অথচ রাষ্ট্র তাকে একটা অ্যাম্বুলেন্সও দিতে পারেনি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
লিখতে ইচ্ছে করছিলো না। উনি তো চলেই গেছেন। কিন্তু আরো শত শত পোটেনশিয়াল ডা. মঈন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
করোনা সংক্রমণের পরে আমি মাস্ক বিষয়ক অনেকগুলো ভিডিও দেখেছি। সার্জিক্যাল মাস্ক, N95 বা PM2.5 রেস্পিরেটর থেকে শুরু করে সাধারণ কাপড়ের ব্যাগ দিয়ে বানিয়ে যেগুলো আমাদের দেশে রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে- সেগুলো নিয়েও। প্রথম কতকিছু জানলাম। করোনা ভাইরাসের সাইজ ১৩৫ ন্যানো মিটারের আশেপাশে। আশেপাশে বলার কারণ, মিউটেশনের ফলে কোভিড ১৯ এর সাইজেও পরিবর্তন পাওয়া গেছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যে গাউন পরতে হবে তার ক্লদিংসের একটা সেফটি স্ট্যান্ডার্ড আছে যেটা দিয়ে ভাইরাসটা ঢুকতে পারবে না। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব না মেনে কোনোরকম একটা বানিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন গার্মেন্টস তাদের ইচ্ছেমত তৈরি করছে। সেটাও অপ্রতুল। ফেস শিল্ডের সেফটি স্ট্যান্ডার্ড আছে। অবশ্য আমাদের দেশে গগলসই অনেক বেশি! আর ফেস শিল্ড! ফেস শিল্ড তো এখনও পলিথিনই এদেশে। সেফটি বুটস? বললে বলবে, আপনি ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন নাকি, মশাই?
তো ভাইরাসটার মত বেশিরভাগ অভিজ্ঞতা ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যেও নতুন। একদমই নতুন। দেশে ট্রেনিং বা গাইডলাইন নেই। যেখানে অটোক্লেভ সুবিধা আছে সেখানে পিপিই অটোক্লেভে দিয়ে পুনরায় ব্যবহার করছে। যেখানে নেই সেখানে গরম পানিতে ফুটিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কেউ বাসা থেকে পরেই যাচ্ছে। কেউ কাজ শেষে বাসায় এনে খুলে বয়েলিংয়ে দিচ্ছে। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ওয়ান টাইম ইউজের পর হাসপাতালে বা কর্মক্ষেত্রেই ডিসপোজ করাটাই স্ট্যান্ডার্ড। নিজেদের সিঙ্গাপুর দাবী করলেও আমরা জানি, দেশটা গরীব। বড়লোক দেশে হয়তো সোনাদানা চুরি করে। গরীব দেশ বলেই এদেশে চুরি করতে হয় চালের বস্তা।
সকালে দেখলাম, ডা. মঈন স্যার মারা গেছেন। একটু ফিরিস্তি দেই। উনি ৬ বছর এমবিবিএস পড়েছেন। ৫ বছর ধরে কার্ডিওলজিতে এমডি করেছেন। আরো ৫ বছর ধরে মেডিসিনে এফসিপিএস। এমডি-এফসিপিএস এ চান্স পেতে প্রিপারেশনের জন্যে কয়েক বছর লেগেছে নিশ্চয়ই। চান্স পাওয়ার পর দুই-চার-পাঁচ পার্সেন্ট রেগুলার পাশ করে। তার মানে কমপক্ষে ২০ টা বছর উনি চিকিৎসাবিদ্যা শেখার অধ্যাবসায়ে ব্যয় করেছেন। এর বাইরে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা আর রাজধানীর নাম মুখস্ত করে বিসিএসও দিয়েছেন। ফলাফল? প্রশাসন বা অন্য ক্যাডারের কেউ অসুস্থ হলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স চলে যায় যেখানে সেখানে রাষ্ট্র তাকে স্রেফ একটা অ্যাম্বুলেন্স দেয়নি! তাকে অসুস্থ অবস্থায় একটা প্রাইভেট হাসপাতাল (ওয়েসিস) থেকে নিজে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় আসতে হয়েছে! আবার লিখছি, সরকার তাকে একটা অ্যাম্বুলেন্সও দেয়নি। যে সিলেটে তিনি চিকিৎসা দিয়ে একটা জীবন ব্যয় করলেন, কোভিড ১৯ পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টে পিছপা হলেন না, সেই সিলেট তাকে চিকিৎসা দেয়নি!
লিখতে ইচ্ছে করছিলো না। উনি তো চলেই গেছেন। কিন্তু আরো শত শত পোটেনশিয়াল ডা. মঈন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। একজন ডেন্টিস্ট মারা গেছেন। একজন স্বাস্থ্যকর্মীও সম্ভবত। আমার এক স্যার বলতেন, ডাক্তার-নার্সরা স্টুডেন্ট লাইফ থেকে ইনফেকশনের মধ্যে থেকে অভ্যস্ত। আশেপাশে মাল্টি ড্রাগ রেসিস্টেন্ট টিবির পেশেন্টও থাকে। তাও তারা সাধারণত ইনফেক্টেড হয় না। এই পরিবেশে কাজ করতে করতে অ্যাকুয়ারড ইমিউনিটি কিভাবে যেন ডেভলপ করে যায়। কিন্তু একবার যদি হয়; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অটো ইনফেকশনের কারণে তাকে আর বাঁচানো যায় না। এটা খুবই সত্য। নির্মম সত্য।
যে কারণে মন খারাপ নিয়ে লিখলাম, হেলথ ওয়ার্কারদের মত আর কেউকে স্বেচ্ছায় রোগীদের এত ক্লোজ কনট্যাক্টে যেতে হচ্ছে না। শুধু ডাক্তার না, নার্স-ওয়ার্ড বয় সবার যেতে হচ্ছে। পুলিশ দাফনের দায়িত্ব নিয়েছে দেখলাম। যদিও এখন পর্যন্ত মৃত্যুর পরে করোনা ছড়ানোর প্রমাণ মেলেনি। তারপরেও যাদের এত কাছাকাছি যেতে হচ্ছে তাদের সকলের জন্যে যেন সরকার মানসম্মত, আমি আবার লিখছি, সরকার যেন প্রোটোকল মেনে মানসম্মত প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করে। তা না হলে মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাবে না। সংক্রমণের সম্ভাবনা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি, ধর্মান্ধদের চেয়েও। দেশে পঞ্চাশের বেশি চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত। স্বাস্থ্যকর্মী হিসাব করলে সংখ্যাটা অনেক বেশি হবার কথা। এগুলো এখনও স্রেফ সংখ্যা। এভাবে চললে এরপর পরিসংখ্যানে রূপ নেবে।
অনেকে করোনাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনা করছেন, মিলিয়ে ফেলছেন। দু'টো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। মুক্তিযুদ্ধে সবাই অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলো। এটাতে পারবে না। সবাই অংশগ্রহণ করতে গেলে বরং সবাইকে মিলে মরতে হবে। রাস্ট্রের কাছে চাওয়া তো শুরু থেকে একটাই- মানসম্মত প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট।
মঈন স্যারের পরিবার তার মৃত্যুশোক সহ্য করার ক্ষমতা লাভ করুক। আরেকটা কথা, যারা তাকে বাঁচাতে পারেনি- স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিএমএ নেতারা, সিলেট থেকে ঢাকা, কেউ যেন তার মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি না করেন। আপনাদের ব্যর্থতা ঢাকতে একটা মৃত মানুষ নিয়ে রাজনীতি করবেন না।
আরও পড়ুন-