তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার। এমন এক সময়ে ডাক্তারি পড়েছেন তিনি, যে সময়ে মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরোতেও পেতো ভয়। গুগল পর্যন্ত তার জন্মদিনে ডুডল বানিয়ে এই মহীয়সী নারীকে সম্মান জানিয়েছে...

ডাক্তার মানে সে তো মানুষ নয়, আমাদের চোখে সে তো ভগবান... নচিকেতার এই গানের পরবর্তী অংশ ডাক্তার ও কসাইদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কস্থাপনে ব্যস্ত হলেও... একটা সময় ছিলো যখন ডাক্তারদের প্রবল সম্মান ও আপামর জনগোষ্ঠীর কাছে বেশ গভীর এক গ্রহনযোগ্যতা ছিলো। যদিও সে সময়, অবস্থা বা পরিস্থিতি এখন আর নেই। তবে সেই সময়ের এক ডাক্তারের গল্প জানাই আজ। তাঁর নাম ডাক্তার জোহরা বেগম কাজী। যিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম মহিলা চিকিৎসক।

পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রাম হলেও জোহরা কাজীর জন্ম অবিভক্ত ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজনান গ্রামে। এখানকার স্থানীয় স্কুল ‘পুত্রিশালায়’ তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রাথমিক পড়াশোনা সমাপ্ত করার পর তিনি মিশনারীদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ‘বার্জিস মেমোরিয়াল’ এ ভর্তি হন। সেখানের পড়াশোনা শেষ করে তিনি যান আলিগড় মুসলিম মহিলা স্কুলে। সেখানের প্রথম বাঙালী মুসলিম মেয়ে হিসেবে তিনি এসএসসি পাশ করেন। এরপর পড়াশোনা করেন দিল্লীর 'লেডিহাডিং মেডিক্যাল কলেজ ফর উইম্যানস' এ। মাত্র তেইশ বছর বয়সেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমবিবিএস পাস করেন৷। পুরস্কার হিসেবে পান ভাইসরয় পদকও! এরপর তিনি চলে যান লন্ডনে। তখনকার সময়ে ডাক্তারি পেশার সর্বোচ্চ ডিগ্রি 'FRCOG' লাভ করেন তিনি সেখান থেকে। 

কর্মজীবন শুরু হয় ইয়োথমাল ওয়েমেন্স (পাবলিক) হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগ দেয়ার মাধ্যমে। মানুষের সেবা করার যে মহান ব্রত নিয়ে চিকিৎসক হয়েছিলেন, সেটার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ্য করি, যখন তিনি মহাত্মা গান্ধীর নির্মিত সেবাগ্রামে অবৈতনিকভাবে কাজ করার জন্যে বেতনের চাকরী ছেড়ে দেন। চাকরী ছেড়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার জন্যে জোহরা কাজী চলে আসেন সেবাগ্রামে৷ এ বিষয়ে আরেকটা তথ্যও জানিয়ে রাখি, মহাত্মা গান্ধীর পরিবারের সাথে জোহরা কাজী'দের পরিবারের ছিলো খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

জোহরা কাজীকে নিয়ে গুগলের বানানো ডুডোল

এরপর সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর জোহরা কাজী ঢাকায় চলে আসেন৷ পরবর্তীতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে যোগ দেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ এ তখন আলাদা গাইনিকোলোজি ডিপার্টমেন্ট না থাকায় পুরুষ ডাক্তারদের কাছ  থেকে সেবা নিতে অনেক নারীই অস্বীকৃতি জানাতেন। এতে করে যেটা হতো, অনেক নারীকেই পরবর্তীতে স্বাস্থ্যজনিত নানারকম সমস্যায় ও জটিলতায় পড়তে হতো। ডাঃ জোহরা কাজী বুঝলেন কিছু একটা করা দরকার। তাঁর প্রবল ইচ্ছায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে তাঁর নেতৃত্বে 'গাইনিকোলোজি ডিপার্টমেন্ট' খোলা হলো প্রথমবারের মতন। পরবর্তীতে মিটফোর্ড হাসপাতালেও এই ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়, তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতালের সাথে কাজ করেন তিনি অনেকদিন। পরবর্তীতে তিনি হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসাবে চিকিৎ‍সা সেবা প্রদান করেন৷ পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেলে অনারারী অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তিনি যে সময় ডাক্তারি পেশায় এসেছিলেন, সে সময়ে অনেক নারীর মনেই কুসংস্কার ছিলো এ পেশা নিয়ে। সামাজিক বাধানিষেধও ছিলো বেশ প্রবল। ডাঃ জোহরা'কে দেখেই অনেক নারী এ পেশায় আসতে আগ্রহী হন ও সাহস পান। এবং তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে অনেক নারীর বিচিত্র সব কুসংস্কার দূর করেন। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি বরাবরেই ছিলেন এক অনুকরণীয় আদর্শ। তাছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক ভ্রান্ত ধারণাও তিনি দূর করেন কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এসে। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পরবর্তীতে তিনি তখমা-ই-পাকিস্তানি, একুশে পদক এবং বেগম রোকেয়া পদক পান!

পরিবারের সাথে ডা. জোহরা বেগম কাজী

'ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে খ্যাত এই মহিয়সী নারীর জন্মদিন আজ। সেই উপলক্ষ্যে অন্যান্য সব উদ্যোগের পাশাপাশি টেক জায়ান্ট গুগলও তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, গুগল ডুডলে তাঁর 'ডাক্তার অবতার' ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সারাজীবন ধরে তাঁর যে কাজের ব্যপ্তি ও বিভিন্নতা-বিচিত্রতা, একটা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে নিয়ে আসার জন্যে 'বাতিঘর' হিসেবে কাজ করার যে অসামান্য এক জীবন, সে হিসেবে তিনি  শুধু 'ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা' নন, তিনি গোটা বাংলারই 'ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল!'

জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা