়েছেন, যারা দেশকে ভালোবাসে, মানুষকে ভালোবাসে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ভালোবাসা অমূল্য। তাইতো নাড়ির টানে বাড়ি ফিরেছেন।
সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের পেটে তো ভালোবাসা হজম হয় না। তিনি দেশে আসতে না আসতেই তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হলো, তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আত্মীয়। তিনি নাকি কুমিল্লার এমপি হতে এসেছেন। আরেক বঙ্গবন্ধুর খুনি রশিদের খালাতো ভাই বানানো হয়েছে তাকে। আরো বলা হয়েছে, উনি নাকি পলাতক তারেক রহমানকে নিয়মিত টাকা পয়সা দেন।
পরে অবশ্য জানা গেলো, ডাক্তার ফেরদৌস মোশতাকের ভাগিনা, কথাটা সত্য। মোশতাক আহমেদ তার আপন মামা। তবে সে বঙ্গবন্ধুর খুনী মোশতাক না। সে আমেরিকার বোস্টনে থাকে, এখনও জীবিত। তবে যেহেতু ফেরদৌসের নামেও খন্দকার আছে, তাই তার বিরুদ্ধে এভাবে অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
দেশে আসার জন্য যখন তিনি বিশেষ ফ্লাইটে চড়েছিলেন তখনও হয়তো কল্পনাও করেননি তার জন্য এতো লজ্জাজনক তিক্ত অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে। কোভিড-১৯ নিয়ে গত তিনমাস যুক্তরাষ্ট্রে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন তিনি। দেশেও এসেছিলেন দেশের মানুষের কোনো কাজে নিজেকে লাগানো যায় কিনা সেই উদ্দেশ্য নিয়ে। এই দেশ থেকে ডাক্তারি পাশ করে বিদেশ গিয়ে ৯০ শতাংশই দেশে ফেরত আসেন না। ্তিনি দেশের দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার হয়েছেন। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই বার বার দেশে ফিরে আসেন।
আর সেই মানুষটিকে আমরা এই প্রতিদান দিলাম? এ সময়টাতে অবশ্য দেশকে ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় অপরাধ। সে হিসেবে তিনি তো বিশাল অপরাধ করে ফেলেছেন। তাইতো দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজের মেধা ও শিক্ষা কাজে লাগাতে এসে এভাবে অপমানিত হলেন। এটা কি তার প্রাপ্য ছিলো?